X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গিবাদ: দমন ও অস্বীকারের সমীকরণ

মাসুদা ভাট্টি
১৮ মার্চ ২০১৭, ১৬:১৮আপডেট : ১৮ মার্চ ২০১৭, ১৭:১৯

মাসুদা ভাট্টি সময় এসেছে বাংলাদেশের একত্রিত হওয়ার। রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে একটি প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে বাঁচানোর। বাংলাদেশ একটি ভয়ঙ্কর সংকটকালে আপতিত। আমরা যারা এই দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং বৈশ্বিক-রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কিঞ্চিত জানার চেষ্টা করি তাদের কাছেই একথাটি দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে যে, বাংলাদেশকে একটি সংকটময় দেশের তালিকায় প্রবেশ করানো গেলে, দক্ষিণ এশিয়া তথা এই এলাকায় একটি নতুন আন্তর্জাতিক খেলা শুরু করা সহজ হবে।
এই মুহূর্তের বাংলাদেশ একটি মিহি সুতোর ওপর দিয়ে হেঁটে চলছে। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দেশটির প্রতিটি রাজনৈতিক দল আগ্রহী হয়ে উঠছে, যা শুধু ইতিবাচকই নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্যও জরুরি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটিকে সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য একটি মধ্যবর্তী পন্থা হিসেবে মেনে নিয়ে আমাদের একথা বলতেই হচ্ছে যে, আজকে যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে দেশটি এগুচ্ছে, তাতে এর বাইরে বিকল্প কোনও পথ খোলা ছিল না। সেদিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে দেশটিতে যে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হতো, তাতে বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্র একটি উগ্র ধর্মভিত্তিক শক্তির হাতে চলে যেতো। তা কোনোভাবেই দেশটির জন্য মঙ্গলজনক হতো না। একই কথা প্রযোজ্য বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের অস্থিরতা সৃষ্টি হলে তার অভিঘাতই কেবল নয়, তার সরাসরি প্রভাব পড়বে দেশগুলোর ওপর, যা গোটা উপমহাদেশের স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকিস্বরূপ।
জঙ্গিবাদ একুশ শতকের পৃথিবীতে একটি শক্তিশালী অস্ত্র। পশ্চিমা দেশগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থে যে অস্ত্রটি তৈরি করা হয়েছিল, তা এখন পশ্চিমের দেশগুলোর বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। কিন্তু সার্বিকভাবে এখনও পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় জঙ্গিবাদের ঝুঁকি আমাদের মতো দেশগুলোর জন্যই তীব্রতর। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ একটি দরিদ্রতর দেশ ছিল। ক্রমশ দেশটি দরিদ্রতা থেকে বেরুতে শুরু করেছে, এখনও সম্পূর্ণভাবে দেশটি এই অভিশাপমুক্ত হয়নি। একসময় এদেশটির একদল শিক্ষিত/চিন্তাশীল মানুষ ভেবেছিলেন যে, দরিদ্রতাই হতে পারে দেশটির জন্য একটি সুলভ কৌশল, যা দিয়ে উন্নত দেশগুলো থেকে সাহায্য এনে দেশটি টিকে থাকতে পারবে। কিন্তু একথা কেউই বুঝতে চাননি যে, কেবলমাত্র সাহায্য-নির্ভর হয়ে খুব বেশিদিন টিকে থাকা যায় না, এবং কোনও দেশই পারেনি। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেইস’ করে রাখাও সম্ভব হয়নি। দেশটির ভেতরকার গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান এবং জনগণের মিলিত প্রচেষ্টার ফলে। আরও বড় কথা হলো, উন্নত দেশগুলোও কখনও কেবলমাত্র সাহায্যের জন্য সাহায্য দিতে পারে না। বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়া কোনও গরিব রাষ্ট্রকে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছে বলে প্রমাণ নেই।
বাংলাদেশকেও সাহায্য-সহযোগিতার নামে দেশটির রাজনীতিতে ছড়ি ঘোরানোসহ দেশটিকে দক্ষিণ এশিয়ার ‘গেইটওয়ে’ হিসেবে ব্যবহারের যে প্রবণতা পশ্চিমা দেশগুলোর ভেতর লক্ষ্য করা যায়, তা আসলে বাংলাদেশের জন্য খুব একটা সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দল, নেতা বা সরকারই এই প্রবণতায় বাধ সাধতে গিয়েছে, তাদেরকেই কোনও না কোনোভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিদেশি স্বার্থের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগকে যতটা সোচ্চার হতে দেখা যায়, ততটা সোচ্চার আমরা আর কোনও নেতা কিংবা রাজনৈতিক দলকে দেখতে পাই না। এটা দেশটির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার।
ফিরে আসি বর্তমান বাস্তবতায়। এই বাস্তবতাকে বিচার করতে গেলে গত বছর জুলাই মাসে গুলশানের হোলি আর্টিজানে ঘটে যাওয়া জঙ্গি আক্রমণ থেকে শুরু করতে হবে। আমরা জানি যে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের উন্নয়ন-সংকটের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় যে বিপদটির মুখোমুখি হয়েছে তাহলো এই জঙ্গিবাদ। কেবল সরকারের কথা বলছি কেন, জঙ্গিবাদের সবচেয়ে বড় শিকার এই মুহূর্তে এদেশের জনগণ। কোনও রকম ভয়-ভীতি ছাড়া স্বাভাবিক জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে যেমন এই জঙ্গিবাদ বাধার সৃষ্টি করছে, তেমনই দেশের ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক ক্ষেত্রটিও আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে জঙ্গিবাদের দ্বারাই। বিশেষ করে এদেশের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম বড় কারণ এই জঙ্গিবাদ। প্রশ্ন হলো, এই জঙ্গিবাদ আসলে কার সৃষ্ট? এই প্রশ্নের উত্তর খুব ছোট করে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই ছোট্ট নিবন্ধে একথাই জোর দিয়ে বলতে হবে যে, এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে পৃষ্ঠপোষকতা স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত চলেছে, তার ভয়ঙ্কর ফসল এই জঙ্গিবাদ। কারণ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারখানায় এই জঙ্গিবাদের জন্ম, যা মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানভিত্তিক অর্থায়নের প্রভাবে এদেশে ফুলেফেঁপে উঠেছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক শাসনামল ও সামরিক ছাউনিজাত রাজনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতাকে যদি যোগ করি, তাহলে গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশের জনমানসে একটি ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিতে সফলতা এসেছে, একথা অস্বীকার করার কোনোই উপায় নেই। এদেশে জঙ্গিবাদী আক্রমণ ঘটানোর যে ক’টি ঘটনা ও তার সঙ্গে জড়িতদের সম্পর্কে যতোটুকুই জানা গেছে তাতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, দেশের উঠতি মধ্যবিত্ত সমাজেও এই দানব তার নখদন্তসমেত ঢুকে পড়েছে, যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। একটি দেশের মধ্যবিত্ত সমাজ যদি দেশটির মৌলিক চেতনার বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করে, তাহলে দেশটি একটি গাড্ডার ভেতর পড়ে যায়। বাংলাদেশেও সেই ঘটনাটি ঘটেছে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যদিও এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।

যাহোক, জঙ্গিবাদের যে বিপদের কথা এতক্ষণ বলেছি তার সর্বশেষ উদাহরণ হলো আশকোনায় নির্মাণাধীন র‌্যাব সদর দফতরে আত্মঘাতী বোমা হামলা। হামলাকারী ছাড়া বাকি কেউ নিহত না হলেও এই ঘটনা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারতো, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে শুক্রবার এলেই মানুষ আতঙ্কে ভুগতে শুরু করে, এই বুঝি কোথাও আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ হলো। বাংলাদেশও সে দিকে যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে আমাদের ভাবার সময় এক্ষুণি। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শুক্রবারকে আর পবিত্র জুম্মাবার হিসেবে পালন না করে এই দিনটিকে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। তাদের প্রকৃত ধর্ম পালনকারী কী নয়, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার আমি কেউ নই। কারণ যারা ধর্মের নামে মানুষ খুন করছে তাদেরও ব্যাখ্যা আছে এবং তারাও ধর্ম দিয়েই তা বৈধ করার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু কথা সেটি নয়, কথা হলো, বাংলাদেশের মতো একটি শান্তিপূর্ণ দেশের ক্ষেত্রে এই জঙ্গিবাদ যে মহামারী হয়ে উঠতে যাচ্ছে, তার প্রমাণ কি ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি না? যদি পেয়ে থাকি তাহলে কোথায় আমাদের সমন্বিত শক্তির রুখে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা? এটিকে কেন আমরা কেবলমাত্র সরকারের দায় ও দায়িত্ব বলে ধরে নিয়ে এখনও রাজনীতিই করে যাচ্ছি? এ প্রশ্ন কেন তুলছি? এর উত্তর দিয়েই আজকের লেখার ইতি টানবো।
লক্ষ্য করে দেখুন, বাংলাদেশে যখন থেকে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে তখন থেকেই একপক্ষ একে অস্বীকার করেছে, আরেকপক্ষ একে দমনের কথা বলেছে। হয়তো দমন করার কথা যারা বলছে বা চেষ্টা করছে তাদের পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন থাকতে পারে, যদিও বিশ্বের কোথাওই জঙ্গিবাদ দমনে কোনও সফল ফ্রেমওয়ার্ক দাঁড় করাতে পারেনি, এখনও বিষয়টি ট্রায়াল অ্যান্ড ইরর-এর ভেতর দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে হলি আর্টিজানের ঘটনার পর সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে এই জঙ্গিবাদ দমনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাতে আমাদের একথা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে, সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক। অপরদিকে এর জন্য সরকারকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনাও কম শুনতে হচ্ছে না। বিশেষ করে জঙ্গিবাদ দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা সে প্রশ্ন উঠেছে। এখন সরকার পড়েছে মহাসংকটে। কঠোর না হলে জঙ্গিবাদ নামক রাক্ষস দেশ ও জাতিকে শেষ করে দেবে আর কঠোর হতে গেলে মানবাধিকারবাদীরা সরকারবিরোধী হয়ে উঠতে এক মুহূর্ত সময় নিচ্ছে না। এই উভয় সংকটকালে সরকারের একমাত্র সহায় হতে পারে জনগণ। একমাত্র জনগণের সমর্থনই পারে সরকারকে এই মহাদানব দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে।

প্রশ্ন হলো, দেশের বাকি রাজনৈতিক শক্তিগুলো যদি এক্ষেত্রে সেই সাবেক অস্বীকারের মানসিকতা নিয়েই বসে থাকে তাহলেতো কোনোভাবেই এই দানবকে দমন সম্ভব হবে না, হবে কি? যে কারণে শুরুতেই বলেছি যে, বাংলাদেশকে এই জঙ্গিবাদের মতো মহাসংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে শক্ত রাজনৈতিক সমর্থন ও শক্তি, যা কেবল সরকারি দল নয়, সকল রাজনৈতিক শক্তিকে এগিয়ে আসার মাধ্যমেই নিশ্চিত করতে হবে।

একথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, বাংলাদেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক জনগণ জঙ্গিবাদের সমর্থক, বরং এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার পক্ষের মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাছাড়া যে অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে দেশের মানুষ সামান্য হলেও জীবন বদলের দিশা পেয়েছে ,তা এই জঙ্গিবাদের কারণে হারাতে চাইবে না কেউই। সরকার যেমন জনগণের কাছ থেকে এভাবেই শক্তি সঞ্চয় করতে পারে বা করছে, তেমনই বিএনপি’র মতো বড় রাজনৈতিক দলও যদি ক্রমাগত জঙ্গিবাদকে অস্বীকার করে যায়, তাহলে তারা কোনও দিনই জনগণের কাছে আর পৌঁছুতে পারবে না। সেক্ষেত্রে তারা কেবল নির্বাচন-বিরোধিতা করে কিংবা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এক সময় মুসলিম লীগের পরিণতিই বরণ করবে। জনগণ যদি রাজনৈতিক দলের তুলনায় আধুনিক হয়ে যায় তাহলে সে রাজনৈতিক দলের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন, সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর প্রমাণ আমরা বার বার দেখেছি, বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেতো এর উদাহরণ ভুরি ভুরি রয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক।
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ