X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কবে যাবো পাহাড়ে, আহারে…

প্রভাষ আমিন
২১ জুন ২০১৭, ১৪:৪০আপডেট : ২১ জুন ২০১৭, ১৪:৪৪

প্রভাষ আমিন তিন পার্বত্য জেলায়ই আমি গিয়েছি, একাধিকবার গিয়েছি। ঠিক বেড়াতে যাওয়া বলতে যা বোঝায়, তা গিয়েছি একবার। কিন্তু নানা কাজে গিয়েছি বারবার। এরমধ্যে অনেকবার গিয়েছি রাঙামাটি। বাবার চাকরির সুবাদে একসময় রাঙামাটিতে আমাদের বাসা ছিল। রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে লেকের পাড়ে টিলার ওপরে ছিল আব্বার সমাজ সেবা অধিদফতরের অফিস। প্রথমে আমাদের বাসা ছিল রিজার্ভ বাজারেই, পরে বাসা নেওয়া হয় উপজেলা অফিসের কাছে। ঢাকায় ছুটিছাটা হলে সবাই যখন বাড়ি যেতো, আমি যেতাম রাঙামাটি। বাসার উল্টোদিকেই ছিল কাপ্তাই লেক। আমি নিয়মিত সেই লেকে সাঁতার কাটতাম। ঢাকা থেকে নাইট কোচে রওয়ানা দিয়ে রাঙামাটি পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে যেতো। ভোর হলেই আমি চোখ খুলে তৃষিতের মতো বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বারবার দেখি, তবু মন ভরে না। দুই পাশে কী অপরূপ দৃশ্য। চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের পাহাড়ি অংশটা আমার খুবই প্রিয়।বিদেশের মতো বা সুইজারল্যান্ডের মতো লাগে বলি না, আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগে। এরচেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে। রাঙামাটির কাছে আসলে পাহাড়ের সাথে যখন কাপ্তাই লেকের মিতালি হয়, তখন সৌন্দর্য্য যেন স্বপ্নকেও হার মানায়। সেই রাঙামাটি এখন ধ্বংসস্তুপ।
পাহাড়ধসের খবর পেয়ে মঙ্গলবারই এটিএন নিউজের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি মৃন্ময় বিশ্বাসকে রাঙামাটি যেতে বলেছিলাম। সে মধ্যরাতে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের একটা অংশে কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে জানালো, আর সামনে যাওয়া সম্ভব নয়। তার পাঠানো ছবি দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। পাহাড়ে ওঠা যেমন কঠিন, নামাও কঠিন।
তেমনি তখন রাঙামাটির পথে যাওয়া যেমন কঠিন, ফেরাও। মৃন্ময় কোনোরকমে ফিরতে পেরেছিল। কিন্তু তখনও আমরা আসলে জানি না, সামনের পথ আরো কতটা দুর্গম। পরদিন ভোরে ঢাকা থেকে যাওয়া আশিকুর রহমান অপু রাঙামাটি যাওয়ার পথে বেরুলো। শেষ পর্যন্ত সে সন্ধ্যায় রাঙামাটি যেতে পারলো বটে, তবে তার মাঝের পথচলা বেয়ার গ্রিলসকেও হার মানায়। ক্যামেরাম্যান রিফাতের তোলা তাদের এই অ্যাডভেঞ্চারাস যাত্রার ছবি আসলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকেও চমকে দেওয়ার মতো।
যেখানে ছিল আমার প্রিয় সেই স্বপ্নের মতো রাস্তা, সেখানে এখন দুইশ ফুট গভীর খাদ। ঘাঘরা বাজারেই গাড়ি ছেড়ে পায়ে হাঁটা পথ ধরেছে অপু-রিফাত। তারপর হাঁটু সমান কাদা আর অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৯ কিলোমিটার রাস্তা পেরুতে অপু আর রিফাতের লেগেছে ৬ ঘণ্টা। সাথে ক্যামেরা, ব্যাকপ্যাক, ছাতা, মাইক্রোফোন, ব্যাগসহ নানা প্রয়োজনীয় উপকরণ।
আমার প্রিয় রাঙামাটি এখন বিচ্ছিন্ন এক ধ্বংসস্তুপ। চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সরাসরি সড়ক যোগাযোগ আবার চালু হতে কতদিন লাগবে? অপুর ধারণা দুইমাস। সেনাবাহিনী অবশ্য বলছে, একমাসের মধ্যেই এই রাস্তায় ভারি যানবাহন চলতে পারবে। তবে আগের সেই রাস্তা হয়তো আর মেরামত করা সম্ভব হবে না। কোনও কোনও রাস্তা নতুন করে বানাতে হবে। রাঙামাটি থেকে খাগড়াছড়ি হয়ে বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থাটিও বিধ্বস্ত। তিনদিন পর নৌ পথে কাপ্তাই হয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার একটি উপায় বেরিয়েছে, তাও যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। কাপ্তাই-চট্টগ্রাম রাস্তাটি যাচ্ছেতাই রকম খারাপ।
যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে এত কথা বলার কারণ, যোগাযোগ ব্যবস্থাই আধুনিক সভ্যতার সূচক। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা মানেই দুর্যোগের, দুর্ভোগের চূড়ান্ত। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়। ফলে বেড়ে যায় যাতায়ত ব্যয়, বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। চাল, আলু, সবজি, মোমবাতি, কেরোসিনের মতো নিত্যপণ্যের দাম কোনও কোনও ক্ষেত্রে তিনগুন বেড়ে গিয়েছিল।

হাসপাতালে বিঘ্নিত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষজন কিছু ত্রাণ পেলেও দুর্গম অনেক এলাকায় এখনও কেউ যায়নি। তবে কাপ্তাই হয়ে নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হয়েছে। বাজারের ঊর্ধ্বগতিও সামাল দেওয়া গেছে। তবু পরিস্থিতি এখনও যথেষ্টই খারাপ।
রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম মিলে পাহাড়ধসে মৃতের সংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়েছে। শুধু রাঙামাটিতেই মারা গেছে ১১২ জন। কিন্তু যারা মারা গেছেন, তারা তো মরে বেঁচেছেন। কিন্তু রাঙামাটিতে এখন যারা বেঁচে আছেন, তাদের বেঁচে থাকাই দায়। একে তো মাথা গোজার ঠাই নেই, তারওপর পেটে ভাত নেই।
হাওরের বিপর্যয়ের সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব দুর্যোগ এলাকা ঘোষণার মাপকাঠি জানিয়েছিলেন। কত জন মানুষ মরলে, কতটি গরু-ছাগল মরলে দুর্যোগ এলাকা হবে, তা আমি জানি না, জানতে চাইও না। কত হাজার মরলে পরে
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিবের কাছে দুর্যোগ মনে হবে, জানি না। আমার খালি চাওয়া, রাঙামিাটিতে যারা বেঁচে আছেন, তারা যেন বেঁচে থাকতে পারেন। দেশের অন্য এলাকায় ঝড়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে, সবাই মিলে তাদের পাশে
দাঁড়ানোর নানা উদ্যোগ দেখি। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ত্রাণ নিয়ে ছুটে যান। পাহাড়ধসের পর তেমন কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। যেন পাহাড় বাংলাদেশের অংশ নয়। অবশ্য চাইলেও সাধারণ কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের পক্ষে রাঙামাটি যাওয়া কঠিন। তাই সরকারের দায়িত্ব অনেক বেশি। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে এটা অপ্রতুল। এখনই সরকারের উচিত তাদের সব সামর্থ্য ও আন্তরিকতা নিয়ে রাঙামাটির দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো।

অবশ্যম্ভাবী ধসের কথা জেনেও পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষদের জোর করে সরিয়ে না এনে আমরা অন্যায় করেছি, এখন বেঁচে থাকা মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে, তার কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ এসেছে। সে সুযোগটা যেন আমরা হেলায় না হারাই। আমরা সবকিছু নিয়ে পাল্টাপাল্টি রাজনীতি করি। অন্তত পাহাড়ের দুর্গত মানুষগুলোকে যেন রাজনীতির বাইরে রাখি।
প্রতিবছর কেন পাহাড় ধসে যাচ্ছে, তা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, আরো হবে। বিশেষজ্ঞরা পাহাড়ধস ঠেকাতে নানা উপায় নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু সবচেয়ে সহজ কথাটা হলো, আমরা পাহাড়কে একটা থাপ্পর দিয়েছি বলে, পাহাড় আমাদের ১০০টা থাপ্পর ফিরিয়ে দিয়েছে। আগে পাহাড়ধসে পাহাড়ি লোকজন কম মারা যেতো, সেটেলাররা বেশি মারা যেতো। কারণ পাহাড়িরা জানে, পাহাড়কে কতটুকু বিরক্ত করলে সে বিরক্ত হবে না। তাই তারা পাহাড়ে ঘর বানায় মাচা করে, যাতে পাহাড়ের প্রাকৃতিক বিন্যাস খুব বেশি ক্ষতি না হয়। কিন্তু সেটেলাররা গিয়ে দিনের পর দিন পাহাড় কেটে, পাহাড়ের ঢালে ঘর বানায়, গাছ কেটে সাবার করে ফেলে। এভাবে দিনের পর দিন চলতে চলতে পুরো পাহাড়ই এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। নগরে আগুন লাগলে যেমন দেবালয় রক্ষা পায় না। তেমনি দিনের পর দিন সেটেলাররা পাহাড়ের ক্ষতি করার কারণে এখন পাহাড়িরাই রক্ষা পায়নি পাহাড়ের অভিশাপ থেকে।

পাবর্ত্য এলাকায় যারা থাকেন, হোন তিনি পাহাড়ি বা সেটেলার বাঙালি বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি বা সশস্ত্র বাহিনীর সদসদ্য, তাদের কাছে পাহাড়ের সৌন্দর্য্য নিত্যদিনের চেনা। আর আমরা যারা, কবে যাবো পাহাড়ে, আহারে আহারে... গাইতে গাইতে বেড়াতে যাই, তাদের কাছে পাহাড়ের সৌন্দর্য্য অন্যরকম। এটিএন নিউজের ক্যামেরাম্যান রিফাত  প্রথমবারের মতো রাঙামাটি গিয়ে বিস্মিত। সে রিপোর্টার অপুকে জিজ্ঞাসা করছিল, ভাই সবাই যে বলে রাঙামাটি এত সুন্দর। কই সে সুন্দর? আসলে প্রকৃতির রুদ্ররূপে কখনও কখনও বদলে যায় সুন্দরের সংজ্ঞাও। পূর্ণিমার চাঁদ কারো কারো কাছে ঝলসানো রুটিই মনে হয়।
ভয়ঙ্কর সুন্দর রাঙামাটি এখন সত্যি সত্যি ভয়ঙ্কর বিপদজনক। গানটা এখন পাল্টে গাইতে হবে, আহারে আহারে, আবার কবে যেতে পারবো পাহাড়ে? আগে তো মানুষ বাঁচুক, পাহাড় বাঁচুক; তারপর না হয় আমরা গিয়ে রোমান্টিক মুডে বলবো বাহ, কী চমৎকার। আমরা হয়তো ভুলেই যাবো, এই সৌন্দর্য্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে কতটা বেদনা, কতটা হাহাকার। এই সুন্দর পাহাড়ের ঢাল আসলে একেকটা মৃত্যু উপত্যকা।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ