X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক ধর্ম

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১২ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:৪৬আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:৪৮

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা এই লেখা যখন লিখছি, তখনই খবর এলো বাংলা বর্ষবরণ উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনের দেয়ালে আঁকা চিত্রে পোড়া মবিল ঢেলে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে নগরের বাদশা মিয়া সড়কে ইনস্টিটিউটের সামনে এই ঘটনা ঘটে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে ফিনলে কোম্পানির দেয়ালে নববর্ষকে সামনে রেখে কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন চিত্রপট এঁকেছিলেন চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। দেয়ালে চিত্র অঙ্কন এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য বিভিন্ন মুর‌্যাল তৈরির কাজ ছিল। আর সে রাতেই গণভবনে কওমি মাদ্রাসার কিছু নেতাকে ডেকে এনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান দেওয়ার ঘোষণা দেন এবং সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রীক থেমিসের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার জন্য প্রধান বিচারপতির সাথে কথা বলবেন বলে আশ্বাস দেন। এই নেতাদের মধ্যে ছিলেন, হেফাজতে ইসলামের আমীর হেফাজত নেতা মওলানা আহমদ শফি। এই হেফাজত ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলে জঙ্গি তাণ্ডবের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছিল। 
দুটি ঘটনার মধ্যে সেই অর্থে সম্পর্ক আছে তা বলা যাচ্ছে না, কিন্তু খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে কাকতালীয়। এই আহমদ শফির হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে খেলাফতের শাসন চায়, তারা পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধিতা করে, তারা নারী নেতৃত্বকে হারাম বলে, তাদের কথায় স্কুল পাঠ্যবই সাম্প্রদায়িকতায় ভরে ওঠে, আবার তাদের সাথে বসেই সরকার প্রধান যখন দেশকে ইসলামীকরণের পথে অগ্রসর হয়, তখন চট্টগ্রামে শিল্প আর ঐতিহ্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
এই আপোষের ফরমুলা আবার প্রমাণ করলো, মুখে মুখে যতই উদারতার কথা বলুক না কেন, এদেশের শাসকগোষ্ঠী আসলে সাম্প্রদায়িক। আমাদের রাজনীতির ধরন হলো, পদে পদে মনে করিয়ে দেওয়া যে হিন্দু আর মুসলমান পরস্পরের শত্রু। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এতো আত্মত্যাগ বুঝি আজ বৃথা যেতে বসেছে। উদার, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য মানুষ যে জীবন দিল, সবই অস্বীকার করার নামান্তর এরকম অঙ্গিকার। বাংলাদেশ আজ বিপন্ন। সাম্প্রদায়িকতা আর গোড়ামি তাকে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। নাগরিকদের সুখদুঃখ, তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, তাদের কৃষ্টি, সব আজ মৌলবাদের চাপে পিষ্ট।

আমরা বলি দেশ এগিয়ে চলেছে, আধুনিক হচ্ছে। এই হলো এগিয়ে যাওয়ার নমুনা? বলতে বাধ্য হচ্ছি সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপোষ করে রাজনীতি করলে দেশ কখনও এগুবেনা। এই রাজনীতি বারবার একথাই পদে পদে মনে করিয়ে দেয়, দেশটি শুধু মুসলমানের, সব ধর্মের মানুষের নয়। এবং এই দর্শন পশ্চাতে নিয়ে যায় দেশকে।

সাম্প্রদায়িকতা তো বরাবরই বাংলাদেশের সমাজের ক্যানসার হয়ে রয়েছে। এদেশে বড় একটি অংশ কথায় কথায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে অজুহাত হিসেবে ভারতে মুসলমানদের কথা টেনে আনে। এরা পাকিস্তানি দর্শনে বিশ্বাসী যেদেশে কোনও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি দিনও কাটে না আক্রমণের শিকার হওয়া ছাড়া। হিন্দুদের মুসলমানদের অধীনে থাকতে হবে, এ রকমটাই এই গোষ্ঠীর দর্শন। যারা মতিঝিল শাপলা চত্বর ধ্বংস করতে এসেছিল, আর যারা নাসিরনগরে লুটতরাজ যারা করেছে, তারা একই দর্শনের শক্তি। এই দর্শনের বিশ্বাসীরাই মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধিতা করে, এরাই রমনার বটমূলে ছায়ানেটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে, উদীচীর ওপর হামলে পড়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য যারা আরেকটি ১৯৭৫ চায়, যারা পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার প্রকল্প নিয়ে মাঠে সরব তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করে এই গোষ্ঠী।এখন আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না যে, এদেশে একটিও ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল আছে যে অসাম্প্রদায়িক, হিন্দু-মুসলিম ভেদে বিশ্বাস করে না।     

যারা ধর্ম নিয়ে গলা চড়ায় সেইসব ধর্মব্যবসায়ীদের কখনও কেউ কোনও সামাজিক কল্যাণের কাজে উৎসাহ দিতে দেখেছেন? শিক্ষার প্রসারে, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ দূর করার আন্দোলনে এদের ক’জনকে দেখা যায়?  যায় না কারণ এসব করলে পূণ্য হলেও লুট করার মতো মজা পাওয়া যায় না।

যারা এসব চান না তাদের উদাসীনতা ক্রমেই পরিস্থিতিকে আয়ত্বের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যবশত উদারতা ও অন্তর্ভুক্তির ঐতিহ্য সংকীর্ণবুদ্ধি সাম্প্রদায়িকতার কারবারিদের দ্বারা বিকৃত হয়ে চলেছে। বাংলাদেশের পরিচয় যেমন ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়, তেমনি ধর্ম সর্বস্বও নয়। কিন্তু একটি গোত্রের তাত্ত্বিকরা একটি বৃহৎ সমগ্রের অঙ্গীভূত করার বাঙালি ঐতিহ্যকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অপরিসর বৃত্তে সঙ্কুচিত করে ফেলছে। আর এর ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে উগ্র, জঙ্গি, মারমুখী ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার। এই গোষ্ঠীর অনুগামী ‘স্বেচ্ছাসেবক’রা তাই সুযোগ পেলেই লাঠি আর রাম দা নিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, ধর্মনিরপেক্ষদের, এমনকি উদার ধার্মিকদেরও শায়েস্তা করতে পথে বের হয়ে আসে। সহিষ্ণুতা, উদারতা ও অন্তর্ভুক্তির জীবনচর্যা ক্রমে অন্য ধর্মের মানুষদের ওপর আক্রমণের, তাদের বিতাড়নের ধর্ম হয়ে উঠছে। জানা নেই ধর্মীয় আচার আচরণ এবং রাজনীতির উদ্দেশ্য সাধনে ধর্মকে ব্যবহার করবার এই প্রবণতা  কবে আলাদা করা যাবে।  

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ