X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইরানে মধ্যপন্থীদের জয় হোক

আনিস আলমগীর
০৬ জুন ২০১৭, ১৩:৩৩আপডেট : ০৬ জুন ২০১৭, ১৫:৫২

আনিস আলমগীর ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হয়েছে। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ইরানের শাসনতন্ত্র অনুসারে ৫০ শতাংশের কম ভোট ফেলে দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হয় কিন্তু হাসান রুহানি ভোট পেয়েছেন ৬২ শতাংশ। সুতরাং দ্বিতীয় দফা ভোটের আর প্রয়োজন হয়নি।
আকবর হাসমি রাফসানজানি, মোহাম্মদ খাতামি, হাসান রুহানি এ তিনজনই রক্ষণশীল ঘরানার লোক নন। তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে উদার পথে ইরানকে পরিচালনার চেষ্টা করেছেন। প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সময় ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারীর কারণে জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হলেও ইরানের কাছে আমেরিকান প্রশাসনের উচ্চ স্তরের কর্মকর্তারা গোপনে অকাতরে অস্ত্র বিক্রি করেছিলেন। অথচ তখন ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রির ওপর কার্টার প্রশাসনের জারি করা নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল।
১৯৮৯ সালে রাফসানজানি ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের অবসান ঘটান। তেমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক আরও সহজতর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ২০০১ সালের ৯/১১ এর ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট বুশ (জুনিয়র) ইরানকে অশুভ চক্র আখ্যায়িত করে তিরস্কার করেছিলেন এবং অর্থনৈতিক অবরোধ খুব কঠিনভাবে আরোপ করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে ইরান-ইরাকের মাঝে যে যুদ্ধের অবসান হয়েছিলো তা প্রায় দীর্ঘ ৮ বছর চলেছিলো। এ যুদ্ধ যদিওবা ইরান-ইরাক যুদ্ধ ছিল (১৯৮০-১৯৮৮) বাস্তবে ইরাকের পেছনে ছিল আমেরিকা এবং আরবের আমির শাহীরা। মূলত তাদের উস্কানিতে সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু ইরানিরা এ সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে খুবই দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। পশ্চিমা মিডিয়াগুলোর ভাষ্য ছিল যেহেতু ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর ইরানের শেষ সম্রাট মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর সময়ের ইরান সেনাবাহিনীর সুদক্ষ অফিসারদেরকে বরখাস্ত করেছিলো সে কারণে ইরানের পক্ষে যুদ্ধ জয় করা সম্ভব হবে না। বিপ্লবী গার্ড রেজিমেন্ট ছিল সম্পূর্ণ নতুন এবং যুদ্ধ পরিচালনার পূর্ব কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না।

১৯৮০ সালে ইরাক প্রথম ধাক্কায় ইরানের যে ভূমি দখল করেছিলো হাজার হাজার বিপ্লবী গার্ড রেজিমেন্টে-এর প্রাণপণ প্রচেষ্টায় তা অল্প কয়দিনের মধ্যে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিলো। কিন্তু ট্রাইগ্রিস অতিক্রম করায় কোমের মোল্লাদের উচ্চাভিলাষ যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করেছিলো। রাফসানজানি মধ্যপন্থী লোক ছিলেন। তিনি শেষ পরিণতির কথা উপলব্ধি করতে পেরে কিছুটা মাথা ঝুকিয়ে হলেও যুদ্ধের অবসান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কন্ট্রার বিষয় নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে রাফসানজানির কিছুটা বিকল্প যোগাযোগও স্থাপিত হয়েছিলো। যার সুযোগ নিয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে রাফসানজানি কোনও অবহেলার আশ্রয় নেননি।

ইরানের শাসনতন্ত্র অনুসারে ইমামই শেষ কথা বলার কর্তৃপক্ষ। ইমাম গার্ডিয়ান কাউন্সিলের প্রধান। মুসলিম জগতে সুন্নি সম্প্রদায়ের কোনও চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা নেই। কোরআন আর সুন্নাহর প্রতি আনুগত্যই সুন্নিদের মূখ্য বিষয় কিন্তু শিয়ারা ইমামিজমে বিশ্বাসী আর ইমামের প্রতি দৃঢ় আনুগত্যই শিয়া মতবাদে চূড়ান্ত কথা। এমন পরিস্থিতিতে ইরানের প্রেসিডেন্সির সঙ্গে ইমাম অফিসের ধাক্কা ধাক্কি সার্বক্ষণিক ব্যাপার হওয়ার কথা, বিশেষ করে মডার্ন ধ্যান ধারণার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। কিন্তু ১৯৭৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অনুরূপ কোনও পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তাই এ যাবৎ কোনও অচলাবস্থারও ইরান মুখোমুখি হয়নি। এটি ছিল উভয়ের সংযমেরই বহিঃপ্রকাশ।

সংযমও তো বহু সত্যকে তুলে না ধরে নির্বাক থাকা। এতে অন্তর্কলহ হয়নি সত্য কিন্তু ইরান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খাতামি যখন ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন বিল ক্লিনটন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। খাতামির জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণ শুনে ক্লিনটন এতোই উৎসাহিত হয়েছিলেন যে তার পররাষ্ট্র সচিব অলব্রাইট ইরানকে বৈঠকে বসার জন্য দিন ক্ষণ নিদিষ্ট করে বলার জন্য নিজ হাতে চিঠি লিখেছিলেন। খাতামি ইমামের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এড়ানোর জন্য সরাসরি বৈঠক না করে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল পাঠাবার প্রস্তাব করেছিলেন যাতে ক্লিনটনের উৎসাহে ভাটার টান এসে যায়।

অথচ ইরান দীর্ঘ দিনব্যাপী বাণিজ্যিক অবরোধের মাঝে রয়েছে। অবরোধের কারণে তার আর্থিক সচ্ছলতাও বিঘ্নিত হচ্ছিল যে কারণে উন্নয়নও ব্যাহত হয়েছে প্রচুর। চীন আর জাপান অবরোধ উপেক্ষা করে তেল না কিনলে ইরানের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে যেত। অথচ ইরানে তো তেল আছেই এরপর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাস রিজার্ভও রয়েছে ইরানে। ইরান থেকে গ্যাস কেনার জন্য ভারত-পাকিস্তান উন্মুখ।

১৯৮৯ সালে রাফসানজানি যখন ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করেন তখন ইরানের আর্থিক সচ্ছলতা কিছুটা ফিরে পেয়েছিলো আর তখনই রাফসানজানি পুনরায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি চালু করেন। মাহমুদ আহমাদিনেজাদ কট্টরপন্থী লোক। তিনি এ কর্মসূচি সফল করার জন্য প্রাণপণ প্রয়াস চালান।

ইসরায়েলের ধারণা আহমাদিনেজাদ যখন দুই দফা ৮ বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখনই ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে সফলতা অর্জন করেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তখন হট্টগোল লাগিয়ে বসে। ইরান বার বার দাবি করে যে তারা কোনও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেনি। তারা পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে সত্য তবে তা শান্তিপূর্ণ কাজ অর্থাৎ চিকিৎসা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ব্যবহার করবে। ইরানের প্রেসিডেন্ট থাকার সময় আহমাদিনেজাদ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের বক্তৃতায় বারবার ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের অস্তিত্ব কোনও ভাবেই মানে না। এ কথাটা আহমাদিনেজাদ বার বার বলাতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কোনও কিছু যায়ওনি, আসেওনি। মধ্যখানে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিটাই আন্তর্জাতিক ঘেরাও এর মাঝে নিপতিত হয়েছে। অথচ ইসরায়েল নিরবে নিভৃতে তার পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে গেছে এবং সফলতাও অর্জন করেছে। এখন নাকি ইসরায়েলের হাতে দুইশত পারমাণবিক বোমা রয়েছে এবং দুইশত ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের দিকে মুখ করে বসিয়ে রেখেছে।

ইসরায়েল বার বার ইরান আক্রমণ করে তাদের পারমাণবিক প্ল্যান্টে বোম্বিং করে ধ্বংস করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরোক্ষ হস্তক্ষেপের কারণে ইসরায়েলের সে উদ্যোগ সফল হয়নি।

মধ্যপ্রাচ্যের আমির শাহীরাও ইরানের বিরুদ্ধে, কারণ ইরান রাজতন্ত্রের পক্ষে নয়। ইরানি হাজীরা সৌদি আরবে বেশ কয়েকবার গণ্ডগোলও করেছিলো। তাও ইরানের বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচিত হয়নি। এখন মধ্যপ্রাচ্যে আমির শাহীরা এবং ইসরায়েল ইরানের চরম শত্রু। বর্তমানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তিনি গত ২০ ও ২১ মে সৌদি আরব সফরে এসেছিলেন এবং বাদশা সৌদ ইবনে সালমানের উদ্যোগে গঠিত ইসলামি জোটের রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মেলনে ভাষণও দিয়েছেন।

ট্রাম্প সৌদি আরবের কাছে ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেছেন এবং ১০ বছরের মাঝে দফায় দফায় আরও ৩০ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করার দ্বিতীয় আরও একটা চুক্তিও সম্পাদন করেছেন। সৌদি আরবের অনুরূপ যুদ্ধ প্রস্তুতি মুসলমানের দুশমন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নয়। অস্ত্র কিনে সৌদি আরবকে অস্ত্রাগার বানাচ্ছেন ইরানকে শায়েস্তা করার জন্য। সৌদি বাদশা সালমান এ কথা প্রকাশ্যে বলছেন।

২০১৩ সালে হাসান রুহানি প্রথম যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামাই প্রথম ফোনে রুহানির সঙ্গে কথা বলেন এবং আমেরিকার রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানির সমন্বয়ে গঠিত দেশগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আলোচনা করে একটা চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছিলো। এ চুক্তিতে জাতিসংঘেরও অনুস্বাক্ষর রয়েছে। আমেরিকা এ চুক্তি বাতিল করার কথা বললেও তাদের পক্ষে এ চুক্তি বাতিল করা সম্ভব হবে না। কারণ এ চুক্তির স্বাক্ষরকারী শুধু আমেরিকা নয়। চুক্তির ব্যাপারটা সৌদি আরবও মেনে নিয়েছেন। শান্তিপূর্ণভাবে এ চুক্তিটি কার্যকর হলে ধীরে ধীরে ইরানের ওপর থেকে অবরোধ উঠে যাবে। আবার ইসরায়েল চাচ্ছে না যে অবরোধ উঠে ইরানের হাতে অঢেল অর্থ আসুক।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব দূত পারমাণবিক ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছে। তাদের এ কাজে পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হবে। আলজেরিয়াও নাকি আনবিক অস্ত্র বানাতে চেষ্টা করছে। তুরস্কও চেষ্টা করছে। আণবিক অস্ত্র তৈরির উদ্যোগ এসব দেশ নিলে ইসরায়েলের সঙ্গে ভারসাম্য আসবে। যেই ইসরায়েল টমেটো আর শশা এক্সপোর্ট করতো তারা এখন বিশ্বের অন্যতম অস্ত্র রফতানিকারক দেশ।

রুহানি মডারেট লোক। তিনি পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। গত জানুয়ারিতে রাফসানজানির মৃত্যুতে যে ব্যাপক মিছিল তেহেরানে হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে মধ্যপন্থীদেরই আধিপত্য ইরানে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। ইরানের ইমাম আলী খামেনির ক্যানসার হয়েছে আর তার মেয়াদও শেষ হয়েছে। ইমামের স্থলে খাতামির মতো একজন লোকের আগমন ঘটলে ইরানে মধ্যপন্থীদেরই আবস্থান সুদৃঢ় হবে যা এখন ইরানের জন্য খুবই প্রয়োজন। বিশেষ করে আমেরিকার চালে, সৌদির অনুগত হয়ে সৌদি আরবের পাশাপাশি মিসর, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত যখন কাতারকে একঘরে করেছে তখন ইরানের আরও সতর্ক পা ফেলার দরকার আছে। উল্লেখ্য, ইরান ও কাতারের মধ্যে যেমন ভালো সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি তাদের উভয়ের সঙ্গে উন্নত সম্পর্ক রাশিয়ার।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ