X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটেনের নির্বাচন: কসমোপলিটন মনের জয়

শুভ কিবরিয়া
১০ জুন ২০১৭, ১৫:০৬আপডেট : ১০ জুন ২০১৭, ১৫:১১

শুভ কিবরিয়া ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। থেরেসা মে'র অতি আত্মবিশ্বাসকে পরাজিত করে বিরোধী লেবার পার্টির ফলাফল আশাতীত ভালো হয়েছে। থেরেসার মে’র দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও এককভাবে সরকার গঠনের মতো গরিষ্ঠতা পায়নি। আগের নির্বাচনের চেয়ে কম আসন পেয়েছে থেরেসা মে’র নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি। তারা মোট ৬৫০ টি আসনের মধ্যে পেয়েছে ৩১৮ টি আসন। অন্যদিকে জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টি আগের তুলনায় অনেক ভালো করে পেয়েছে ২৬১টি আসন। থেরেসা মে’র নেতৃত্বে তৈরি হচ্ছে কোয়ালিশন সরকার।
এই নির্বাচনি ফলাফল ছিল কিছুটা অপ্রত্যাশিত। কিন্তু কেন এই ফলাফল?
ব্রিটেন কি তাহলে তার কসমোপলিটন উদারনৈতিক চিন্তাতেই ফিরলো?
এই বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে চোখ রাখা যেতে পারে সেখানকার সাম্প্রতিক সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে।
দুই.
আইসিসি চ্যাম্পিয়ানস ট্রফির বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ডের ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম টেলিভিশনে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি ধীরে রান করার নীতি নিয়ে টিকে থাকার পথে চলেছে। ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল একটা সুন্দর সেঞ্চুরিও করলেন। মাঠে বাংলাদেশ সমর্থকদের দারুণ উচ্ছ্বাস। ইংল্যান্ডের মাঠে খেলা হচ্ছে। সেই মাঠে বাংলাদেশি সমর্থকদের যে তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে তা প্রায় দেশের মাঠে দেখা যায়। পোশাক-বাদ্যে-শোরগোলে-উচ্ছ্বাসে আর লাল-সবুজের পতাকায় সেদিন ইংল্যান্ডের মাঠকে প্রায় মিরপুর স্টেডিয়ামের মাঠ বানিয়ে ছেড়েছে বাংলাদেশি সমর্থকরা।
এই বাংলাদেশি সমর্থক কারা?

অধিকাংশই ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসী। অনেকের হয়তো জন্মই হয়েছে ইংল্যান্ডে। এই অভিবাসীরা অধিকাংশই ব্রিটেনের নাগরিক। অনেকেই হয়তো নাগরিকত্ব পাওয়ার পথে।

ইংল্যান্ডে বসবাস করে, সেদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে, সেদেশের অর্থনীতি আর জল হাওয়ায় খেয়ে পরে বেড়ে ওঠে তারা বুকে ধরে রেখেছে বাংলাদেশকে। এক অর্থে এটা বাংলাদেশি হিসাবে আমাদের জন্য এক নিদারুণ গর্ব ও ভালোলাগার বিষয়।

কিন্তু উল্টোভাবে যদি ভাবি, সেদেশের একজন নাগরিক যখন দেখছে, তাদের দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে, সেদেশের সকল সুযোগ সুবিধা নিয়েও তারা বুকে বেধে রেখেছে অন্যদেশ (বাংলাদেশ)। এমনকি ইংল্যান্ডের সাথে যখন খেলা হচ্ছে তখনও তারা বাংলাদেশকেই সাপোর্ট করছে। এ পরিস্থিতিতে একজন ব্রিটিশ নাগরিক, অভিবাসীদের এই আচরণ কেমনভাবে দেখছে?

বলা যায় কট্টর বর্ণবাদী অভিবাসী-বিরোধী মনোভাবাপন্ন ব্রিটিশ ছাড়া অন্যরা এটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। নিয়েছে বলেই অভিবাসী বাংলাদেশিরা ইংল্যান্ডের মাঠে বসে , ইংল্যান্ড-বাংলাদেশের খেলায়, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশকে জোর সাপোর্ট দিয়ে এমন জোর গলায় উচ্ছ্বাস - আবেগ প্রকাশ করতে পারছে। আর এটাই ইংল্যান্ডের শক্তির জায়গা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য যে একসময় অস্ত যেত না তার অনেক কারণের মধ্যে এই শক্তিমত্তার জায়গা অন্যতম।

ভাবনাটা একটু ঘুরিয়ে দেখলে কেমন হয়? ধরা যাক, ঢাকা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ বনাম মিয়ানমারের ফুটবল খেলা চলছে। স্টেডিয়ামের অর্ধেক জুড়ে বাংলাদেশে বসবাসরত মিয়ানমারের নাগরিকরা খেলা দেখতে এসেছে। তারা সবাই জোরেসোরে মিয়ানমারকেই সমর্থন করছে।  তাদের এই আচরণকে কি আমরা সহ্য করতে পারতাম?

কিংবা মিরপুর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের উত্তেজনাকর ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। মাঠ উপচে পড়েছে বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের দ্বারা। তারা সবাই সমর্থন করছে পাকিস্তানকে। এই পাকি সমর্থকদের কি আমরা স্বাভাবিক চোখে দেখতে পারতাম?

আমার ধারণা এইখানেই ব্রিটেন আমাদের চেয়ে আলাদা। এখানেই তাদের শক্তি। এই যে বহু বর্ণের, বহু ধর্মের, বহু মনোভাবের, বহু জাতির মনকে তাদের মতো করে বাঁচতে দিয়ে এক কসমোপলিটন দেশে পরিণত হয়েছে ব্রিটেন সেটাই তাদের শক্তির জায়গা তৈরি করেছে। এই যে বহু জাতির মিলন হয়েছে, বহু সংস্কৃতির বাজার বসেছে --সেটাই ব্রিটেনকে, তার গণতন্ত্রকে, তার উদারনৈতিকতাকে, তার সভ্যতাকে এতটা শক্তিমান করেছে।

তিন.

সেই ব্রিটেন হয়েছে আক্রান্ত। উপর্যুপরি সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে। বলা হচ্ছে চরমপন্থী ইসলামি সন্ত্রাসীরা এই হামলা চালাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে ব্রিটেনের বহুবর্ণ, বহু জাতির এই সমাজের ভেতরে কোথাও এমন একটা অসুখ হয়েছে যা এইসব কথিত সন্ত্রাসীদের এইরকম আত্মঘাতী প্রাণসংহারকারি মানবতাবিরোধী খুনের দিকে ধাবিত করছে। শুধু তাই নয় ব্রিটেনের কসমোপলিটন মনও আজ সন্দেহ-বিদ্বেষ নিয়ে অভিবাসিদের দিকে তাকাচ্ছে। ব্রিটেনের যে শক্তির জায়গা সেই কসমোপলিটন আচরণেও আজ চিড় ধরেছে। ব্রিটেনের একটা বড় অংশের মানুষ অভিবাসিবিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। তাদের ধারণা, নানান দেশের অভিবাসীরা এসে ব্রিটেনের আদি জনগণের অর্থনীতি আর সমাজে ভাগ বসাচ্ছে। এই একরঙ্গা নীতি নিয়েই ব্রিটেনের জনগণের বড় অংশ ব্রেক্সিট লড়াইয়ে ইউরোপ থেকে আলাদা হতে ভোট পর্যন্ত দিয়েছে। ব্রিটেন জুড়ে কট্টর ডানপন্থী ন্যাশনালিস্টদের প্রভাব শুধু বাড়ছে না, গায়ের জোরও বাড়ছে।

কিন্তু ব্রিটেনের এই নয়া মনোভাবের কারণ কী? কেন তারা সন্ত্রাসীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা ব্রিটেনের ভেতর খুব একটা হয়েছে তা বলা যাবে না। ব্রিটেনের বড় অংশ মনে করে ইসলামি জিহাদিদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ অংশই এই রক্তপাতের জন্য দায়ী? কিন্তু ইসলমি জিহাদিরা কেন সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে? কী তাদের এই মরণপণ আত্মঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?

ব্রিটেনের সাম্প্রতিক অতীতে যে যুদ্ববাজ পররাষ্ট্র নীতিতে জড়িয়ে পৃথিবীর একটা বড় অংশে যুদ্ধবিগ্রহ বাধিয়ে বা যুদ্ধবাজদের প্রশ্নহীন সমর্থন দিয়ে মানুষের প্রাণহানি আর নিষ্ঠুর দুর্দশার কারণ হয়েছে সেটা কি এই বর্বর ইসলমি জিহাদের অনুপ্রেরণার কারণ?

ব্রিটেনের রাজনীতি এই প্রশ্ন নিয়ে খুব একটা সরব না হলেও হালে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করেছেন। সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে জেরেমি করবিন বলেছিলেন, ম্যানচেস্টারে হামলার জন্য তার নিজ দেশের ‘যুদ্ধবাজ’ পররাষ্ট্রনীতিই দায়ী। তার বিশ্লেষণ হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকার অন্য দেশে যে যুদ্ধ লড়ছে বা সমর্থন করছে এবং যেভাবে সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করছে তাই এসব হামলাকে উসকে দিচ্ছে। ক্ষমতায় গেলে তিনি ব্রিটিশ যুদ্ধবাজ নীতির পরিবর্তন আনবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

জেরেমি করবিন আরও বলেছিলেন, ‘কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে জানা জরুরি। এটি আমাদের জনগণের সুরক্ষার ক্ষেত্রেও জরুরি। এটি সন্ত্রাসবাদকে মদদ দেওয়ার পরিবর্তে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইকে সামনে নিয়ে আসবে। আমাদের সাহসের সঙ্গে বলতে হবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কাজ করছে না।’

তবে লন্ডনে সাম্প্রতিক হামলাকারিদের খুঁজে বের করা ও শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়েও তিনি কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন।

জেরেমি করবিনের এই আত্মানুসন্ধান চিন্তাকে ব্রিটেনের জনগণ মর্যাদা দিয়েছে। ব্রিটেনের তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ জেরেমি করবেনের এই যুদ্ধবিরোধী নীতির প্রতিই সমর্থন দেখিয়ে এইবারের নির্বাচনে লেবার পার্টিকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করেছে।

চার.

এই নির্বাচনের প্রাক্কালে দু’দুটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। ম্যানচেস্টারে হামলায় ২২ জন এবং লন্ডন শহরের হামলায় ৮ জন মারা গেছে। এই সন্ত্রাসী হামলার দায় শিকার করেছে আইএস। এই হামলার পর নির্বাচনের ফোকাস অনেকাংশে  ঘুরে গিয়েছিল। মূল ফোকাসে চলে এসেছিল ‘সন্ত্রাস দমন’। কে কিভাবে এই সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করে জনজীবনে স্বস্তি আনবে সেটাই হয়ে উঠেছিল এই নির্বাচনের মূল প্রতিপাদ্য।

এই অবস্থায় কথিত উদারপন্থীরা নির্বাচনে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়বে মনে করলেও শেষে কট্টরপন্থীরা জনরায় পায় নাই।  সন্ত্রাস দমনের প্রশ্নে অধিকতর কঠোর হওয়ার কথা বলেছিলেন থেরেসা মে। অতি কট্টর মনোভাবাপন্ন হয়ে তিনি প্রচলিত মানবাধিকার আইনের সংস্কার পর্যন্ত করে সন্ত্রাসীদের প্রতি কঠোর হবার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। থেরেসা মে তো উচ্চারণই করেছিলেন, ‘এনাফ ইজ এনাফ’।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দু-দুটি সন্ত্রাসী হামলা নির্বাচনি ফলাফলকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে নাই। ব্রিটেনের জনগণ তুলনামূলক শান্তভাবে এমন রায় দিয়েছেন যাতে কট্টর ন্যাশনালিস্ট বর্ণবাদী অভিবাসন বিরোধী দল এই নির্বাচনে হালে পানি পায় নাই। শুধু তাই নয়। কনজারভেটিভ পার্টির অতি কট্টর পন্থাও হালে পানি পায় নাই। তারা অতীতের চেয়ে খারাপ ফলাফল করে এখন কোয়ালিশন সরকার করতে বাধ্য হচ্ছে।

পাঁচ.

লেখার শুরুতে ব্রিটেনের যে উদারনৈতিকতাকে, যে কসমোপলিটন মনকে শক্তি হিসাবে বর্ণনা করেছিলাম, বলা যায়, এবারের নির্বাচনে সেই উদারনৈতিকতার পতন অনিবার্য বলে মনে করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা ঘটেনি। শেষাবধি শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন ভোটারদের ইচ্ছাই প্রতিফলিত হয়েছে।

ব্রিটেনের কসমোপলিটন মন যত কট্টর জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী রঙে সাজবে ততই বিভেদ-বিদ্বেষ, হিংসা-ঘৃণা ব্রিটেনের সমাজকে আরও বিভক্ত, আরও অস্থির করে তুলবে এই বিবেচনাকে আমলে নিয়েছে ব্রিটেনের নতুন প্রজন্মের ভোটাররা। সন্ত্রাসীরা ধর্মের নামে, বর্ণের নামে এই বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে আরও নিত্যনতুন প্রাণঘাতের উপায় বের যাতে না করতে পারে, তা প্রতিরোধের জন্য উদারনৈতিক ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়েছে এবারের ভোটাররা।

শুধু অস্ত্র আর পুলিশ দিয়ে সমাজের বিভেদ দূর করা যায় না। ক্ষমা-ভালোবাসা আর উদারতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে হয়। ব্রিটেনের এবারের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সেই নীতিনিষ্ঠ উদারতা থেকে সরে আসে নাই। সকলের অনুমান ভুল প্রমাণ করে ব্রিটেনের ভোটাররা বহুচর্চিত ব্রিটিশ কসমোপলিটন মনকেই উপরে তুলে ধরেছে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঈদযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত: জরিপ
ঈদযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত: জরিপ
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দেওয়া ব্যক্তির মৃত্যু
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দেওয়া ব্যক্তির মৃত্যু
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ