X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষমতার স্বার্থে স্বাধীনতা খর্ব

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৩ মে ২০১৭, ১৩:০৫আপডেট : ০৩ মে ২০১৭, ১৩:১২

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা রাষ্ট্র এবং করপোরেটের চাপ, পেশাজীবীদের মাঝে রাজনৈতিক বিভক্তি, ক্ষমতার অপব্যবহার, ধর্মীয় উগ্রবাদের বিকাশ, মিডিয়ার আপস, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সামনে এমনসব বিস্তর বাধার মাঝেই আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস আবার উপস্থিত আমাদের সামনে।
বিশ্বব্যাপী ৩ মে এই দিবস পালনের চল শুরু হয়েছে ১৯৯৩ সালে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা, ইউনেসকো দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। এ বছরের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘সংকটকালে সমালোচকের মন: শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা।
প্রতি বছরই সাংবাদিকদের নানা সংগঠনতো বটেই, একাডেমিক পর্যায়েও ব্যাপক আলোচনা হয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা অন্য কথা বলে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আইনগতভাবে মুক্ত গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ কম। কখনও রাজনৈতিকভাবে, কখনও ব্যবসায়িক, আবার কখনও ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার অজুহাতে গণমাধ্যমের স্বাধীন মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ফ্রিডম হাউস বলছে যে ১৩ বছরের মধ্যে ২০১৬-তে বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন সবচেয়ে কম। বিশ্বে এখন মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ মুক্ত সাংবাদিকতার সুফল ভোগ করছেন। ফ্রিডম হাউসের ভাষায় যেখানে রাজনৈতিক সংবাদ বলিষ্ঠ, সাংবাদিকদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি আছে, গণমাধ্যমের কাজে রাষ্ট্র নাক গলায় না এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান আর্থিক বা আইনগত চাপের মুখে থাকে না, সে রকম পরিবেশই হলো মুক্ত গণমাধ্যমের পরিবেশ।

বাংলাদেশে সব দল ও মতের নেতারা সাংবাদিকদের সবসময় নানা উপদেশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু সব সময়ই আবার তারা রাষ্ট্র ও দলীয় ক্ষমতাকে সম্পাদক বা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকেন। ধর্মান্ধ উগ্রবাদী গোষ্ঠী যখন একের পর এক লেখক ও ব্লগারকের হত্যা করেছে, তখনও রাজনৈতিক গোষ্ঠী নতজানু আচরণ করেছে। এ দেশের আইনে ব্যবসায়ীদের গণমাধ্যম চালানোয় কোনও বাধা নেই। এর ফলে, ধরা যাক, কোনও একটি গণমাধ্যমে নেতা বা দলের বিরুদ্ধে কিছু প্রচার বা প্রকাশিত হলে,  সেই কাগজের মালিক ভয়ে থাকেন তার বাকিসব ব্যবসা নিয়ে। আপাত দৃষ্টিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো স্বাধীন। কারণ এখানে নানা ধরনের সমালোচনাসহ অনেক কিছু বলা যাচ্ছে। কিন্তু যে জায়গায় এসে এ স্বাধীনতা খর্ব হয়ে যাচ্ছে তা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকতা।

যারা নিজেদের উদ্যোগে সাংবাদিকতা করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই বিপদ অতি প্রবল, বিশেষত রাজধানীর বাইরের দূরবর্তী অঞ্চলসমূহে। জাতীয় সংবাদমাধ্যমের নাগাল ও নজর থেকে তারা অনেক দূরে থাকায় যে পরিবেশে তাদের সাংবাদিকতা করতে হয় তা ভয়ঙ্কর। খুন, জখম, নির্যাতন, মামলা দিয়ে হয়রানি স্বাভাবিক সব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং যে সুশীল সাংবাদিক সমাজ, রাজধানীতে বসে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট উপভোগ করছে, তারা শুধু বিবৃতির মধ্যেই দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। কত সাংবাদিক খুন হলেন, কিন্তু সম্পূর্ণ বিচার হয়নি একটিরও।  

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখনও সংগঠন পর্যায়ে আছে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যেতে পারেনি। বেশিরভাগ মিডিয়া হাউসেরই কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই। লাইসেন্স বা ডিক্লারেশন নিয়ে দরজা খোলা হয় একটি গণমাধ্যমের, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার প্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়ে ভাবা হয় না। একই মালিকের একটি গণমাধ্যম যখন রুগ্ন, বেতন ভাতায় অনিয়ম, সার্ভিস বেনিফিট বলতে কিছু নেই, সাংবাদিকদের চাকরির অনিশ্চয়তা, তখন তার অন্য ব্যবসায় দেখা যায় সবকিছু ঠিক আছে। এখানে ঝুঁকি অনেক বেশি। কোনও সংবাদকর্মী যদি কোনোভাবে বড় ধরনের কোনও ঝুঁকির মোকাবিলা করে সেখানে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে কোনও সহযোগিতাও করা হয় না।

রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলগুলো সাংবাদিকদের ওপর বলপ্রয়োগ করে, তাদের দমন করে অথবা নানা ভাবে তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, এবং করেও। রাজনৈতিক পর্যায়ে সহনশীলতার অভাব বরাবরই। এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো স্বভাবগতভাবেই অসহিষ্ণু। তারা কেবল ভাবে তাদের পক্ষে কথা বলতে হবে। বিপক্ষে গেলেই তারা সাংবাদিকদের প্রতি মারমুখী আচরণ করে। রাজনীতিকদের মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায় ব্যবসায়ীরাও। গণমাধ্যমগুলোর বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতা থাকায় প্রকাশের স্বাধীনতা বড়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনৈতিক বাণিজ্য করলেও তাদের সমালোচনা করা চলে না, কারণ তা হলে তারা বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দেবে। বহু বড় বাণিজ্যিক সংস্থা সেই সব চ্যানেল বা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করেছে যেখানে তাদের সমালোচনাসূচক কিছু প্রচারিত হয়েছে।

মত প্রকাশের পথে আরেকটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন পেশিজীবিরা নিজেরাই। রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে লেখক-সাংবাদিক-শিল্পীদের নিজেদের নিশ্চয়ই দৃঢ় মত রয়েছে। কিন্তু আমরা যখন নিজের স্বাধীনতাকে কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে বন্ধক দেই তখন আর বের হওয়ার পথ থাকে না। বাংলাদেশে লেখক, সম্পাদক এবং বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত। এর ফলে তথ্য চেপে দেওয়া বা মতামতকে বিকৃত করার প্রবণতা বাড়ছে। দলীয় সংসর্গের কারণে অনেক সময় দেখা যায়, প্রতিবাদীরা বেছে বেছে কিছু বিষয়ে সরব হলেও অন্য ক্ষেত্রে তারা নীরব।

স্বাধীনতার জন্য এদেশের সংবাদ কর্মীদের নিরন্তর লড়াই করতে হয়। স্বাধীনতা যতটুকু রয়েছে তা মূলত মালিকদের, এখানে সাংবাদিকদের কোনও স্বাধীনতা নেই। মালিকদের পছন্দই বড় পছন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এখন তাদের মতো করেই সাংবাদিকদের সাংবাদিকতা করতে হয়। রাজনৈতিক কারণে সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভক্তির ফলে সাংবাদিকদের কোনও অধিকার যেমন রক্ষা হচ্ছে না, তেমনি পেশাদারিত্বের জায়গায় দেখা দিয়েছে ভয়ঙ্কর সংকট। প্রাতিষ্ঠানিকতা বলতে কিছু না থাকায় এ মুহূর্তে বাংলাদেশে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা সাংবাদিকতা।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতীয় শাড়ি দিয়ে কাঁথা সেলাই করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে রিজভী
ভারতীয় শাড়ি দিয়ে কাঁথা সেলাই করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে রিজভী
স্বাধীনতার মর্মার্থকে অকার্যকর চায় বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
স্বাধীনতার মর্মার্থকে অকার্যকর চায় বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
খিলগাঁওয়ে রিকশাচালকের মরদেহ উদ্ধার
খিলগাঁওয়ে রিকশাচালকের মরদেহ উদ্ধার
ইউনূস সেন্টার মিথ্যাচার করেছে, অভিযোগ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
ইউনূস সেন্টার মিথ্যাচার করেছে, অভিযোগ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ