X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আত্মহত্যার স্রোত ঠেকাতে হবে

লীনা পারভীন
১৬ মার্চ ২০১৭, ১২:৪৯আপডেট : ১৬ মার্চ ২০১৭, ১৩:০৫

লীনা পারভীন মানবজাতির অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী হওয়া সত্ত্বেও এরা যুগে যুগে কালে কালে রয়ে গেছে উপেক্ষিত। নারীর প্রতি এই উপেক্ষা কোনও ভৌগলিক সীমারেখা দিয়ে নির্দিষ্ট করা যাবে না। মাত্রাগত পার্থক্য ছাড়া উন্নত, অনুন্নত বা মধ্যম যে কোনও দেশেই এর বিস্তার রয়েছে।
আমাদের সমাজে একজন নারী তার জন্মের পর থেকেই ভুক্তভোগী। তাকে কিছু নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বেধে রাখা হয়। কী করা যাবে আর কী করা যাবে না সেটা খুব ভালো করেই মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। আর এই সীমারেখার মধ্যে থাকতে থাকতে একজন নারী হয়ে ওঠে সংকীর্ণমনা। তার জগত হয়ে যায় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর।
বর্তমান যুগে যদিওবা নারীরা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসছে, অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে কিন্তু তারপরও কোথায় যেন সেই সীমারেখাটা এখনও তাকে টেনে ধরে রাখে। দাগের বাইরে যেতে গেলেই আসে বাধা। এ যেন রামায়ণে সীতার জন্য তৈরি করা রাবনের অগ্নিরেখার মতো- যা ভেদ করে যাওয়াটা ছিল অসাধ্য। নারীরা যতই বাইরের জগতে আসছে ততই অঘটনের মাত্রাগুলো আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে আসছে। প্রতিবার একেকজন নারীর আত্মহত্যা বা নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আর নারী অধিকার সম্পর্কে বোধ সম্পন্ন কিছু মানুষ এ নিয়ে প্রতিবাদ জানাই। কেউ বা লিখে কেউ বা বলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়? এ প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের করণীয়।
একটি বাস্তব জীবনের ঘটনা বলতে চাই এখনে। আমার পরিচিত একজন নারী যে ব্যক্তিগতভাবে খুব প্রাণবন্ত মানুষ। বিয়ের আগে তার একটি ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল কিন্তু তার তথাকথিত সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন বাবা-মা প্রেমের সম্পর্কে মেনে নেয়নি। একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করা স্বাধীনচেতা একজন মানুষকে বিয়ে দিলেন তাদের পছন্দের এক ছেলের সঙ্গে। স্বামী-স্ত্রীর দুজনের মাঝে মানসিক দিক দিয়ে ছিল যোজন-যোজন পার্থক্য। স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটি মন থেকে এই সম্পর্কটিকে মেনে নিতে পারেনি। মনের বিরুদ্ধে কারো সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করা যায় না। মেয়েটি একটি ভালো চাকরিও করে। মোটামুটি বলা চলে তার আয়েই সংসারের সিংহভাগ খরচ চলে।

মেয়েটি চাইতো খোলামেলা জীবন-যাপন করতে, বন্ধুদের আড্ডায় যেতে, পছন্দের জায়গায় ঘুরে বেড়াতে। অন্যদিকে স্বামী ছিল তার একদম উলটো রুচির। প্রথম দিকে তাকে বোরখা পড়তে বাধ্য করলেও পরবর্তীতে মেয়েটি একপ্রকার যুদ্ধ করেই বোরখা পড়া থেকে রেহাই পেয়েছিলো। ঘটনাক্রমেই বন্ধুদের আড্ডায়ও সে যেতো মিথ্যা কথা বলেই। এর মাঝেই তার পরিচয় হয় একজন ছেলের সঙ্গে, যার সাথে তার পছন্দের মিল হয়, যার সাথে সে মন খুলে কথা বলতে পারে, নিজের না বলা কথা বলতে পারে এবং ছেলেটিও তার কথা শুনতে পছন্দ করে। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একধরনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলো। মেয়েটি স্বীকারও করলো যে তার সাথে সেই ছেলেটির একধরনের যোগাযোগ আছে এবং সেটা স্রেফ বন্ধুত্ব। কিন্তু এত অল্পতে সন্তুষ্ট নয় মেয়েটির স্বামী। শুরু করে দিলো মেয়েটির ওপর মানসিক নির্যাতন। ঘটনা এখন এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে মেয়েটি মাঝে মাঝে ভাবে সে আত্মহত্যা করবে বা কোনও এক অজানা জায়গায় চলে যাবে। মেয়েটিকে স্রেফ চরিত্রহীন বলে আখ্যা দেওয়া হলো।

এই একটি ঘটনা থেকেই আমরা ধারণা করতে পারি আমাদের সমাজে নারীদের সত্যিকারের স্বাধীনতা কতটুকু আছে। একজন শিক্ষিত, উপার্জনকারী নারীকেই যদি কেবল একজন পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার দায়ে এত নির্যাতন সহ্য করতে হয় তবে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের অবস্থা কী হতে পারে? আমি জানি আমাদের মধ্যেও অনেকেই এই ঘটনাটিকে ভালোভাবে নেবেন না বা মেয়েটি কেন অন্য ছেলের সঙ্গে মিশতে গেলো বলে প্রশ্ন ছুড়বেন। কিন্তু একজন মানুষ হিসাবে সে কার সঙ্গে মিশবে বা চলবে সেটা কে নির্ধারণ করবে?

আমাদের দেশে ক্রমশ ঘটে যাচ্ছে প্রযুক্তিগত বিপ্লব। আর এর একটা ধাক্কা সমাজে আসাটা খুব স্বাভাবিক। প্রযুক্তি এখন একজনের সঙ্গে আরেকজনের যোগাযোগকে করে দিয়েছে অনেক সহজ। ইন্টারনেটভিত্তিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে শহুরে থেকে গ্রামীণ সব জায়গাতেই। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। একদিকে নারীদের বাইরে আসার স্রোত অন্যদিকে বাইরের জগতের সঙ্গে খুব সহজেই মিশে যাওয়ার সুযোগ। এই দুইয়ের সংযোগ আমাদের প্রতিদিনকার জীবনকে করে তুলছে অস্থির। এমন অনেক মেয়ে আছে যারা সংসার করাটাকেই জীবনের একমাত্র ব্রত হিসাবে মনে করে না। তারা আরও কিছু করতে চায়, নিজেকে প্রমাণ করতে চায়। অন্যদিকে তার এই বহির্মুখী চাওয়াকে সংসারে মেনে না নেওয়ার মতো ঘটনা তাকে করে দেয় অসহায়। ফেসবুক হয়ে পড়ছে নিজের কষ্ট শেয়ারের জায়গা। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের আকাঙ্ক্ষায় গড়ে তুলছে ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব যার স্থায়িত্ব প্রমাণিত নয়।

সাধারণভাবে যখন মেয়েরা এ ধরনের কোনও সমস্যায় পড়ে তখন তার পাশে তার পরিবারকেও পাওয়া যায় না। এমনকি মেয়েটি কার কাছে মনের কথা খুলে বলবে সে জায়গাটাও পায় না।

এই যে দম বন্ধ করা পরিবেশ, এর থেকে মুক্তির উপায় হিসাবেই বেছে নেয় আত্মহত্যার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের আত্মহত্যা বা একজন জ্যাকুলিনের আত্মহত্যা, সর্বশেষ শান্তা নামের মেয়েটির ঘটনা এবং আমি যে ঘটনাটি শেয়ার করলাম সব ঘটনাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা এখনও নারীর জন্য তার অনুকূল পরিবেশটি তৈরি করতে পারিনি। বিপদে পড়লে নারীরা এখনও একা একাই লড়াই করে। কেউ সেটা সফলভাবে করতে পারে আর কেউ সমাধান খুঁজে নেয় মৃত্যুতে। আত্মহত্যা করা কোনও সমাধান নয়, কথাটি বলা যতটা সহজ, বাস্তব জীবনে তা মেনে চলা কতটা কঠিন সেটা যে এই পরিস্থিতিতে পড়েছে সেই বুঝতে পারে।

স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না সেটাও যেমন নারীর অপরাধ, নিজের মতো করে বেঁচে থাকবে সে চাওয়াটাও একজন নারীর জন্য ঔদ্ধত্যের সামিল। সমাজ সে সব নারীকে একটু অন্য চোখে দেখতে পছন্দ করে। এই যে আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তারা কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে? পরামর্শ করার মতো কি কোনও নির্দিষ্ট জায়গা আছে? আমি বলছিলাম কাউন্সেলিং সেন্টারের কথা। যেখানে গেলে সে মন খুলে কষ্টের কথা খুলে বলে একটা সমাধান নিয়ে আসতে পারবে।

জ্যাকুলিন মেয়েটি কিন্তু আত্মহত্যা করার আগে তার ফেসবুক পেইজে ঘোষণা দিয়েছিলো কিন্তু সে বিষয়টি তার চারপাশের মানুষজন কিভাবে নিয়েছিলো? কেউ কী এগিয়ে গিয়েছিলো তার কাছে? শুনেছিলো তার সমস্যার কথা? আমি নিশ্চিত সেও হয়তো চেয়েছিলো কারো কাছে মন খুলে কথা বলতে, সেও চেয়েছিলো কেউ তাকে শান্তনা দিক, বেঁচে থাকার প্রেরণা দিক। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মেয়েটিকে অসহায়ের মতো বেছে নিতে হয়েছিলো আত্মহত্যাকে। এভাবেই আমাদের দেশের হাজারো জ্যাকুলিন বা শান্তারা শান্তি খুঁজে নেয় মৃত্যুতে। একজন মানুষের আত্মহত্যার পেছনে বিভিন্ন ধরনের কারণ থাকতে পারে। কিন্তু সে সব কারণগুলোকে যদি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় তবেই আশা করা যেতে পারে যে আমরা একটি সভ্য ও সুন্দর সমাজের দিকে এগুচ্ছি। তাই বিচ্ছিন্নভাবে ঘটনাগুলোকে বিবেচনা না করে বা চিৎকার না করে যদি আমরা গঠনমূলক কিছু প্রস্তাব নিয়ে এগুতে পারি তাহলে হয়তো কাজের কাজ কিছু হবে। আমাদের কর্মক্ষেত্রেও ঘটে যাচ্ছে নানাধরনের নির্যাতনের ঘটনা কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করে কেউবা চুপ করে সহ্য করে যাচ্ছে। নেই কোনও প্রাতিষ্ঠানিক পরামর্শ সেল।

নারীবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে কেবল স্লোগানে থাকলেই চলবে না। গড়ে তুলতে হবে নারী বান্ধব নীতিমালা। সমাজের বিভিন্ন স্তরে গড়ে তুলতে হবে নারীদের জন্য সুযোগসুবিধা। নারীকে মন খুলে কথা বলার জায়গা করে দিতে হবে। নারীর মানসিক জগতের দিকে মনোযোগী হতে হবে। পারিবারিক শিক্ষা, বিদ্যালয়ের শিক্ষা সব জায়গাতেই নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। আমাদের সমাজে এমনিতেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। সমাজে নেই কোনও রাজনৈতিক বা সামাজিক শিক্ষা। সংস্কৃতি চর্চার গণ্ডিও দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।

একটা সমাজে জীবনবোধ গড়ে তোলার পেছনে রাজনীতি এবং সংস্কৃতির রয়েছে বিরাট ভূমিকা। এখনকার ছেলেমেয়েরা বেড়ে উঠছে বিদেশি সিনেমার নায়ক নায়িকাদের আদর্শ মনে করে। প্রেম কী এবং প্রেমের কী সৌন্দর্য সে সম্পর্কেও তাদের আজকাল ধারণা সিনেমাটিক।

আমার সমাজ আমাকে কী শেখায়, আমার সংস্কৃতি আমাকে কী ধারণ করতে শেখায় এগুলোর মূল্য অনেক বেশি। আজকাল কেউ সমাজের জন্য ভাবে না। একক ও বিচ্ছিন্ন হয়ে বেড়ে ওঠা এসব ছেলেমেয়েরা কেবল নিজেকে নিয়েই ভাবতে শেখে। নিজেকে গড়ে তোলার শিক্ষাটাও কি প্রকৃত অর্থে পাচ্ছে তারা?

এই যে বিচ্ছিন্নতা, এটাও কিন্তু আত্মহত্যার একটি বিরাট কারণ। ক্রমশ আমাদের মধ্যে হৃদ্যতা, বন্ধুত্ব, প্রেম ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। একজনের বিপদে আমরা আরেকজন ব্যথা পাই না। কারো মৃত্যু আজকাল আমাদের মনকে কাঁদায় না। প্রতিটা মৃত্যু আমাদের কাছে একটি ঘটনা মাত্র। বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে হবে সবাই মিলে।

আর তার মধ্যে নারীদের বিচ্ছিন্নতা তো ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। নারীর আবার বন্ধু কী? সে জন্মেছে কেবল ঘরকন্যা করার জন্য। মনের কথা খুলে বলাটা একপ্রকার পাপ হিসাবেই দেখা হয়। নারীকে তার এই একলা জগত থেকে কোলাহলের জগতে নিয়ে আসা দরকার। এরজন্য যা যা করতে হবে সে বিষয়ে আলোচনা না করে কেবল ঘটনার পর্যালোচনা করে সমাধান পাওয়া যাবে না।

অন্যদিকে প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক শিক্ষার ব্যবস্থা। নারীপুরুষ নির্বিশেষে দিতে হবে এই শিক্ষা। ক্রমপরিবর্তনশীল সমাজে যদি আমরা যথাযথ প্রস্তুতি নিতে না পারি তাহলে আত্মহত্যার মতো ঘটনা আরও বেড়ে যাবে। সমাজ ও পরিবারের মাঝে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গাগুলো সম্পর্কে চর্চা বাড়াতে হবে যাতে করে নতুন প্রজন্ম জীবন সম্পর্কে একটা বাস্তব শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। সাংস্কৃতি কর্মকাণ্ডের পরিধি আরও বাড়াতে হবে, উন্নত জীবনবোধের ভাবনাগুলোকে সামনে নিয়ে আসার কোনও বিকল্প নাই।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ