X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

সমীপে, আবুল মাল আবদুল মুহিত

আনিস আলমগীর
২০ জুন ২০১৭, ১২:০৯আপডেট : ২০ জুন ২০১৭, ১৮:৪৭

আনিস আলমগীর আমরা সাংবাদিকেরা ডাক্তার নই কিন্তু ডাক্তারি নিয়ে কথা বলি। অর্থনীতিবিদ নই, কিন্তু বাজেট নিয়ে আলোচনা করি। কোনও পেশাদার কূটনীতিবিদ নই তবু কোনও কূটনীতিবিদকে কথা বলার সময় রাখ ঢাক রেখে কথা বলি না। কারণ সাংবাদিকতার ধারণাতেই আছে সাংবাদিকেরা হবে সব কাজের কাজী। এরা ডাক্তারকে ডাক্তারি জ্ঞান দিকে, উকিলকে ওকালতি। সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও তাই- কোনও বিষয়ে মাস্টার না আবার সব বিষয়ের মাস্টার। গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ের একজন ছাত্র হিসেবে যদি বলি তাহলে বলতে হবে- 'Jack of all trades, master of none'.
ব্যক্তিগত বিষয় যদি বলি, সাংবাদিক হিসেবে সব বিষয়ে লিখতে ভয় যে পাই না তা নয়। অর্থনীতি বিষয়ে আমি কমই লিখি। আবার লিখে অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের ‘রাবিশ’ শব্দ শুনতে হয় কিনা তাতেও ভয়। তবে ভয় ডর ছেড়ে এবারের বাজেট আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মহোদয়কে কিছু কথা লিখতেই হচ্ছে।  ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের যে বাজেট আমাদের অর্থমন্ত্রী সংসদে পেশ করেছেন তা নিয়ে এবার কথা হয়েছে খুব বেশি। এমনকি আমার ১১ বছর বয়সী ছেলেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে আমার সঙ্গে। দু’দিন আগে একটা সংবাদ দেখিয়ে সে আমার কাছে জানতে চাইলো, ফিনান্স মিনিস্টার বলছেন, উনি লাইফের বেস্ট বাজেট দিয়েছেন, তাহলে ১৫% ভ্যাট কেন? আমি বললাম, সেটা উনি নিজে মনে করছেন।
মিডিয়ায় দেখলাম এমন কী মন্ত্রীরাও সংসদে বাজেটের বিরোধিতা করেছেন। প্রণয়নের সময়ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে করারোপ নিয়ে দেখেছি বাণিজ্য মন্ত্রীর বাদানুবাদ হয়েছে। মন্ত্রিসভার উচিৎ বাজেট তৈরির আগে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনায় বসে অর্থ দফতরকে বাজেটের একটা আউট লাইন দেওয়া, যার ওপর ভিত্তি করে অর্থ দফতর বাজেট প্রণয়ন করবে। জিয়াউর রহমান থেকে শেখ হাসিনার সরকার পর্যন্ত যারা বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন তারা প্রথম জীবনে ছিলেন আমলা অবসর গ্রহণের পরই হয়েছেন মন্ত্রী। অবশ্য মন্ত্রী হয়ে তারা যে দলের মন্ত্রী হয়েছেন সে দলের রাজনীতিও করেছেন।

মরহুম সাইফুর রহমান সাহেব অবশ্য আমলা ছিলেন না। তিনি ছিলেন ‘রহমান রহমান হক’ নামের এক চাটার্ড একাউন্টস ফার্মের অন্যতম অংশীদার। আমলাদের মতই চাটার্ড একাউন্টস ফার্মের অংশীদারের জীবন। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মাঝে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। চরিত্র আমলার মতই। তারা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে। আম-জনতার সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। বঙ্গবন্ধুর অর্থমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন ছাড়া বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোনও প্রকৃত রাজনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী হননি। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানেরা সব সময় অর্থদফতরে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের থেকে মন্ত্রী নিয়োগ করার প্রবণতা দেখিয়েছেন।

বাজেটও রাজনীতির অংশ। বাজেট মানুষের জন্য। সুতরাং সারা জীবন যারা মানুষ নিয়ে খেলা করেন তাদের থেকেই মন্ত্রী হওয়া উচিৎ। কারণ তারাই মানুষের সুখ দুঃখ সম্পর্কে বেশী অবগত। আতাউর রহমান খান সাহেব তার ‘ওজারতীর দুই বছর’ বইতে লিখেছেন- আমলারা নিজেদের পুরুষত্ব বৃদ্ধিতে ওস্তাদ। জনগুরুত্বের প্রতি তাদের খেয়াল থাকে না। বেশি কথা বললে রুল দেখায়।

এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান কেউই রাজনীতিবিদকে এই অর্থদফতরের দায়িত্ব দিতে চাননি। কোনও রাজনীতিবিদকে শিক্ষানবিশ হিসেবে আমলা অর্থমন্ত্রীর অধীনে প্রতিমন্ত্রীও করেননি। অথচ ভারতের মতো বিশাল দেশে রাজনীতিবিদেরাই অর্থমন্ত্রী হন। মরহুম হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর কিছু দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকলে মরহুম আবুল মনসুর আহমদই অর্থমন্ত্রী হতেন। কথা পাকাপাকিই হয়ে গিয়েছিলো। দীর্ঘ বিদেশ সফর থেকে এসে ষড়যন্ত্রে পড়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর কারণে আবুল মনসুর সাহেব অর্থমন্ত্রী হতে পারেননি।

আবুল মনসুর সাহেব ছিলেন উকিল। ওকালতি ছেড়ে করেছেন সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি। অবশ্য প্রতিভাবান লোক ছিলেন। প্রতিভাবান লোকের জন্য বাণিজ্য, বিজ্ঞান সবই সমান। শেরেবাংলা ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার প্রিমিয়ার ছিলেন। একবার তার অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করার কয়েকদিন আগে পদত্যাগ করেছিলেন। শেরেবাংলা নিজেই তিন দিনের মধ্যে বাজেট প্রণয়ন করে সংসদে পেশ করেছিলেন। অনেকে বলেছেন, শেরেবাংলার বাজেটই নাকি ছিল বঙ্গীয় বিধানসভায় পেশ করা বাজেটগুলোর মাঝে উত্তম বাজেট।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আমি লিখতে বসিনি। তিনি বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থার সময় বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন। ২০০৮ সালে যখন বারাক ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তখন বিশ্ব অর্থনীতির এতই নাজুক অবস্থা ছিল যে আমেরিকার শতাধিক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলো। বিশ্ব বিখ্যাত মটর কোম্পানি ফোর্ড নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আদালতে গিয়েছিলো। সুতরাং তার কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি বিশ্ব অর্থনীতির নাজুক অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্ব মন্দার কবল থেকে রক্ষা করার জন্য যে বুহ্য রচনা করেছিলেন তাতে তিনি সফলকাম হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের ছোট অর্থনীতিতে বিশ্ব মন্দার তুফান লাগলে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেত। কিন্তু আবুল মাল আবদুল মুহিত সব প্রজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আলাদা করে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিলো। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষ তার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার মতো লোক অর্থমন্ত্রী আর আতিউর রহমানের মতো লোক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকার পরও বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ অর্থব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিষ্পত্তিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং-এর কবলে পড়ে অর্থ হারিয়েছে। এর জবাব তো অর্থমন্ত্রী মুহিত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর আতিউর রহমানকে দিতে হয়।

আমরা লক্ষ্য করেছি অর্থ মন্ত্রণালয় আর বাংলাদেশ ব্যাংকের মাঝে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে সব সময় একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। এবারের বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোকে মূলধন সরবরাহ করতে হয়েছে। তাদের আগের মূলধন গেলো কোথায়? রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর আমলারা নয় ছয় করে যে মূলধন খোয়াচ্ছে তার প্রতি অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন আর বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটরিং করলো না কেন? আসলে দ্বৈত শাসন সব সময় খারাপ। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে দ্বৈতশাসনের অবসান হওয়া দরকার। রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলোর সব দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সোপর্দ্দ করা উচিৎ।

অর্থমন্ত্রণালয় হবে অর্থ বিষয়ে অভিভাবক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কন্ট্রোলার অব সিডিউল ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ব-অরাষ্ট্রায়ত্ব সব সিডিউল ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে। পাকিস্তানের সময় এটাই ছিল নিয়ম। বাংলাদেশে বহু সিডিউল ব্যাংক হয়েছে কিন্তু এখনও সিংহভাগ ব্যবসা সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ব চার ব্যাংকই নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এই ব্যাংকগুলোর এমডি আর চেয়ারম্যানের বাজারে দালাল রয়েছে। ঋণ গ্রহীতার সঙ্গে দালালেরা এমডি চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। ১০% অর্থ বরাদ্দকৃত ঋণের অংকের বিপরীতে দিতে হয়।

ঋণের জন্য যদি ১০% দিতে হয় তবে ঋণ গ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করবে কিভাবে? রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর বড় বড় অফিসারদের অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে দুদক তদন্ত করলে বুঝতে পারবে তলে তলে এক একটা অফিসার কত বড় জগৎ শেঠ হয়ে গেছে। অবিলম্বে রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্যথায় অর্থব্যবস্থা ভেঙে পড়লে রাষ্ট্রের ভিত্তি কেঁপে উঠবে। এখন কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।

লিখতে চেয়েছিলাম বাজেটের বিরুদ্ধে বিরুপ সমালোচনার কথা। ১৫% ভ্যাট অসহনীয় সুতরাং স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থায় এ হার বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। কর যদিও বা ব্যবসায়ীদের ওপর আরোপ করা হয়। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত পরিশোধ করতে হয় জনসাধারণকে। অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে এ কথা বিস্মৃত হলে চলবে না। আবার ব্যাংকের কাস্টমারের ডিপোজিটের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ আরেক ভয়াবহ পরিকল্পনা।

১৯৯১-৯২ অর্থবছরে বিএনপির অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমান প্রথম ব্যাংক ডিপোটিজেটের উপর আবগারি শুল্ক ধার্য করেন এক লক্ষ টাকায় দেড় শত টাকা এই কর ছয় বছর অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু কখনও বাজেটে উল্লেখ করেননি। ফলে অনেক আমানতকারী এই করের কথা জানতেনই না। এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী বেশি টাকা শুল্ক ধার্য করেছেন আবার বুক ফুলিয়ে তা বাজেটেও উল্লেখ করেছেন।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম বাজেট। কিন্তু আমি দেখেছি তামাকের কলকেতে আগুন সরবরাহ করতে গিয়ে তিনি ঘরের চালে আগুন দিয়েছেন। কয়দিন পর আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাবে। প্রত্যেক দেশে নির্বাচনের আগে সাধারণত বাজেট প্রদান করে জনমুখী বাজেট। কিন্তু আমাদের অর্থমন্ত্রী শ্রেষ্ঠতম বাজেট দিলেন সর্বত্র আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে।

আওয়ামী লীগ দশ বছর একটানা ক্ষমতায়। প্রতিষ্ঠানিক বিরোধিতা সামাল দিতে তার জান ওষ্ঠাগত হবে। এরপর বাজেটের বিরুপ প্রতিক্রিয়া সামাল দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সুতরাং অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে অনুরোধ করবো বাজেট রিভাইস করুন। সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসুন।

অর্থমন্ত্রীর বয়স এখন ৮৪ বছর। বাংলা ভাষায় ৮০ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স হলে তাকে অশীতিপর বৃদ্ধ বলা হয়। তাকে সবিনয়ে অনুরোধ করব তার যদি আরও মন্ত্রীত্ব করার শখ তাকে তবে প্রধানমন্ত্রীকে বলে যেন দফতর বদলান। তার প্রতি আরও একটা অনুরোধ- যশ থাকতে কীত্তন শেষ করাই উত্তম এ প্রবাদটা যেন গুরুত্ব সহকারে তিনি বিবেচনায় নেন।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টেস্ট পরীক্ষার নামে অতিরিক্ত ফি নিলে ব্যবস্থা
টেস্ট পরীক্ষার নামে অতিরিক্ত ফি নিলে ব্যবস্থা
আবহাওয়ার খবর: ঢাকাসহ ৪ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির আভাস
আবহাওয়ার খবর: ঢাকাসহ ৪ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির আভাস
বিলেতে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন নতুন আসা বাংলাদেশিরা: কমিউনিটিতে প্রতিক্রিয়া
বিলেতে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন নতুন আসা বাংলাদেশিরা: কমিউনিটিতে প্রতিক্রিয়া
হিটলারের চেয়েও ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়েছে নেতানিয়াহু: কাদের
হিটলারের চেয়েও ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়েছে নেতানিয়াহু: কাদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ