X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পের অভিশংসন সময়ের ব্যাপার মাত্র!

আনিস আলমগীর
২৩ মে ২০১৭, ১৩:৩১আপডেট : ২৩ মে ২০১৭, ১৪:১৬

আনিস আলমগীর গির্জায় গির্জায় এক সপ্তাহব্যাপী প্রার্থনা করে ঈশ্বরের করুণা ভিক্ষা করেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মনে হয় অভিশংসন থেকে আর রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এমন নির্বোধ প্রেসিডেন্ট মনে হয় হোয়াইট হাউসে আর আসেনি। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি, প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সময় ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি আর ক্লিনটনের সময় মনিকা লিউনিস্কি কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয়েছিলো। তারা সতর্কতার সঙ্গে সব কিছুকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
নিক্সন নিজেকে বাঁচানোর জন্য পদত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। যে কারণে তিনি অভিশংসন থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। কিন্তু রিগ্যান আর ক্লিনটন খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যথাক্রমে ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি ও মনিকা লিউনিস্কি কেলেঙ্কারি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যে, রেইনকোট না পরেও শরীরটাকে প্রবল বর্ষণ থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। মূলত মার্কিন ইতিহাসে ১৮৬৮ সালে অ্যান্ড্রু জনসন এবং ১৯৯৮ সালে বিল ক্লিনটন হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস দ্বারা অভিশংসিত হলেও পরে সিনেটের ট্রায়ালে চূড়ান্ত বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এখনও কোনও প্রেসিডেন্ট অভিংশসিত হননি।
আমেরিকানরা বহু অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলে কিন্তু একটা সৎ গুণ তাদের আছে। কোনও প্রেসিডেন্ট কোনও অপরাধ করে বসলে সে কোন দলের প্রেসিডেন্ট তা না দেখে কংগ্রেস সদস্যরা অপরাধ নির্ণয়ে খুবই সচেতনতার প্রমাণ রাখার চেষ্টা করেন। দলীয় পরিচয়টাকে তখন তারা মূখ্য হিসেবে বিবেচনা না করে প্রেসিডেন্টের পদটাকে কলঙ্কমুক্ত রাখার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেন। সুতরাং কংগ্রেসে দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও কোনও অপরাধ করলে তার থেকে উত্তরণ প্রেসিডেন্টের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

নিক্সন যখন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য পদত্যাগ করেছিলেন তখন কিন্তু কংগ্রেসে রিপাবলিকান দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। অথচ ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিটা ছিল একটা সাধারণ ঘটনা। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যা সব সময় হয়ে থাকে। ওয়াটারগেট হোটেল ছিল ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর প্রচার কেন্দ্র। নিক্সন ছিলেন রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। তিনি গোপনে যন্ত্র বসিয়ে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থীর নির্বাচনি কৌশলের তথ্য সংগ্রহ করতেন।

নিক্সন দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক বেন ব্রাডলি এই খবর সংগ্রহ করে তথ্যসহ তার পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। এ খবরকে ভিত্তি করে নিক্সন এর অভিশংসন প্রস্তাব কংগ্রেসে পাস হওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। বেন ব্রাডলি বলতেন পরিণতির বিষয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে সত্যকে সৎভাবে প্রকাশ করাই সাংবাদিকের দায়িত্ব।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে যে তিনি নির্বাচনে রাশিয়ার সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। সর্বশেষ অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে যে রাশিয়া আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে অর্থ প্রদান করেও সাহায্য করেছিলো। সবগুলোই গুরুতর অপরাধ। অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিশংসন অবধারিত। ট্রাম্পের প্রচার দলের সঙ্গে রাশিয়ার নাকি অব্যাহত যোগাযোগ ছিল।

এখন আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এফবিআই-এর সাবেক প্রধান রবার্ট মুলারকে বিশেষ কৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে। তার নিয়োগের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় বলেছে, কোনও অপরাধের সুনির্দিষ্ট তথ্য এসে গেছে, তড়িৎ বিচার শুরু করতে হবে তা নয়- তবে এমন কিছু তথ্য হাতে আসার আশঙ্কাকে নাকচ করা যাচ্ছে না। রবার্ট মুলারকে আইন মন্ত্রণালয় নিয়োগ দিলেও তাকে কাজ করতে হবে সহকারি এ্যাটর্নি জেনারেল অধীনে। তবে আমেরিকার আইন অনুসারে বিশেষ কৌশলীর ক্ষমতা অসীম। বিশেষ কৌশলী নিয়োগের দাবি তুলেছিলো ডেমোক্র্যাট দলীয় কংগ্রেসম্যানেরা। এতে রিপাবলিকেনেরা কোনও আপত্তি উত্থাপন করেননি।

হঠাৎ করে বিশেষ কৌশলী নিয়োগের প্রেক্ষাপট কী? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হঠাৎ করে এফবিআই-এর প্রধান জেমস কোমিকে বরখাস্ত করেছেন। ট্রাম্প তার সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল মাইকেল ফ্লিনের বিরুদ্ধে এফবিআইয়ের চলমান তদন্তের বিষয়ে এমন সব ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যা বিচার কাজে বাধা দান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিশেষ কৌশলী নিয়োগের এটা অন্যতম কারণ। এর আগে, গত ফেব্রুয়ারিতে এফবিআই প্রধান কোমির সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তখন তিনি কোমিকে বলেন, ফ্লিন একজন ভালো মানুষ। আশা করি আপনি ফ্লিনের বিষয়ে তদন্ত থেকে সরে আসবেন কিংবা তাকে মুক্তি দেবেন। কোমি সেই প্রস্তাব রাখেননি। ট্রাম্প অনুরোধ করার পর বৈঠক শেষেই একটি নথিতে এই তথ্যটি লিখে রেখেছিলেন কোমি।

জেনারেল মাইকেলর ফ্লিন ওবামার সময়ে ডিফেন্স ইন্টিলিজেন্স এজেন্সির প্রধান ছিলেন। ২০১৪ সালের ওবামা প্রশাসন তাকে বরখাস্ত করে। জেনারেল ফ্লিনের সঙ্গে রাশিয়ার যোগাযোগের বিষয়ে সবাই অবহিত ছিলেন কিন্তু তিনি যে নির্বাচনের আগে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা বলেছিলেন সেটা জানা যায় তার নিয়োগের পরে। জানুয়ারি মাসে এফবিআই তদন্তের জন্য হোয়াইট হাউসে মাইকেল ফ্লিনের সাক্ষাৎকার নেয় এবং সহকারি এ্যাটর্নি জেনারেল স্যালি ইয়েটস হোয়াইট হাউসের আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করে জানান যে, জেনারেল ফ্লিনের সঙ্গে রাশিয়ার যোগাযোগের প্রমাণ আছে।

এরপর হঠাৎ করে সহকারি এ্যাটর্নি জেনারেল ইয়েটসকে বরখাস্ত করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। অথচ তার বরখাস্তের অজুহাত হিসাবে দেখানো হয় যে সাত মুসলিম দেশের নাগরিকদের যাতায়াতের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার শুনানিতে আদালতে সরকার পক্ষে না দাঁড়ানোর জন্য তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সহকারি এ্যাটর্নি জেনারেল ফ্লিনের বিষয়ে অবহিত করেছিলেন জানুয়ারি মাসে অথচ হোয়াইট হাউস অবহিত হওয়ার পরও ফ্লিনের বরখাস্তের ব্যাপারে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তাকে অপসারণ করতে কালক্ষেপণ করা হয়েছিলো অহেতুক কারণে।

এফবিআই প্রধান কোমি আইন প্রণেতাদের কাছে উপস্থিত হলে তারা জিজ্ঞেস করেছিলেন রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে ট্রাম্প সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কিনা? সরাসরি না উত্তর প্রদান না করলেও কোমির ইতস্ততায় বুঝা যায় যে ট্রাম্প সাফ সুতরে তেমন কিছু নন। এটিই কোমিকে বরখাস্তের অন্যতম কারণ বলে সবাই ধরে নিয়েছেন। অথচ হোয়াইট হাউস বলেছে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারির ইমেইল এর ব্যাপারে তদন্তে গাফিলতির কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

কোমিকে ফ্লিনের ব্যাপারে তদন্ত না করতে বলা হয়েছিলো। এটা কিন্তু বিচারে বাধা দান এর মতো গুরুতর অপরাধ। গত সপ্তাহে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রদূদের সঙ্গে ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বৈঠকের সময় ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে রাশিয়াকে নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছে সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ল্যাভরভের কাছে কোমিকে পাগল আখ্যায়িত করেন। ট্রাম্প স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেছেন যে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস্ সাক্ষাৎকারের এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান, রিচার্ড নিক্সন এবং বিল ক্লিনটনের উপদেষ্টা ডেভিড গারগেন বলেছেন, ফ্লিনের রাশিয়ার সঙ্গে যোগসাজশের বিষয়ে তদন্ত বন্ধ করার অনুরোধ এবং রাশিয়ার কাছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তথ্য ফাঁসের ঘটনা যদি সত্য হয় তাহলে তিনি অভিশংসনের শিকার হওয়ার কাজ করেছেন।

এদিকে এফবিআই-এর সাবেক প্রধান কোমি মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয় নিয়ে সিনেট ইন্টিলিজেন্স কমিটির একটি উন্মুক্ত সভায় উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হয়েছেন। এ যাবৎ সংগৃহীত তথ্য মতে দেখা যাচ্ছে নির্বাচনের পূর্বের ৭ মাসে ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের সঙ্গে ক্রেমলিনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ১৮ বার যোগাযোগ হয়েছে। এর মাঝে ৬টি ফোন কলের রেকর্ড গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে।

রাশিয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তার নির্বাচনের সময় সাহায্য করেছে এ কথা এখন আমেরিকার মানুষের কাছে এক মুখরোচক আলোচনা। আমেরিকার বিখ্যাত সাময়িকী টাইমস তার এ সপ্তাহের প্রচ্ছদ (১৮ মে ২০১৭) দিয়েছে প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউসের একাংশ ঢেকে যাচ্ছে মস্কোর রেড স্কয়ারের সেন্ট বাসিল ক্যাথিড্রালে। হোয়াইট হাউসের ওপরিভাগে শোভা পাচ্ছে বিখ্যাত ‘ওনিয়ন ডোম’ বা পেয়াজ আকৃতির গম্বুজ। এ নিয়ে জোর আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অবশ্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার গোপন আঁতাতের অভিযোগকে ভিত্তিহীন এবং ‘পলিটিক্যাল সিজোফ্রোনিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন।

টাইমস-এর এই উদ্যোগকে সাহসী ও সময় উপযোগী বলে বলছেন অনেকে। গণমাধ্যম বিশেষ করে ‘টাইমস’-এর মতো প্রভাবশালী সাময়িকী যখন সত্য উদঘাটনে তৎপর হয়েছে তখন ট্রাম্পের অভিশংসন মনে হয় সময়ের ব্যাপার মাত্র।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব: নেতানিয়াহু
আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব: নেতানিয়াহু
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
ঝালকাঠিতে নিহত ১৪ জনের পরিবার পাচ্ছে ৫ লাখ টাকা করে
ঝালকাঠিতে নিহত ১৪ জনের পরিবার পাচ্ছে ৫ লাখ টাকা করে
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ