X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মঙ্গল শোভাযাত্রা

তসলিমা নাসরিন
০২ এপ্রিল ২০১৭, ১৯:৫৬আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০১৭, ২৩:০০

 

তসলিমা নাসরিন বিভিন্ন ইসলামি দলের জোট ‘ইসলামি ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি’ বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। সমাবেশে বক্তারা বলেছেন, ‘আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ইসলামের আকিদাবিরোধী মূর্তি প্রত্যাহার ও বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা বাতিল করতে হবে। অন্যথায় আল্লাহর গজব নেমে আসবে। মূর্তি মানলে, মঙ্গল শোভাযাত্রা মানলে মুসলমানিত্ব থাকবে না। হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে মূর্তি না সরালে মুসলমানরা কেন্দ্রীয় ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায় করবে না।’
আমার তো মনে হয় না, যদি ইসলামি দলগুলো নিজেরা না ঘটায়, তাহলে কিছু হবে। বাংলাদেশে বহুকাল থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা হচ্ছে, বহুকাল থেকে ভাস্কর্যে শোভিত রয়েছে দেশ, গজব পড়েনি।
ইসলামি ঐতিহ্য যে শুধু আরবীয় ঐতিহ্য নয়, তা কবে বুঝবে ওরা? অধিকাংশ মুসলমানই বাস করে আরব দেশগুলোর বাইরে। ইন্দোনেশিয়া সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুসলমানের দেশ। ভাস্কর্যে ভরে আছে ইন্দোনেশিয়া, কেউ তো ওগুলোকে ভেঙে ফেলছে না! কেন বাংলাদেশের মানুষ আরব হতে চায়, কেন আরবি পোশাক পরে, কেন ভাস্কর্য ভাঙার, মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ করার চেষ্টা করে? তারা হয়তো জানে না, আরবের সংস্কৃতি মানেই ইসলামি সংস্কৃতি নয়। ইসলাম প্রবর্তন হওয়ার আগেও আরব দেশ ছিল। আরবদের পোশাক, আশাক, খাদ্য, পানীয়, আচার আচরণ এবং সংস্কৃতির অনেকটাই প্রাক-ইসলাম যুগের।
আমি অবাক হই, কেন ওই ভালো মানুষেরা এই বলে স্লোগান দেয় না যে মুসলমানের দেশে জঙ্গিবাদ চলবে না, বোমাবাজি চলবে না, মানুষ খুন চলবে না। কেন স্লোগান দেয় না, মুসলমানের দেশে ধর্ষণ চলবে না, নারী নিগ্রহ চলবে না, যৌন নির্যাতন চলবে না, বৈষম্য চলবে না? কেন দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন নেই? কেন সবার জন্য শিক্ষা স্বাস্থ্য’র দাবি ওরা করে না? ওরা করে না কারণ সমাজ নিয়ে ওদের কোনও মাথাব্যথা নেই। ওরা যা চায়, তা হলো ছলে-বলে কৌশলে, ক্ষমতা। ওরা সিংহাসন চায়। সিংহাসনে বসে ওরা যা ইচ্ছে তাই করতে চায়। ইতিমধ্যে ওরা প্রমাণ দিয়েছে, ওরা কী চায়, ওরা কী করে, ওদের কী উদ্দেশ্য।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় কী আছে যে ওরা শোভাযাত্রার বিরোধিতা করছে? শোভাযাত্রা ঢাকার চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীরা শুরু করেছিল ১৯৮৯ সালে। এমন কোনও পুরনো ঐতিহ্য নয় এটি। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করে মানুষ। কাগজের তৈরি হাতি ঘোড়া, ফুল, পাখি। এখন শুধু ঢাকায় নয়, বাংলাদেশের আরও শহরে পয়লা বৈশাখের সকালে শোভাযাত্রা বেরোয়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ইউনেস্কোর অধরা বা ইনট্যানজিবল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায়। তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশ সরকার চাইছে যে করেই হোক মঙ্গল শোভাযাত্রা ঘটতে গিয়ে যেন কোনও অমঙ্গল না ঘটে। কিন্তু অমঙ্গল যারা চাইছে তাদের কী করে দমন করবে সরকার আমার জানা নেই। এদের তো সব সরকারই দুধ-কলা দিয়ে পুষেছে। এখন এদের ছোবল বা কামড় কিছুটা তো খেতেই হবে। শেষ অবধি মঙ্গল জেতে নাকি অমঙ্গল জেতে, সেটিই দেখার।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় যারা হাঁটে, তাদের কারও হাতে তলোয়ার থাকে না, চাপাতি থাকে না। মানুষকে হত্যা করার, কোপানোর কোনও অস্ত্র থাকে না কারও হাতে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বাঁশের বাঁশি, ঢাক-ঢোল, শীতল পাটি, থাকে ভাটিয়ালি-বাউল গান। ইসলাম আসার আগে বাংলায় সংস্কৃতি ছিল, ইসলাম তো সব মুছে দিতে আসেনি। নিজের সংস্কৃতি পালন করেও তো ভিন দেশের ধর্ম গ্রহণ করা যায়। পৃথিবীর সব দেশেই তা হয়েছে। সংস্কৃতি কি শুধু ধর্মের সংস্কৃতিই? ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়াও তো সংস্কৃতি রয়েছে এবং মানুষ তা পালন করে। ইউরোপের মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের ধর্ম গ্রহণ করেছে, তাই বলে তো ইউরোপের সংস্কৃতি বিসর্জন দেয়নি। সব মাটিরই নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, এমনকি খোদ আরবেও এমন অনেক সংস্কৃতি আছে, যে সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই। যে পোশাক আরবের লোকেরা পরে, সে পোশাক তারা ইসলাম আসার আগেও পরতো। ওই পোশাক আরবের মরুভূমির লু-হাওয়ায় চলাফেরা করার জন্য উপযুক্ত বলে পরতো। পোশাক আশাকের সঙ্গে, গান বাজনার সঙ্গে, খাদ্য পানীয়র সঙ্গে, জীবনযাপনের আরও অনেক কিছুর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। এক ধর্ম গিয়ে আরেক ধর্ম আসে, সংস্কৃতি অক্ষত থাকে, অথবা সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটে। এই বিবর্তন জোর করে ঘটানো যায় না। গ্রিক ও রোমানরা তাদের আগের যে ধর্ম ছিল, সেটা বাতিল করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি কিন্তু গ্রহণ করেনি, শুধু ধর্মটুকু গ্রহণ করেছে। যিশু যে পোশাক পরতেন, তা কিন্তু গ্রিক আর রোমানরা পরছে না। মরিয়ম যে পোশাক পরতেন সেটিও গ্রিক আর রোমান মেয়েদের পোশাক নয়। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে ধর্ম ঢুকেছে। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা সংস্কৃতিকে নষ্ট করতে চায়, তারা সংস্কৃতির তো শত্রুই, তারা ধর্মেরও শত্রু। ভিন্ন ভাষাকে, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন জাতিকে গ্রহণ করার উদারতা ধর্মের থাকে। থাকতে হয়। যারা ধর্মের এই উদারতা মানে না, তারা নিশ্চয়ই ধর্মের শত্রু। বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে, আর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে যারা চিৎকার করছে, অসহিষ্ণুতা তাদের ধর্ম। যারা ইসলামকে একটা অসহিষ্ণু ধর্ম হিসেবে বিশ্বময় প্রচার করতে চাইছে, তাদের থেকে ধর্মকে যত শিগগির বাঁচানো যায়, ততই মঙ্গল।   

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ