X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

টাকা বালিশে রাখুন

আমীন আল রশীদ
০৫ জুন ২০১৭, ১৪:৪৩আপডেট : ০৫ জুন ২০১৭, ১৭:২০

আমীন আল রশীদ একজন স্কুল শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পর কল্যাণ তহবিল থেকে চার লাখ টাকা পেলেন। সেই টাকা দিয়ে ধারদেনা শোধ করলেন। বছর দুয়েক নীলক্ষেতে ব্যানবেইস অফিসে ঘুরে ঘুরে, কয়েক জোড়া জুতার তলা ক্ষয় করে, একে-ওকে ধরে, তদবির করে, কিছু ঘুষপাতি দিয়ে অবসর ভাতার লাখ বিশেক টাকা পেলেন। এখন সেই টাকা দিয়ে গ্রামের ভাঙাচোরা ঘরটুকু মেরামত করা, ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়া, এবং নিজের হার্টের চিকিৎসার পর যে কয়েক লাখ টাকা বেঁচে গেলো, ভাবলেন সেই টাকাটা ব্যাংকে গচ্ছিত রাখবেন এবং সেখান থেকে মাসে মাসে যা মুনাফা আসবে, তা দিয়ে কোনোমতে চলবেন। কিন্তু মাস্টার মশাইয়ের এই সামান্য সুখটুকুও সরকারের সইছে না। কারণ ব্যাংকে টাকা রাখলে মুনাফা তো দূরে থাক, সরকার আবগারি শুল্ক হিসেবে উল্টো কেটে নেবে ৮০০ টাকা।
সরকার চায় কেউ ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত না রাখুক। কিন্তু অর্থ বিনিয়োগ করলেই কি ব্যবসা নিশ্চিত? রয়েছে জ্বালানির সংকট; নিরাপত্তা ও ভরসার অভাব। তাছাড়া সবার পক্ষে ব্যবসা করাও সম্ভব নয়। সবাই ব্যবসা জানে না। সবার ব্যবসার মানসিকতা নেই। আমরা যে শিক্ষকের কথা বলছি, সারা জীবন তিনি ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়েছেন। সাহিত্য বা ইতিহাস পড়িয়েছেন। ব্যবসার কায়দা-কানুন তার শেখা হয়নি। ফলে অবসরে যাওয়ার পরে নানা কষ্ট করে যে টাকা পেয়েছেন, সেই টাকা দিয়ে যে নিজের শহরে কোনও ব্যবসা শুরু করবেন, তার কোনও কৌশলই তার জানা নেই।
তিনি কী ব্যবসা করবেন? সেই ব্যবসা আরও অনেকে অনেক বেশি মূলধন খাটিয়ে করছেন। মাস্টার মশাই কি মুদির দোকান দেবেন? দোকানে বাকি পড়ে যাবে। বাকির টাকা ওঠানোর জন্য কাস্টমারের সঙ্গে যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করতে হবে, সেই বিদ্যাও তার নেই। তিনি কি দুটি অটোরিকশা কিনে ভাড়ায় চালাবেন? চালক তাকে ঠিকমতো ভাড়া দেবে না। দুমাস পরে মাস্টার মশাইয়ের মনে হবে, ‘পরিবহন ব্যবসা কোনও ভদ্রলোক করে না’। তাহলে এই শিক্ষকের জন্য বাকি থাকলো কী? বাকি থাকে ব্যাংক- যেখানে তিনি টাকা রেখে নিরাপদ বোধ করতে চান এবং সেখান থেকে কিছু মুনাফা এলে তাতেই তিনি খুশি। কিন্তু সরকার বাহাদুর তা চায় না। সরকার চায় গরিব আর মধ্যবিত্তরা আরও বেশি কর দিক। আরও বেশি মূসক দিক। কিন্তু যারা লুটপাট করে টাকা বানায়, যারা বিদেশে অর্থ পাচার করে, তাদের ব্যাপারে সরকার কী করবে বা করছে কিংবা করতে পারবে তা পরিষ্কার নয়। বরং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকারের মূল টার্গেট সাধারণ মানুষ- যারা কষ্ট করে পয়সা আয় করে এবং সেখান কিছু অল্প অল্প কিছু সঞ্চয় করে ভবিষ্যতের জন্য।

সরকার চায় মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে বিনিয়োগ করুক। কিন্তু কোথায় বিনিয়োগ করবে? শেয়ার বাজার ধ্বংস করা হয়েছে। সেটি এখন আক্ষরিক অর্থেই ফটকাবাজির বাজার। অন্য কোথায় বিনিয়োগ করবে? যেকোনও ব্যবসা শুরু করতে গেলে ট্রেড লাইসেন্স থেকে শুরু করে প্রতিটি পদে যে হয়রানি, রাজনৈতিক দল, ক্যাডার ও পুলিশকে যেভাবে চাঁদা দিতে হয়, জ্বালানির যে সংকট-সব মিলিয়ে কোন ব্যবসায় নেমে মানুষ নির্ভার বোধ করবে? রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ব্যবসায়ীরা অর্থ চায় না, চায় ভরসা। তো সেই ভরসা কি সরকার দিতে পারছে? জ্বালানির ভরসা, নিরাপত্তার ভরসা, শান্তিতে এবং নির্ঝঞ্ঝাটে ব্যবসা করার ভরসা কি সরকার দিচ্ছে? দিচ্ছে না বা দিতে পারছে না। কিন্তু কেউ এক লাখ টাকা ব্যাংকে রাখলে সেখান থেকে ৮০০ টাকা কেটে নেওয়ার বাহাদুরি তার আছে। আবার ব্যাংকের দেওয়া সুদের ওপর আরও ১৫ শতাংশ উৎসে কর কাটা হবে।

যদিও বাজেট ঘোষণার পরদিন অর্থমন্ত্রী তার নিয়মতান্ত্রিক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ব্যাংকে যিনি এক লাখ টাকা রাখতে পারেন, তিনি দরিদ্র নন এবং তিনি ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে পারেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের সম্ভবত জানা নেই, একজন সামান্য আয়ের লোকও মাসে এক হাজার টাকা করে ব্যাংকে রেখে কয়েক বছরপর এক লাখ টাকার মালিক হতে পারেন। তার অর্থ কি এই যে, অর্থমন্ত্রী তাকে মধ্যবিত্ত বা উচ্চআয়ের লোক বলবেন? যে লোক বহু কষ্ট করে মাসে এক দুই হাজার টাকা ব্যাংকে জমা রেখে এক বা দুই লাখ টাকার মালিক হলেন, সেই টাকায়ও কেন আবগারি শুল্ক বসাতে হবে? অর্থমন্ত্রীর দাবি, অর্থনীতিতে সমতা আনার জন্যই আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ গরিবের পকেট কেটে অর্থনীতিতে সমতা আনা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, আমানতের টাকার ওপর আবগারি শুল্ককর আরোপের বিষয়টি শুল্কনীতির মধ্যেই পড়ে না। এটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষতিকর। বিশ্বের কোথাও এমন নজির নেই। তার মতে, বড় ধরনের সংস্কার না করে শর্টকার্ট পথে রাজস্ব সংগ্রহের উপায় যুক্তিসঙ্গত কর নীতির আওতায় পড়ে না।

তাহলে মানুষ এখন কী করবে? ব্যবসায় ভরসা পাবে না। ব্যাংকে লাভ পাবে না। সুতরাং সে কি এখন টাকা পাচার করবে? একজন শিক্ষক সারা জীবন যে নীতি আদর্শের কথা পড়িয়েছেন তার ছাত্র-ছাত্রীদের, তিনি এখন তার অবসরে পাওয়া টাকাটা কী করবেন? মাটির ব্যাংকে টাকা রাখবেন? হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে চালান করে দেবেন নাকি বনখেকো ওসমান গনির মতো বালিশের ভেতরে গুঁজে রাখবেন?

সরকার এই আবগারি শুল্কটাও বরং ব্যক্তির করমুক্ত আয়ের সীমার মতো নির্দিষ্ট করে দিতে পারত। অর্থাৎ এখন যেমন আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যক্তিগত আয় করের আওতামুক্ত, সেভাবে ব্যাংকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত গচ্ছিত রাখলে সেটি আবগারি শুল্কের আওতামুক্ত রাখতে পারতো। কিন্তু সরকার সে পথে যায়নি। সে চায় সাধারণ মানুষ তার কষ্ট অর্জিত টাকার ওপরে আরও বেশি কর দিক। আরও বেশি ভ্যাট দিক।

প্রশ্ন হলো, সরকার কেন সাধারণ মানুষের উপরেই করের বোঝা চাপায়? যে সম্পদশালীরা কর ফাঁকি দেয়, জনগণের পয়সায় পরিচালিত ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে মেরে দেয়, তাদের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী বলেন, হাজার কোটি টাকা কিছুই না। অথচ একজন স্বল্প আয়ের মানুষ তিল তিল করে কিছু পয়সা জমিয়ে এক লাখ টাকার মালিক হলেই অর্থমন্ত্রী তাকে বলছেন সম্পদশালী এবং তার ওপরে ধার্য করছেন আবগারি শুল্ক, এটা কোনও জনকল্যাণমুখী বাজেটের উদাহরণ হতে পারে না। বলা হয়, শক্তের ভক্ত নরমের জম। সাধারণ মানুষের যেহেতু ক্ষমতা নেই, সুতরাং ইচ্ছেমতো তাদের ওপরে সরকার কর বসায়, কারণ সে জানে যে, এই টাকা আদায় করা সহজ। কিন্তু ক্ষমতাবানরা লুটপাট করে দেশ শেষ করে দিলেও তাদের ধরার মুরদ নেই।  

একদিকে উন্নয়নের নামে জনগণের অর্থ লুটপাট হবে, অন্যদিকে সেই জনগণের কষ্টে অর্জিত টাকার ওপরে সরকার নানাবিধ কর বসাবে, এটা কোনও জনবান্ধন নীতি হতে পারে না। বরং জনগণের করের পয়সায় যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে, সেখানের লুটপাট বন্ধ করা গেলে, বরাদ্দ অর্থের অন্তত ষাট শতাংশ টাকার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের চেহারাই বদলে যেতো। বাংলাদেশে রাস্তা আর ফ্লাইওভার নির্মাণের খরচ উন্নত বিশ্বের চেয়েও বেশি। অথচ কাজের মান অনেক গরিব দেশের চেয়েও খারপ, এর অর্থই হলো এখানে উন্নয়নের নামে বস্তুত একটি চক্র জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করে। সেই টাকার ভাগ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যায় বলেই এর কোনও বিহীত হয় না। বরং লুটেরারা লুটপাট করবে আর একজন স্কুলমাস্টার তার সারা জীবনের সঞ্চয় থেকেও সরকারকে আবগারি শুল্ক দেবে-এটাই নাকি অর্থনৈতিক সাম্য! 

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ