বিলেতে নতুন এসে সোশ্যাল সার্ভিসেস-এর কাজকর্ম সম্পর্কে বাঙালিদের মধ্যে একটা নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করলাম। তারা নাকি উপকারের চেয়ে মানুষের অপকারই করে বেশি। সাহায্য করার অজুহাতে সুন্দর সাজানো সংসারগুলো ভেঙে তছনছ করে দেয়। একটা উন্নত দেশের সরকারি একটা সার্ভিস সম্পর্কে এধরনের ধারণাকে খুব যৌক্তিক মনে হলো না, কিন্তু যারা এদেশে অনেক দিন ধরে আছেন, তাদের কথা বিশ্বাস না করে উপায় কী? তারপরও মনে হলো এক্ষেত্রে প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের ‘উপকার’, ‘অপকার’, ‘সাজানো সংসার’ আর ‘তছনছ’ এর ধারণার পার্থক্যের ওপরে নিশ্চয়ই অনেক কিছু নির্ভর করে। এ বিষয়ে আমার নিজের একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না অবশ্য।
এদেশে আসার তিনবছরের মাথায় আমার নিজের জীবনে সোশ্যাল সার্ভিসের হস্তক্ষেপের একটা ঘটনা ঘটে যা আমার জীবনকে কিছুদিনের জন্য হলেও তছনছ করে দিয়ে যায়। আমার ছেলের বয়স যখন দেড় বছর তখন একদিন লেটার বক্স দিয়ে টুপ করে পড়ে আমার নামে একটি বাদামী খামের চিঠি। সে যুগে বাদামী খাম মানেই ছিল জরুরি সরকারি চিঠি। দিনে দুইবেলা ডাকপিওন আসার সময়টাতে ঘড়িধরে লেটারবক্সের দিকে তাকিয়ে থাকতাম বাংলাদেশ থেকে মা-বাবা-ভাইবোনের চিঠির অপেক্ষায়। অথচ তার বদলে সেদিন এলো সরকারি তদন্তের এক অবিশ্বাস্য বার্তা।
চিঠির বক্তব্য ছিল এমন, ‘আমাদের কাছে খবর এসেছে যে তোমার বাচ্চাটি প্রায়ই অস্বাভাবিকভাবে কান্নাকাটি করে যা তোমার প্রতিবেশীদের জন্য বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে করা হচ্ছে যে তোমার বাচ্চাটি কোনও ধরনের নির্যাতন অথবা অবহেলার শিকার হয়ে থাকতে পারে। আমরা তোমার ঘরে এসে সরেজমিনে বিষয়টা তলিয়ে দেখতে চাই। যদি তোমার বাচ্চার সবকিছু ঠিক থেকে থাকে, তাহলে দুশ্চিন্তা করার কোনও কারণ নেই’। মাস দুই আগে ওপরের তলার প্রতিবেশীর সঙ্গে শব্দদূষণ বিষয়ে কিঞ্চিত বাকবিতণ্ডা হয়েছিল। আমাকে বিপদে ফেলার জন্য তারাই যে এই অভিযোগ করেছে এতে আমার কোনও সন্দেহ রইলো না। কিন্তু এখন আমি কী করবো? এই বিপদ থেকে কে আমাকে উদ্ধার করবে?
আমাদের বাসার একটা কামরা ভাড়া নিয়ে থাকতেন একজন ওয়েলশ উকিল। তিনিও বললেন এ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা না করতে, শেষ পর্যন্ত আমার বা আমার বাচ্চার কোনও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চিঠির শেষ লাইনটি অথবা আমাদের উকিল বন্ধুর আস্থাব্যঞ্জক কথাবার্তা আমাকে কিছুতেই আশ্বস্ত করতে পারলো না। এতোদিন ধরে পরিচিত বাঙালিদের মুখে শোনা নানান গল্প আগে থেকেই আমার মনে সোশ্যাল সার্ভিস সম্পর্কে জুজুবুড়ি টাইপ একটা ভয় সৃষ্টি করে রেখেছিল। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলাম চিঠিতে উল্লেখিত নিয়তি নির্দিষ্ট অপয়া তারিখটির জন্য। ছেলের দিকে তাকালেই বুক ফেটে কান্না আসে, ওকে কি তারা নিয়ে যাবে? আমার বয়স কম, ছেলের ভালোমন্দ অনেক কিছুই বুঝি না। মাত্র কয়দিন আগে হাতলভাঙা একটা হাঁড়ি দিয়ে খেলতে গিয়ে তার চোখের নিচটা খানিকটা কেটে গিয়েছিল। জিপি অর্থাৎ আমাদের পারিবারিক ডাক্তার আমাকে আচ্ছা করে বকে দিয়েছিল, ছেলের জেদ রাখতে অমন একটা বিপজ্জনক বস্তু দিয়ে তাকে খেলতে দিয়েছিলাম বলে। চোখের নিচের কালো দাগটা তখনো মুছে যায়নি। দু’দিন আগে বেড়াতে গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলার সময় ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিল, দেয়ালে ঠুকে যাওয়া কপালের অংশটুকু এখনো ফুলে আছে। তারা কি আমার এসব কথা বিশ্বাস করবে, নাকি ভাববে বানিয়ে বানিয়ে বলছি?
আমার ভয় কিছুটা হলেও সত্য প্রমাণিত হলো, কপালের ফুলে ওঠা জায়গাটা আর চোখের নিচের কালো দাগটাই তাদের চোখে পড়লো সবার আগে। এই অপরচিত লোকদের সামনেও আমার ছেলের আচরণ ছিল খুব প্রাণবন্ত কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে স্নায়বিক চাপে আমার জিহ্বা বারবার জড়িয়ে যাচ্ছিল। তারা আমাকে অন্যরুমে পাঠিয়ে দিয়ে আমাদের উকিল বন্ধুটির সঙ্গে একা কথা বললো কিছুক্ষণ। তারপর ডাক্তার ও হেলথ ভিজিটারের সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ করার পর আমার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবে জানিয়ে চলে গেলো।
দুইসপ্তাহ পর আমাকে অযথা কষ্ট দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে লেখা তাদের চিঠিটা হাতে পৌঁছার পর অনেক দিন পর আমি বুকভরে শ্বাস নিতে পারলাম। কিছুদিন পর যখন আমার ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হলো, সে দেখি সোশ্যাল সার্ভিসেসের ওপর ভীষণ ক্ষেপে আছে। বলে, তোমার মতো এতো অল্পবয়সে বাচ্চাকে এতো ভালো দেখাশোনা করতে আমি কম মা’কেই দেখেছি। হোয়াই আর দে বার্কিং আপ দ্য রং ট্রি?
তারপর টেমস নদীর বুক দিয়ে অনেক ঠাণ্ডা জল গড়িয়ে গেছে। আমার কাঁচা চুলে পাক ধরেছে। আর ভাগ্যক্রমে ধীরে ধীরে আমার কাজের ধারা মিলেমিশে গেছে সোশ্যাল সার্ভিসের কাজের সাথে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের জন্য দোভাষীর কাজ করার সুবাদে আমি তাদের কাজকে বুঝবার সুযোগ পেয়েছি। তাদের সাহায্যে অনেক শিশুকে যৌন শারীরিক ও আবেগিত নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে দেখেছি, অনেক নারীকে স্বাধীনতার আলোয় পা ফেলতে দেখেছি, অনেক নির্যাতককে শুধরে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেখেছি, অনেক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীর অধিকার সংরক্ষিত হতে দেখেছি।
ভুল বাঁশি যে মাঝে মধ্যে বাজে না তা নয় কিন্তু এরকম একটা সিস্টেম, যা নারী-শিশু-বৃদ্ধ-দুর্বলের ওপর সামান্য নির্যাতনের আভাসে ঢাল তলোয়ার নিয়ে হাজির হয়, একটা সমাজের জন্য কতটা শান্তির, নির্যাতিতদের জন্য কতটা স্বস্তির তা বুঝবার মতো বুদ্ধি বা ইচ্ছা আমাদের নেই। আমরা লাঠির ভাষা বুঝি, পঞ্চায়েত বুঝি, সিস্টেম দিয়ে অধিকার রক্ষার বিষয়টা বুঝি না। আমাদের মা-বাবারা বিদেশে এসেও বাচ্চাদেরকে পিটানোর অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে ব্যথিত হন। এখানেও আরবি শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিশুর আনা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ বিশ্বাস করতে প্রস্তুত নন অনেকেই। এ জাতীয় সমস্যাগুলোকে মহানন্দে ঝেটিয়ে কার্পেটের নিচে ঢুকিয়ে দেওয়ার সময়টাতেই যখন সোশ্যাল সার্ভিসের লোকেরা এসে হাজির হয়, তখন নিজের নোংরা মেঝের দিকে তাকিয়ে রাগটা নিবেদিত প্রাণ পেশাদারদের ওপরেই পড়ে। আমরা ময়লা পরিষ্কারে বিশ্বাসী নই, ময়লার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে বা তাকে ঢেকে রাখতেই আমাদের স্বস্তি।
আমি প্রায়ই স্বপ্ন দেখি আমাদের দেশেও একদিন এরকম একটা সিস্টেম চালু হবে যখন বন্ধ দরজার পেছনে দুর্বলরা সবলদের হাতে গোপনে নির্যাতিত হবে না। সামান্য নির্যাতনের আভাসে চারদিকে বাঁশি বেজে উঠবে, শিশুর আর দুর্বলের নিরাপত্তাই তখন হবে সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
লেখক: অভিবাসী শিক্ষক ও অনুবাদক