X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘তুই বেড়াল না মুই বেড়াল’

শেগুফতা শারমিন
২৭ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:১০আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:১৭

শেগুফতা শারমিন আচ্ছা, আর কারও কি বিষয়টা নজরে আসে? নাকি আমি একলাই বসে বসে ভাবি? ভাবি আর অবাক হই! কেন যেন মনে হয়, আমাদের সমাজ, আমাদের চারপাশের মানুষজন অনেক বেশি চরমপন্থী। যে কোনও বিষয়ে, যে কোনও ঘটনায়, যে কোনও পরিবর্তনে এই মানুষগুলো চরম নেতিবাচক অথবা চরম ইতিবাচক আচরণ করে। কোনও যুক্তি নেই, কোনও আগপিছ ভাবাভাবি নেই। না অথবা হ্যাঁ এর জোয়ারে গা ভাসিয়ে ভাসতে থাকে, ভাসকেই থাকে। এরাই আবার দ্বৈত আচরণও করে। যেমন, হয়তো চরম হ্যাঁ এর ঘরে বসে আছে। হঠাৎ কোনও এক ঘটনায় মনে করলো না বলা দরকার। তো সোজা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে চরম না হয়ে গেলো। মাঝখানের পথে কোনও নিয়মতান্ত্রিক ভাবাভাবি নেই।
শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী গরিব, উঁচু নিচু সবার ক্ষেত্রে এ অভ্যাস প্রযোজ্য। উদাহরণ দিয়েই তাইলে শুরু করি। মনে করেন, পহেলা বৈশাখ। বিন্দুমাত্র যাদের ইতিহাসের পাঠ আছে, সবাই জানেন, বাংলা সন তারিখের প্রবর্তক সম্রাট আকবর। ভারত বর্ষের ফসলপঞ্জীর সঙ্গে মিল রেখে এই বাংলা সন। ভারতবর্ষ মানেই, এই যুগে এসে স্বীকার করি আর না করি, এটা সত্য যে ভারতবর্ষ মানেই হিন্দু সংস্কৃতির ভুখণ্ড। এই ভূখণ্ডে বসবাসরত মানুষের ফসল তোলার মৌসুম, আচার আচরণকে মাথায়  রেখেই মুসলিম শাসকের বাংলা সনের প্রবর্তন। সোজা বাংলায় বললে এর সাথে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও নয়। তো দীর্ঘদিন পরাধীন থাকতে গিয়ে, বিজাতীয় শাসকের হাতে পড়ে সেই বাংলা দিন তারিখ এদেশের নব্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভুলতেই বসেছিল প্রায়। দশক যাবৎ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকা নাগরিক শ্রেণি ধীরে ধীরে আবার সেই প্রাচীন প্রথার নতুন আবাহন করে নগর সংস্কৃতিতে, নব্বইয়ের দশকে। ব্যাস এ পর্যন্ত দারুণ ব্যাপার। কিন্তু নিদারুণ হলো, মাত্র এক দশকের ব্যবধানে সেই পহেলা বৈশাখ নিয়ে শুরু হলো চরম মাতামাতি। খাওয়া-দাওয়া , কেনা-কাটার এক বিপুল যজ্ঞ। কোথা থেকে উড়ে এসে বৈশাখের ঘাড়ে জুড়ে বসলো আষাঢ়ের ইলিশ মাছ। কোরবানি ঈদের আগে যেমন খবর হয়, কোন হাটে কত দামের গরু। কে কত বড় কত দামী গরু কিনলো। আমাদের শেষ চৈত্রের দহন দিনে খবর হতে লাগলো, কোথায় কত দামের ইলিশ! হায় ইলিশ! হায় বৈশাখ! জনগণ মেতে  গেলো চরমভাবে বৈশাখী আনন্দে। সরকার বাহাদুরই বা বসে থাকেন কেন। জনগণকে সুবিধা দিতে যোগ হলো সরকারি কর্মচারীদের জন্য বৈশাখী বোনাস। বৈশাখ উদযাপনের চরম মাতামাতিতে আমরা ভুলতে বসলাম, সংক্রান্তির শাকান্নের কথা, নতুন বছর আসার আগে ঘর দোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে ধার দেনা শোধ করার কথা। বরং অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বৈশাখ পালন করতে হবে বলে বেড়ে চললো অনেকের ধার দেনা, এই সময়ে।

এরকম চরম গা ভাসানোর মুহূর্তে এলো নতুন তরিকা। যতটা না ধর্মীয়, ততটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সঙ্গে সঙ্গে দেখি এবাউট টার্ন। একশ্রেণির মানুষ এবার পড়লো, বিদাতী, শেরেকি নানারকম শব্দ নিয়ে। বৈশাখের মাতামাতি মফস্বলে কেমন হয়, অনুধাবন করার জন্য এবার ঢাকায় ছিলাম না। তো যথারীতি কিছু মানুষকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো যাদের মাথায় ঢুকে গেছে এইসব বিদাতী কাজ কারবার। মজার ব্যাপার হলো এরাই ছিল দু’বছর আগে পর্যন্তও বুঝে না বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে নতুন কাপড় কেনা, খানাপিনা করা সেই সব শ্রেণির মানুষ। তারা এবার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে বসে আছে।

ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখলাম, এক হুজুর বাঙালির ভবিষৎ নিয়ে খুব ‘চিন্তিত’। একসময় এধরনের বয়ান আমরা তথাকথিত শিক্ষিত নাগরিকেরা পাত্তা দিতাম না। কিন্তু এখন আমাদেরও চিন্তিত হওয়ার সময় এসেছে। কারণ এই সব বয়ানের শ্রোতা কিন্তু কম নয়, আর তারা এই বয়ানের প্রত্যেকটা শব্দ বিশ্বাস করে এবং অনুসরন করে। স্নোবলের মতো সেই বিশ্বাস বড় হয়, ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর। আমরা এক ধারণা থেকে আরেক ধারণায় উপনীত হই, কোনও কার্যকারণ বিশ্লেষণ ছাড়াই।

যেই কার্যকারণ ছাড়াই দেখি, পোষাক থেকে ধর্ম এরকম অন্য সব বিষয়ে চরম অবস্থান। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, এদেশে ধর্ম একটি সামাজিক আচার। দৈনন্দিন জীবন যাপনেরই একটা অংশ ধর্ম। এদেশের ইতিহাসও এই স্বাক্ষ্যই দেয়, যে অতি ধার্মিক এই ভূখণ্ডের মানুষ কখনোই ছিল না। সেই দেশে এখন ধর্ম নিয়েও দুই দল। এক দল অতি বিশ্বাসী, আরেকদল অতি অবিশ্বাসী। মাঝখানে যারা এখনো মধ্যপন্থার, তারা বিপদে। পেছন ফিরে যতদূর দেখতে পাই, দেখি আমাদের মা, নানী, দাদি বা তারও আগের আত্মীয়াদের পোষাক ছিল শাড়ি। সেই পুরনো আমলের স্টুডিওতে তোলা তাদের এক কপি সাদাকালো ছবিতে দেখা যায়, কেউ হয়তো আলগোছে, আঁচলটা মাথায় তুলেছেন, কেউ বা তোলেননি। তাতে কিন্তু কিছু এসে যায়নি। অথচ এখন পোষাক নিয়েও চরমপন্থী আচরণ। প্রথমত, শাড়ি নাকি সঠিক পোষাক নয়। এই বলে এক দলের শাড়ির বিকল্প নিয়ে মাতামাতি। সে সালোয়ার কামিজ হোক বা প্যান্টস টপ। সঙ্গে মাথায় কাপড়ের টোপর। শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউ বাদ পড়ে না। আরেক দল উঠতে বসতে এই পোষাকের সমালোচনা। তারাও আরেকধরনের পোষাকের পৃষ্ঠপোষক, যা কিনা যদিও কোনদিনই আমাদের সংস্কৃতিতে ছিল না। কিন্তু আধুনিকতা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রকাশ ঘটানোর জন্য সেইসব পোষাক যেন তাদের একটা মাধ্যম। মাঝখান থেকে শাড়ির ত্রাহি অবস্থা।

এই যে রশি টানাটানি, দুই পাশের দুই চরমপন্থী দলের, যার কোনোটাই আমাদের শেকড়ের সঙ্গে যায় না, ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না। তারপরও টানাটানি চলছে, জোড়গলায়। তুই বেড়াল আর মুই বেড়ালের। মাঝখান থেকে নষ্ট হচ্ছে মানুষের মান, নষ্ট হচ্ছে স্বকীয়তা। আর একবার যখন মান পড়ে যাবে, তখন যেকোনও কিছু ফেলে দেওয়া খুব সম্ভব। যার সবচেয়ে নিকটতম উদাহরণ দেখা গেলো, থেমিসিস বিতর্ক নিয়ে। থেমিসিস থাকবে কী থাকবে না। এই প্রশ্নটা রাজনৈতিক। কিন্তু সমাধানের জন্য শেষ পর্যন্ত খুব চাতুরতার সাথে নিয়ে আসা হলো মানের প্রশ্ন। নিঃসন্দেহে মানের প্রশ্নে হাইকোর্টের সামনের থেমিস নিম্নশ্রেণির।  যে দেশে জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে শুরু করে অপরাজেয় বাংলা, সোপার্জিত স্বাধীনতা, রাজু ভাস্কর্যর মতো দারুণ সব স্থাপত্য বা ভাস্কর্য রয়েছে। এরকম ভাস্কর্য গড়ার মতো শিল্পী রয়েছে, সেই দেশে গ্রামের  মেলার মাটির খেলনার মান অতিক্রম করতে না পারা মৃণাল হকের তৈরি ভাস্কর্য দিয়ে ঢাকা শহর ভরে গেছে। মানের প্রশ্নে মৃণাল হক কখনোই পাস নাম্বার পাবেন না। নিশ্চিত। সেই মানহীন জিনিস তৈরি করার পর অপসারণও সহজ। মানের বিষয় সামনে এনে কিভাবে একটা রাজনৈতিক প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেলো! কে জিতলো, কে হারলো? সহজেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাওয়ার আগে, চরম অবস্থান নিয়ে ফেলার আগে এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। মূলটা ধরে রাখার শিক্ষা, মানটা ধরে রাখার শিক্ষা। 

তা না হলে শেষ দানে দড়ি ঢিলা হয়ে দুই পক্ষেরই কিন্তু মাটিতে গড়াগড়ি খেতে হবে।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ