X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিশের বদলে ডিম সাথে একটু তেঁতুল!

আহসান কবির
১৪ এপ্রিল ২০১৭, ১২:২৪আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৩৮

আহসান কবির এক দম্পতির বিয়ে হয়েছে দশ বছর।  বাচ্চা কাচ্চা হয়নি।  উল্টো ডাক্তার সাহেব জানিয়ে দিয়েছেন স্বামী বেচারা কখনও বাবা হতে পারবে না।  কী আর করা? বউ গেলো এক পীর সাহেবের কাছে।  পীর সাহেব তাকে হেফাজতে নিয়ে বললেন- হবে।  অবশ্যই বাচ্চা হবে।  তবে আমার কথা শুনতে হবে।  বছর দেড়েক পর বাচ্চাও হলো।  পাড়া-পড়শি আর আত্মীয়-স্বজন আনন্দিত! শুধু স্তম্ভিত স্বামী বউয়ের কাছে জানতে চাইলো- পীর সাহেব তোমাকে হেফাজতে নিয়ে কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিয়েছেন? হোমিওপ্যাথি, হারবাল, আয়ুর্বেদিক নাকি এলোপ্যাথি? স্ত্রী খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো- এই পদ্ধতির নাম সিমপ্যাথি!
আজকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'রাজনৈতিক সিমপ্যাথি' পাচ্ছেন আল্লামা শফী! ২০১৩ সালে তিনি এরশাদ এবং খালেদা জিয়ারও সিমপ্যাথি পেয়েছিলেন।  'সরকারি সিমপ্যাথির' কারণে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন হয়েছে যা এরশাদ কিংবা খালেদা জিয়াও করে দেখানোর সাহস করেননি।  এরপর এসেছে উচ্চতর ডিগ্রির ন্যূনতম চাহিদা পূরণ না করা সত্ত্বেও কওমী সর্বোচ্চ সনদের স্বীকৃতি, হাইকোর্ট প্রাঙ্গন থেকে ভাস্কর্য অপসারনের দাবি যা খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকেই উচ্চারিত হয়েছে, প্রাচীর চিত্রে পোড়া মোবিল ঢেলে তা নষ্ট করা এবং শেষমেষ নববর্ষের ঐতিহ্যখ্যাত মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতি হুমকি! অথচ শুরু থেকে বহুদিন হেফাজতে ইসলামি এই ধরনের দলই ছিল না।  খোদ ভারতে তাদের চেহারা এখনও ভিন্ন।  প্রিয় পাঠক নিজের পুরনো লেখা থেকে খানিক উদ্ধৃতি দিতে হচ্ছে বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি (যদিও নিজের পুরনো লেখা থেকে ধার নেওয়া দোষের কিছু না।  মধ্যযুগের টান বার বার ফিরে আসতে চাইলে আমরা কিইবা করতে পারি?)
এক. ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ নামের জায়গায় ১৮৬৬ সালে গড়ে ওঠে দেওবন্দ দারুল উলুম মাদ্রাসা। ভারত এবং বাংলাদেশের বহু মানুষ তখন থেকে আজ পর্যন্ত দেওবন্দে যান শিক্ষা নিতে।  শুরু থেকেই এই দেওবন্দীরা ব্রিটিশ বিরোধী।  ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় এবং পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা লাভ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দেওবন্দীরা মূলত মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধীর অহিংস নীতির পক্ষে এবং আজো তারা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির অনুসারী।  এই দেওবন্দীদের শতকরা একশ ভাগ অনুসারী ছিল হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ।  দেওবন্দী বা হেফজতের অনুসারী মাদ্রাসাগুলো কওমী মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত।  এদের ব্রিটিশ বিরোধিতার সুযোগ নিয়ে আবুল আলা মওদুদীর ছিনতাইকৃত সংগঠন জামায়াতে ইসলাম ব্রিটিশদের তাবেদারি করার সিদ্ধান্ত নেয়।  ব্রিটিশরা এদের সমর্থনে সরকারিভাবে কিছু মাদ্রাসা গড়ে তোলে যা আলিয়া মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত।  শুরু থেকেই দেওবন্দী তথা হেফাজতিরা ব্রিটিশ বিরোধিতার মতো জামায়াতে ইসলামেরও ঘোর বিরোধী ছিল যা ২০০৮-২০০৯  সালে এসে পরিবর্তিত হয়েছে! হায় ক্ষমতার লোভ সবাইকেই বদলে দেয়!

দুই. ভারতে দেওবন্দের অনুসারীদের নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠনের নাম জমিয়তে উলামা-ই-হিন্দ।  প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১৯।  জমিয়তে উলামার শীর্ষ নেতা উস্তাদ শাইখুল ইসলাম হজরত মাওলানা সৈয়দ হুসেইন আহমেদ মাদানীর সংস্পর্শে এসেছিলেন হেফাজতের বর্তমান শীর্ষ নেতা আল্লামা শফী।  সৈয়দ আহমেদ মাদানী তার মৃত্যুর সময়ে ১৯৫৭ সালে আল্লামা শফীকে খেলাফত দিয়ে যান।  মাদানী সাহেবের ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণায় হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসা চালান আল্লামা শফী। শফী সাহেবের ওপর মাদানী সাহেবের প্রভাব এতই বেশি যে শফী সাহেব তার ছেলের নাম রেখেছেন মাদানী।

সৈয়দ হুসেইন মাদানির ছেলে আসাদ মাদানীর মৃত্যুতে সে সময়কার রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং সোনিয়া গান্ধী সমবেদনা জানিয়েছিলেন।  জমিয়তে উলামা হিন্দের বর্তমান শীর্ষ নেতা আসাদ মাদানীর ভাই আরশাদ মাদানীর সাথেও সুন্দর সম্পর্ক ছিল শফী সাহেবের।  সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে  হাটহাজারীতে এসে আরশাদ মাদানী ওয়াজ নসিহত করে যান।

তিন. দেওবন্দ অনুসারীরা যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করে আসছিল, এতোদিন পরে এসে ভারত আর বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক চরিত্র দুই রকম হয়ে গেলো কেন? রাজনীতির এই বিচিত্র বাক বদলের সময়ে তারা হয়তো ভাবছে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে খারাপ সময় এখন জামায়াতের।  কখনোই তারা আর ফিরতে পারবে না আগের অবস্থায়।  তাই জামায়াতের জায়গাটাই তাদের দখলে নিতে হবে।  ব্যাংক, বীমা, এনজিও, হাসপাতাল আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।  হয়তো সেকারণেই আজন্ম জামায়াত বিরোধী হেফাজত এখন জামায়াত ভালোবাসায় অবতীর্ণ হয়েছে।  আর তাই এতদিন ধরে তাদের প্রচার করে আসা মওদুদীবাদের অকার্যকারিতার বিরুদ্ধে কোনও কথা নেই, নীরব তারা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার প্রসঙ্গেও! গণজাগরন মঞ্চের প্রতি তারা জামায়াতের মতই মারমুখী।  হেফাজতের অনেকেই এখন মনে করেন জামায়াতের ওপর সরকারের আক্রমণ মানে ইসলাম কিংবা ইসলামি দলের প্রতি আক্রমণ! হাঁটছেও তারা জামায়াতের ফেলে আসা পথে।  জামায়াত টিকে থাকার জন্য যেভাবে জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আঁতাত করে পথ চলেছে হেফাজতও এখন তাই করছে।  এরশাদ তাদের শাপলা চত্বর অবরোধের সময়ে পানি খাইয়েছিলেন, খালেদা জিয়া তাদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। 
বঙ্গবন্ধুর সময়ে একদল তরুণ বাম আদর্শের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে দেশটাকে বদলে ফেলার স্বপ্ন দেখেছিল।  দুই বাম দল সিপিবি ও ন্যাপ মোজাফফর তখন পরিণত হয়েছিল আওয়ামী লীগের বি টিমে আর জাসদের নামে লাখো তরুণ তখন বিভ্রান্ত হয়েছিল।  জিয়াউর রহমান এসে আদর্শের রাজনীতির জায়গাটা উল্টে দেন! ধর্ম আর অপ-জাতীয়তাবাদের মিশেলে রাজনীতির খিচুড়ি দিয়ে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি তিনি পুনরায় চালু করতে চেয়েছিলেন।  ইরানে ইসলামি আন্দোলন আর আফগানিস্তানে রাশিয়া বিরোধী জেহাদের ডাকও এদেশে ইসলামি আন্দোলনে কোনোরকম সাড়া জাগাতে পারেনি।  পুরনো দিন আর পুরনো শত্রুরা যেন বার বার ফিরে আসে।  ভয় ধরিয়ে দিয়ে যায় আত্মায়, চেতনারা মাথাকূটে মরে, অন্ধবিশ্বাস মানুষকে ফিরিয়ে নিতে চায় সেই মধ্যযুগে।  দুই দশক পরে আমেরিকায় এখন শুরু হয়েছে ট্রাম্প নামের এক উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা উম্মাদ নেতার শাসন।  কথিত অসাম্প্রদায়িক দেশ ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান চোখে পড়ার মতো!

ইউরোপ আমেরিকার মুসলিম দমন নীতি মুসলিমদের যখন অন্যভাবে ভাবিয়ে তুলছে তখন কোনও কোনও সংগঠন তাদের টানছে জঙ্গিবাদের ছায়াতলে।  কিন্তু এদেশের মানুষ শত শত বছর ধরে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সামনে এগিয়েছে।  তারা ধর্মভীরু হলেও মানবতাবাদী চেতনার সমর্থক।  এই যখন এদেশের মানুষের চেতনার মোমবাতি তখন সরকারি দলের হেফাজতের প্রতি এই নতুন আনুগত্য দেশটাকে ক্রমশ নিয়ে যাবে পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের পথে! 

ইলিশের প্রজনণ মৌসুমের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নববর্ষে ইলিশ না খেতে অনুরোধ করেছেন।  আসুন ডিম ভেজে পান্তাভাত খাই।  পান্তা ডিমকে আরও মজাদার করতে আসুন তার সাথে তেঁতুল মেশাই।

লেখক: রম্যলেখক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ