X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘ইদ’কে ‘সংগততর’ ঘোষণা কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ?

বিধান রিবেরু
২৪ জুন ২০১৭, ১৪:১২আপডেট : ২৪ জুন ২০১৭, ১৫:০১

বিধান রিবেরু ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূমিকাতে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে উদ্দেশ্য করে লিখছেন—‘ভাষাতত্ত্বে প্রবীণ সুনীতিকুমারের সঙ্গে আমার তফাত এই—তিনি যেন ভাষা সম্বন্ধে ভূগোলবিজ্ঞানী, আর আমি যেন পায়ে-চলা পথের ভ্রমণকারী।’ রবীন্দ্রনাথ যদি ভাষার দুনিয়ায় পায়ে হাঁটা ভ্রমণকারী হন, তাহলে আমি এই দুনিয়ার এক গরিব ভবঘুরে মাত্র। পথে পথে ভাষার নানা নুড়িপাথর কুড়াই, সেটা দিয়ে মিথ্যা খেলো প্রাসাদ তৈরি করি, ভাবি আহা কী চমৎকার হলো! তবে পরক্ষণেই বুঝি তা ভ্রম। এই ভ্রমকে সঙ্গে করেই ভাষার দুনিয়ায় ঘোরাফেরা করি, সেখানে ঠাকুর কি চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, সেলাম ঠুকি। তবে এই পথে কিছু অসাধু কারবারি, প্রতারক, এমনকি স্বেচ্ছাচারীর সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঠোকাঠুকি লেগে যায়, তখন গা ঝেরে ওদের ‘স্পর্শ’ ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করি। ওদের ‘অন্যায়’ যেন আমার গায়ে না থাকে সেজন্য আমার হাত তৎপর হয়ে ওঠে। এই লেখা সেই তৎপরতারই একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র। বাংলা ভাষায় যে ‘বলাৎকার’ কর্মটি সম্পাদন করা হচ্ছে সেটি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন বোধ করছি বলেই, একান্ত ঠেকায় পড়ে, ভাষা ব্যবহারকারীর অধিকারবোধ থেকে এই লেখা লিখতে বসেছি।
উল্লিখিত বইতেই ঠাকুর বলছেন, ‘ভাষা বানিয়েছে মানুষ, এ কথা কিছু সত্য আবার অনেকখানি সত্য নয়। ভাষা যদি ব্যক্তিগত কোনো মানুষের বা দলের কৃত কার্যহত তা হলে তাকে বানানো বলতুম; কিন্তু ভাষা একটা সমগ্র জাতের লোকের মন থেকে, মুখ থেকে, ক্রমশই গড়ে উঠেছে। ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর জমিতে ভিন্ন ভিন্ন রকমের গাছপালা যেমন অভিব্যক্ত হয়ে ওঠে, ভাষার মূলপ্রকৃতিও তেমনি।’
বাংলা ভাষাতে এই ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির জমি থেকে আসা ভিন্ন ভিন্ন রকমের গাছপালা থেকে আসা শব্দ নিয়েই গড়ে উঠেছে শব্দ ভাণ্ডার, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষায় ‘বাঙ্গালা শব্দমালা’ বা Vocabulary। উৎপত্তি বিচারে এই শব্দমালাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে: তৎসম, অর্ধ তৎসম, তদ্ভব, প্রাকৃতভব (দেশী) ও বিদেশী। এখন তৎসম বা সংস্কৃতসম শব্দ বাদে অতৎসম শব্দের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি কিছু নিয়ম চালু করেছে। তার মধ্যে ২.১ নিয়মটি হলো অতৎসম শব্দের বেলায়নির্বিচারে ই, ই-কার, উ, উ-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন: আরবি, ইংরেজি, চুন, পুজো ইত্যাদি। এই নিয়ম নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা রয়েছে। ভাষাবিদ ডক্টর মনসুর মুসা যেমনটা বলেন, ‘ইংরেজী’ শব্দটি তো ‘ইংরেজী’ ভাষায় নেই, এমনকি এটি ‘তৎসম নয়, তদ্ভবও নয়, বিদেশি তো নয়ই, একেবারে বাংলা। এটা তো বিদেশি নয়, তাহলে এর দীর্ঘ ঈ-কার লোপ করে ই করা কেন?’ একেভাবেই ‘ফরাসি’ শব্দটির উদাহরণও দেন মনসুর মুসা।
এখনও পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর নিয়মকর্তারা দেননি। তারা ‘ভূগোলবিজ্ঞানী’, আমাদের যদি গোল খাইয়েও দেন, তাতে আমাদের বিশেষ কিছু করার থাকে না। ওই ২.১ আইনটির জোরেই পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র জামিল চৌধুরী আমাদের গোল খাইয়ে চলেছেন। বলা অপ্রয়োজনীয় নয়, জামিল চৌধুরী বিজ্ঞানের ছাত্র ও শিক্ষক, কিন্তু অভিধান রচনায় তিনি ব্রতী হয়েছেন। একাধিক অভিধান সম্পাদনা করে উপহার দিয়েছেন জাতিকে। সেই বিচারে এই পদার্থ বিজ্ঞানীকে বলা যেতেই পারে ‘ভূগোলবিজ্ঞানী’। সম্প্রতি প্রকাশিত আধুনিক বাংলা অভিধান শুদ্ধ নয়, নব্বইয়ের দশকে বের হওয়া বাংলা বানান অভিধানেও তিনি একই গোল দিয়েছেন। তখন সোরগোল হয়নি, কারণ লোকের চোখে সেভাবে পড়েনি, আর তখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম তখন আবিষ্কারই হয়নি। যাহোক, গোলটির নাম ঈদ/ইদ। জামিল চৌধুরীর মতে দুটোই ঠিক, তবে ‘ইদ’ হলো সংগততর ও অপ্রচলিত, আর ঈদ হলো অসংগত ও প্রচলিত।

মজার বিষয় ‘ঈদ’ ও ‘ইদ’ এই দুই বানান বাংলা একাডেমির বিভিন্ন অভিধানে থাকলেও সংগতি/অসংগিতর কথা উল্লেখ করেছেন শুধুমাত্র জামিল চৌধুরী। এই কথা উল্লেখের পেছনে সাফাই গাইতে তিনি বাংলা বানান অভিধানের শুরুতে ‘তীর’ শব্দটির উদাহরণ টেনেছেন। জামান সাহেব বলছেন, “সংস্কৃতে ‘তীর’ শব্দের অর্থ কূল বা তট এবং ফারসি ভাষায় এই শব্দের অর্থ বাণ বা শর। বাণ অর্থে ‘তীর’-এর উৎস ফারসি হওয়ায় শব্দটির দীর্ঘস্বর বর্জন করে ‘তীর’>‘তির’ করা হয়েছে।” একই যুক্তিতে তিনি ‘দূরবিন’, ‘পন্থি’, ‘দেশি’ বানানকেই সংগত বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু মনসুর মুসার ‘ইংরেজী/ইংরেজি’ সমস্যা নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। এখানে তিনি কী বলবেন সেটা আমি বলে দিই। তিনি বলবেন, নিয়মটি তো অতৎসম শব্দের বেলায় প্রযোজ্য, ‘ইংরেজি’ তো তৎসম নয়, বাংলা, তাই ওই নিয়ম খাটানো গেছে। আচ্ছা ভালো কথা। বানান অভিধান বা আধুনিক বাংলা অভিধানে যেভাবে আপনি অতৎসম বলে ‘ঈদ’ বানানকে অসংগত বলেছেন, সেভাবে ‘উনত্রিশ’ বা ‘উনসত্তর’ বানানকে কেন ‘অসংগত’ বলেননি? এগুলো তো সংস্কৃত শব্দ, অর্থাৎ তৎসম, এগুলোর মূল বানান তো যথাক্রমে ‘ঊনত্রিশ’ ও ‘ঊনসত্তর’, দুই বানানেই দীর্ঘ-উ। একই অভিধানে দুই শব্দের বেলায় দুই রকম মনোভঙ্গিটা কেন? তাহলে বলতে হয়, জামিল চৌধুরী সম্পাদিত অভিধানেই তো সঙ্গতির অভাব, তাই না?

বানানে সঙ্গতি আনার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের মানুষ ভাষাবিজ্ঞানে এসে যেভাবে ফতোয়া দিয়ে ‘ঈদ’কে অসঙ্গত বললেন, এটাকে বলাৎকার বললে কি ভুল বলা হবে? কেন বলছি এটি জোরজবরদস্তিমূলক বা বল প্রয়োগের ঘটনা এর পেছনে এক এক করে যুক্তিগুলো তুলে ধরছি।

ভাষাবিদ মনসুর মুসা ‘ঈদ’ শব্দটির ঐতিহ্যগত দিকটিকে প্রাধান্য দিয়ে বলছেন, ‘ঈদকে দীর্ঘ ‘ঈ’দিয়ে আবহমানকাল থেকেই লেখা হচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা হয় ‘Eid’। E-এর পর ওই I-টা লেখা হয় দীর্ঘ ‘ঈ’ স্বর বোঝানোর জন্যই। আমি যদি কারও নাম বদলাই, তা ভুল। এতে তার প্রতি অসম্মান প্রকাশ করা হয়। ঈদ তো একটা উৎসবের নাম। নাম ও ট্রেডমার্ক ইচ্ছামতো বদলানো ঠিক নয়। এটা হলো কর্তৃত্বের প্রশ্ন। আজাদ পত্রিকা ৫০ বছর চেষ্টা করেছে ইকবালকে একবাল, ইসলামকে এসলাম লিখতে। টেকেনি। ভাষা বেশি ইডিওসিনক্রেসি বা মতাচ্ছন্নতা পছন্দ করে না।’

মতাচ্ছন্নতা ঠিক নয়, মতিভ্রমও নয়, আমি বলবো ভাষার মেটাফোর ওরফে ব্যঞ্জনা বুঝতে না পারার ফল হলো এই জোর খাটানো। ভাষার মেটাফোর বুঝতে না পারার ফলেই ‘তীর’>‘তির’ হয়, আর ‘ইদ’ হয় সংগততর। মেটাফোর না বোঝার গণ্ডগোল ঠাকুরও করেছিলেন, কি/কী নিয়ে। সেই আলাপে পরে আসছি। ঈদ/ইদ শব্দের ফয়সলা আগে করে নিই।

ভাষাবিজ্ঞানী ডক্টর শিশির ভট্টাচার্যের মতো ডক্টর মনসুর মুসাও মনে করেন ঈদ এখন বাংলা শব্দ, এটি বাংলাভাষার অংশ, এটি বিদেশি শব্দ নয়, বিদেশি ভাষা থেকে আগত ঠিক আছে, কিন্তু শতশত বছর ধরে বঙ্গে সংসার করে এটি এখন এখানকারই স্থানীয়। যদিও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ‘ঈদ’কে বিদেশি শব্দ বলে একাধিকবার, একাধিক জায়গায় রাষ্ট্র করেছেন। উনিই জামিল চৌধুরীকে ডেকে আধুনিক বাংলা ভাষার অভিধানটি করার প্রস্তাব দেন। জামিল চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারেই একথা বলেছেন। তারা দুজনেই মনে করেন ‘ঈদ’ বিদেশি শব্দ তাই এটিকে ‘ইদ’ লিখলে ক্ষতি কি?

উত্তর দিচ্ছেন মনসুর মুসা, ‘বাঙালির মুখ দিয়ে যা বের হয়, তা-ই বাংলা বলে মানতে হবে। এর মধ্যে সংস্কৃত নেই, বিদেশি বলেও কিছু নেই। দেশি বা বিদেশি তো রাষ্ট্র দিয়ে ঠিক হয়, রাজনীতি দিয়ে চিহ্নিত হয়। এটা রাজনৈতিক ক্যাটাগরি। বিদেশে গেলে আমাদের পাসপোর্ট নিতে হয়। তাহলে পশ্চিমবঙ্গে যে বাংলা ব্যবহৃত হয়, তাকেও তো বিদেশি বলতে হয়। বিদেশি শব্দ যেকোনও ভাষা থেকে আসতে পারে। না জেনে কোনও ভাষাকে বিদেশি বলে দেওয়া ঠিক নয়। এসব আসলে লিখিত ভাষা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। ভাষার মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চিহ্নগুলো রক্ষা করাই আমার কাজ। দেশে যখন বানান-বাণিজ্য প্রবল হয়েছে, তখন আমি রক্ষণশীল। এটা রক্ষণশীল বনাম ভক্ষণশীলের দ্বন্দ্ব।’

ভক্ষণশীলদের একটি চরিত্র হলো বল প্রয়োগ করা, বল প্রয়োগের ধারণা থেকেই বলাৎকার শব্দটি এসেছে। বল প্রয়োগ বা জোরজবরদস্তিমূলক বানান বদলে ফেলার অপরনাম আপনি ফ্যাসিবাদও দিতে পারেন, মন চাইলে। ভাষার মধ্যে পাগলামি থাকে, ভাষার সবকিছুকে আপনি শাসন করে শৃঙ্খলায় আনতে পারবেন না। ভাষা নদীর মতো, আপন নিয়মে চলে। নদী শাসন করলে, তাকে ইচ্ছে মতো গতিপথ দেওয়ার চেষ্টা করলে সেটি ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে অন্যদিক দিয়ে পথ বের করে নেয়। নদীর মতো ভাষাও ‘সব সময়ে যুক্তি মানে না’, কথাটি ঠাকুর শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি, তিনি উদাহরণও দিয়েছেন। যেমন বাংলায় শব্দের দ্বিত্ব ঘটিয়ে যে ভাবপ্রকাশের রীতি রয়েছে: টাটকা-টাটকা, গরম-গরম, শীত-শীত ইত্যাদি। ঠাকুর বলছেন, ‘অর্থের অসংগতি, অত্যুক্তি, রূপক-ব্যবহার, তাতেও প্রকাশ হয় ভঙ্গির চাঞ্চল্য; অন্য ভাষাতেও আছে, কিন্তু বাংলায় আছে প্রচুর পরিমাণে।’

এই যে একই কথা দুবার বলা, এটা তো সঙ্গতিপূর্ণ নয়, একবার বললেই চলতো, কিন্তু চলে যে না, দুবার যে বলা হয় একই শব্দ, এটাই ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্য। এটাকে বুঝতে রবীন্দ্রনাথ ভুল করেননি। তিনি কবি। কিন্তু জামিল চৌধুরী কবিতা লিখেছেন কি না জানি না, লিখেছেন হয় তো, তবে বিষয়টি তিনি ধরতে পারেন নি। ধরতে পারলে ঈদ শব্দের মধ্যে অসঙ্গতি খুঁজে পেতেন না। বরং আমি তো দেখি এই শব্দটি আরো বেশি সঙ্গত, তাঁর প্রস্তাবিত ‘সংগতিপূর্ণ’ বানান ইদের চাইতে।

ভাষাবিজ্ঞানী শিশির ভট্টাচার্য্যের মতে বানানের নিয়ামক থাকে দুটি: এক, ধ্বনিতত্ত্ব ও দুই, ঐতিহ্য। ধ্বনি বা উচ্চারণ অনুসারে যদি বলা হয় তাহলে ঈদ উচ্চারণে দীর্ঘস্বরের উপস্থিতি রয়েছে। আরবি ‘আইন’, ‘ইয়া’ ও ‘দাল’ এই তিন অক্ষর মিলে বাংলায় ‘ঈদ’ হয়। ‘আইন’ ও ‘ইয়া’ থাকলে উচ্চারণ দীর্ঘ হওয়ার ইঙ্গিতই দেয়।

বিষয়টিকে যদি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও দেখি, ধ্বনিতত্ত্বের বিচারে দেখবো ঈদের উচ্চারণ করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এভাবে—ēd,এখনē–এর মানে কি? মানে হলো ‘ই’ উচ্চারণ করতে হবে একটু টেনে, স্বরকে দীর্ঘ করে। ইংরেজি হরফ ই-এর ওপরে ওই আনুভূমিক রেখাটির মানে— ফোনেটিক ভ্যালুতে বলা হয়— হাই লেভেল টোন। অর্থাৎ উচ্চারণ দীর্ঘস্বরে হবে। এই উদাহরণ আপনি ইন্টারনেটে পাবেন। আর যদি অক্সফোর্ডের অভিধান ঘাটেন, সেখানেও দীর্ঘস্বরে উচ্চারণের নির্দেশনাই দেখবেন। এখন বাংলা ভাষায় কথা বলার সময় দীর্ঘস্বর সেভাবে ধরা পড়ে না। সেটা না ধরা পড়লেও মূল উচ্চারণের এই বৈশিষ্ট্য যদি আপনি বানানে ধরে রাখতে পারেন তাহলে মন্দ কী? এই ধরে রাখার মধ্য দিয়ে আপনি মূল উচ্চারণকে নির্দেশ করতে পারছেন। এটা নিয়ে তো কারও কোনও সমস্যা হচ্ছিল না, শুধু সম্পাদক ও সম্পাদককে যিনি কাজটি দিয়েছেন তাদেরই কেন জানি ‘অসংগত’ ঠেকলো বানানটি।

ভাষায় শব্দ নিছকশব্দ নয়, প্রতীকও বটে। প্রতীক মানে যা দৃশ্যমান, কোথাও না কোথাও সেটির ফুটে উঠতে হয়, ইমেজ আকারে, মেটাফোর আকারে। এখন আমরা মুখে যে উচ্চারণ করি ‘ই’ সেটাই তো হ্রস্ব ও দীর্ঘ টানের তফাতে ‘ই’ ও ‘ঈ’ হয়, লিখিত ভাষায়। এই হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বরকে ফুটিয়ে তুলতে ইংরেজি বা আরবিতে ব্যবহৃত হয় ভিন্ন হরফ। এটাই হলো মেটাফোর।

‘ইদের’ পক্ষে যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, বাংলায় তো উচ্চারণে দীর্ঘস্বর অনুপস্থিত, তাই ‘ইদ’ টিকে যাবে, আমরা ‘ইদ’ ব্যবহার করতে পারি। মুখে অনেক সময় আপনি যা উচ্চারণ করেন, লেখায় তা নাও থাকতে পারে। যেমন ধরুন বাংলা শব্দ ‘আহ্বান’, এখানে কিন্তু হ+ব রয়েছে, কিন্তু আমরা কি ‘হ’ বা ‘ব’ উচ্চারণ করি? উচ্চারণ তো করি ‘আওভান্‌’। নরেন বিশ্বাস সম্পাদিত ‘বাঙলা উচ্চারণ অভিধান’ দেখুন, এমন উদাহরণ আরো পাবেন।‘স্বাক্ষর’ বানানের ‘ব’ কি উচ্চারিত? তাহলে অতৎসম শব্দ বলে যেটিকে দেগে দেওয়া হচ্ছে—‘ঈদ’—সেটির দীর্ঘস্বর উচ্চারিত হয় না বলেই ‘ইদ’ করে দিতে হবে? এই তরিকায় চললে তো দুনিয়ার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে। Psychology, Knife, Knight বানান নিয়ে আপনি কী করবেন? গোটা লিখিত সাহিত্য, দলিল, দস্তাবেজ আপনাকে উল্টেপাল্টে ফেলতে হবে। ওই যে ঠাকুর বলেছেন না, ভাষা সবসময় যুক্তি মানে না, ভাষা অনেকটা রাঁধুনির মতো। নিজের মতো করে মশলাযোগ করে খাদ্যকে সুস্বাদু করে তোলে। এই ‘সুস্বাদু’ শব্দটির কথাই ধরুন, আপনি কি একে ‘সুসবাদু’ বলে উচ্চারণ করেন?  জামিল চৌধুরী হয় তো এখানে যুক্তি দেবেন এটি তো সংস্কৃত শব্দ। ঠিক আছে সংস্কৃত শব্দ, আমি বলতে চাইছি উচ্চারণকে যদি আপনি যুক্তির খুটি ধরেন তাহলে ‘সুস্বাদু’ সঙ্গত হলে ‘ঈদ’ও সঙ্গত। শব্দকে তৎসম ও অতৎসম এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করে বানান সংস্কারে হাত দিলে গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলার একটা শঙ্কা তৈরি হয়। শঙ্কা আর নেই, গণ্ডগোল তো বেধেই গেছে।

জামিল চৌধুরীর যুক্তি বিশুদ্ধ যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম, অতৎসম শব্দ ‘ঈদ’, তাতে হলোটা কি? সংস্কৃত থেকে আসেনি এই শব্দ, তো হলো কী? বাংলা ভাষার শব্দ তো, নাকি? তাহলে তো এটি আপনার ফর্মুলাতে পড়ে না। যা বাংলার তাতে ওরকম উৎপত্তিকে ভিত্তি করে ভাগাভাগি করাটা দৃষ্টিকটু। কিছুক্ষণ আগে যে শব্দটি বললাম—‘ফর্মুলা’— এখানে কিন্তু আপনাদের ২.১ নম্বর ফতোয়া খেটে গেছে অক্ষরে অক্ষরে। এর কারণ এটি একটি বিদেশি শব্দ, এবং এর বাংলা অর্থ রয়েছে—‘সূত্র’—কিন্তু ‘ঈদে’র অর্থ বাংলায় আছে কি আদৌ? যে শব্দ বাংলা শব্দভাণ্ডারে যুগযুগ ধরে বহাল তবিয়তে আছে, সেটিকে আপনি এক সম্পদনার খোচায় ‘অসংগত’ বলে দিলেন, এটা কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ আচরণ?

এই যে যুগযুগ ধরে ‘ঈদ’ বানানটি আছে, সেটিই হলো বানানের দ্বিতীয় নিয়ামক, ঐতিহ্য। সাহিত্য বলেন, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বলেন, সব জায়গাতেই ‘ঈদ’ প্রচলিত, ‘ইদ’ নয়। কাজেই ভাষা সব জায়গায় যুক্তি না মানলেও, এখানে কিন্তু ঠিকই যুক্তি মেনে ‘ঈদ’ হয়েছে। পরিতাপের বিষয় জামিল চৌধুরী এটিকেই বলছেন ‘অসংগত বানান’! এটির বীজ আসলে ভাষার ব্যঞ্জনা বা মেটাফোর বুঝতে না পারার কারণের মধ্যেই নিহিত।

ভাষার ব্যঞ্জনা কী বস্তু? সংজ্ঞার চেয়ে উদাহরণ শ্রেয়। সুকুমার রায় ‘শব্দ কল্প দ্রুম’ ছড়াটি লিখেছেন এই ব্যঞ্জনার জোড়েই—‘ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম্ দ্রাম্, শুনে লাগে খটকা/ ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা!’ ফুলও ফোটে, পটকাও ফোটে। এমন উদাহরণ শুধু বাংলা ভাষায় নয়, বিদেশি ভাষাতেও লক্ষ লক্ষ পাবেন। তারপরও জামিল চৌধুরীর ‘তীর’>’তির’ করতে হয়। এখানে নয় দুটিহাতল (দীর্ঘ ই-কার ও হ্রস্ব ই-কার) ছিল বলে রক্ষা, সুকুমার রায়ের ‘ফোটা’তে কী করবেন? সেখানেও তো দুই অর্থ, এক উচ্চারণ, তাহলে? সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ হলেই বানান বদলে দিতে হবে? তাহলে ভাষার যে মেটাফোর/ব্যঞ্জনা ও মেটোনিমি/লক্ষণা সেটি ধুয়ে মুছে যাবে, ভাষা পরিণত হবে পদার্থবিজ্ঞানে। ভাষা তো সেটি নয়। জামিল চৌধুরী গংদের একাংশের দাবি বাংলা ভাষায় দীর্ঘস্বরের উপস্থিতি শ্রবণে ঠেকে না বলে, ঈদকে ‘ইদ’ করা সঙ্গত, তাহলে সকল ‘কী’কে ‘কি’ করে দিন। সেটা তো দিচ্ছেন না? কেন দিচ্ছেন না? সেখাও সেই ব্যঞ্জনা না বোঝার মামলা হাজির রয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম অব্যয় ও সর্বনামের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য ভিন্ন বানানের প্রস্তাব করেন, “প্রশ্নসূচক ‘কি’শব্দের অনুরূপ আর-একটি ‘কি’ আছে, তাকে দীর্ঘস্বর দিয়ে লেখাই কর্তব্য। এ অব্যয় নয়, এ সর্বনাম। এ তার প্রকৃত অর্থের প্রয়োজন সেরে মাঝে মাঝে খোঁচা দেবার কাজে লাগে। যেমন: কী তোমার ছিরি, কী যে তোমার বুদ্ধি।”

ডক্টর সলিমুল্লাহ খান ‘ঠাকুরের সহিত বিচারে’ বলছেন, “রামমোহন ভাল করিয়া পড়া থাকিলে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়া লইতেন, বাংলায় ‘কি’শব্দ একটাই। কারকভেদে (অথবা রামমোহনের ভাষায় ‘পরিণমন’বা ‘পরিণাম’ভেদে) ইহার রূপভেদ হয় মাত্র। যেমন ‘কি’ শব্দ কর্তৃকারকে (রামমোহনের ভাষায় ‘অভিহিত’পদে) যেমন ‘কি’ কর্মকারকেও তেমনি ‘কি’ই। অধিকরণে ‘কিসে’অথবা ‘কিসেতে’আর সম্বন্ধে ‘কিসের’। সবগুলিই ‘কি’ শব্দের আত্মীয়রূপ বৈ নহে।”

দুঃখের বিষয় রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ না করলেও বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি কোনও বাক্য খরচ না করেই গ্রহণ করেছে। ভিন্ন আরেক প্রবন্ধে—‘বাংলা বানানের যম ও নিয়ম’—সলিমুল্লাহ খান বলছেন, “‘কি’ ও ‘কী’ বানানের নিয়ম কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তো আদপেই নির্ধারণ করেন নাই। অথচ বাংলা একাডেমীই এই বিকল্প বাড়াইতেছেন। সত্যের অনুরোধে বলিতে হইবে, বিশ্বভারতী নিয়মটির প্রস্তাব করিলেন। আর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বিচার করিয়া শেষে এই বিকল্প প্রত্যাখ্যানই করিয়াছিলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গৃহিত ‘বাংলা বানানের নিয়ম,’তৃতীয় সংস্করণে ইহার কোন সদ্ভাব নাই, অভাবই বরং প্রকট। কেননা দ্বিতীয় সংস্করণে এই প্রস্তাব ছাপাও হইয়াছিল। যদিও প্রথম সংস্করণে ইহা ছাপার হরফে হাজির হয় নাই। তিনটি সংস্করণ মিলাইয়া দেখিলে আমার কথার প্রমাণ পাইবেন।”

অথচ রবীন্দ্রনাথের আগে রচিত সকল পুঁথি ও সাহিত্যে ‘কি’ দিয়ে দিব্যি অব্যয় ও সর্বনামের কাজ চালানো গেছে। শব্দের নানা ব্যঞ্জনা থাকে বলেই ভাষা দিয়ে কবিতা রচনা করা যায়, এটি কবিগুরু যেমন ধরতে পারেন নি, তেমনি এখানকার গুরুরাও বুঝতে পারেননি। সলিমুল্লাহ খান বলছেন, “প্রাচীন বাংলা হইতে রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা পর্যন্ত সমগ্র বাংলা সাহিত্য খুঁটিয়া খুঁটিয়া দেখিবেন, কোথাও অর্থ প্রকাশের সুবিধার নিমিত্ত ‘কী’লেখা হয় নাই। চর্যাপদ ওরফে ‘বৌদ্ধগান ও দোঁহা’নামে অভিহিত পুরাতন বাংলা কেতাবটিতে কোথাও ‘কী’নাই।…পরাধীন যুগের বাংলা সাহিত্যের কোথাও আপনি একটা ‘কি’ শব্দও খুঁজিয়া পাইবেন না যাহার বানান ‘কী’। কি প্যারীচাঁদ মিত্র, কি কালীপ্রসন্ন সিংহ, কি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাঁহারও রচনায় আপনি একটিও ‘কী’বানান পাইবেন না। অথচ হেন অর্থ নাই, কি সর্বনাম, কি অব্যয়, কি ক্রিয়া-বিশেষণ, কি শুদ্ধ বিশেষণ সমস্ত ব্যবহারেই ‘কি’চালাইয়া আসিয়াছেন ইঁহারা। অর্থ প্রকাশে কোথাও তো কোন ব্যাঘাত হইয়াছে বলিয়া আমাদের মনে হয় নাই।”।

শব্দের রূপ ও রূপান্তর না বোঝার বোঝা স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়ে জামিল চৌধুরীও সেকারণেই ‘তীর’কে ‘তির’ করে দেন। ‘ঈদ’কে করেন ‘ইদ’। বাঙালির জীবনে ঈদ যে সামাজিকতা ও আনন্দ নিয়ে আসে, যে ঐতিহ্য নিয়ে হাজির হয়, সেটিই রূপক আকারে হাজির হয় ‘ঈদ’ শব্দে; বাস্তবের ঈদ, ঈদের আনন্দ, খাওয়াদাওয়া, পোশাক আশাক, সকল কিছুর রূপান্তর ঘটে ‘ঈদ’ শব্দে। যারা ফার্দিনান দ্যো সস্যুরের বক্তৃতা পড়েছেন তারা জানেন সিগনিফায়ার বা পদ কিভাবে ভাষায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে। একটি শব্দকে শুধুমাত্র তৎসম আর অতৎসম বিচারে ফেলে, সেটির অঙ্গচ্ছেদ করলে, তাকে বলাৎকারই বলে। এর কারণ শব্দে কেবল উৎপত্তিজাত ডাইকোটমি থাকে না, শব্দের ভেতর ডিনোটেশন (Denotation, অর্থকেন্দ্রিক বোধ) থাকে, থাকে কোনোটেশন (Connotation, অর্থবিকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা)।একটি শব্দ যখন উচ্চারিত হয়, তখন সেটি ইমেজ আকারে আমাদের কল্পনায় ধরা দেয়, সেটি শুধু মাত্রই একটি শব্দ নয়, শব্দের সঙ্গে অভিজ্ঞতা ও বোঝাপড়াও যুক্ত। ‘ঈদ’বললে চলে আসে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, ঈদি, ঈদগাহ প্রভৃতি। এটিই শব্দের ডিনোটেশন। আর কোনোটেশন হলো শব্দের সঙ্গে জড়িত মানুষের যে অভিজ্ঞতা, গত ঈদগুলো যেভাবে কেটেছে সেসবের স্মৃতি।এখন ডিনোটেশন ও কোনোটেশন মিলে ‘ঈদ’ আমাদের ভাবজগতে চমৎকারভাবেই বসবাস করছিলো, করছে। এটাই ঐতিহ্যের অংশ।

এখন কেন ‘ঈদ’ হয়ে যাচ্ছে ‘ইদ’, কেনই বা ‘তীর’ হয়ে যাচ্ছে ‘তির’, আর পার্থক্য হচ্ছে ‘কি’ ও ‘কী’তে? মোটামুটি তিনটি কারণ চিহ্নিত করা যায় এর পেছনে?প্রথম কারণ হলো কতিপয় ভাষার কারবারী মেটাফোর বা ব্যঞ্জনার কারসাজি ঠিক ধরতে পারেন না, এই কারণেই গোল বাধে।কেন এমনটা হয়? রুশ-মার্কিন ভাষাতাত্ত্বিক রোমান জ্যাকবসনের বরাত দিয়ে সলিমুল্লাহ খান বলছেন, যারা ভাষার ব্যঞ্জনা ধরতে পারেন না,তাঁদের সামঞ্জস্য-বৈকল্য (similarity disorder) বা ব্যঞ্জনালোপ ব্যাধির মতো কিছু হলেও হয়ে থাকতে পারে।

দ্বিতীয় কারণ হলো বানান সংস্কারের ক্ষেত্রে বা নতুন বানান প্রস্তাবের ক্ষেত্রে প্রথমেই শব্দভাণ্ডারকে উৎপত্তিজাত বিভাজনের উপর দাঁড় করিয়ে দেয়া বা এটাকেই স্ট্যান্ডার্ড ধরে নিয়ে তারপর বানান নিয়ে ভাবা। দ্বিতীয় এই কারণটির উদ্ভব হয়েছে তৃতীয় কারণের জন্যই। সেই তৃতীয় কারণ হলো কতিপয় ‘ভূগোলবিজ্ঞানী’ ধরেই নিয়েছেনবাংলা এসেছে সংস্কৃত থেকে। এই ধারণাটি কতটুকু সত্য? যেখানে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো মানুষও সন্দেহ প্রকাশ করছেন, সেখানে উনারা কিভাবে এতোটা নিশ্চিত হন?গোলটা বাধে আসলে যখন কেউ ধরেই নেন উৎপত্তির বিচারে বাংলা শব্দ দুই প্রকার: সংস্কৃত বা তৎসম, আর অসংস্কৃত বা অতৎসম। এখন এই দুই ভাগে ভাগ করে আপনি চাপিয়ে দিলেন অতৎসম শব্দের বানানে সব হ্রস্ব-ই, হ্রস্ব-উ এবং এগুলোর –কার ব্যবহৃত হবে। এই যে নিয়মটি করলেন, সেটির ভিত্তি কি? বানান সহজ করা?শুরুতেই তো বলেছি জেদাজেদি ভালো কিছু নয়, অন্তত নদী ও ভাষার ক্ষেত্রে?ব্যাকরণবিদদের কাজ কি?ব্যবহারকারীদের উপর নিয়ম চাপিয়ে জুলুম করা?না কি ভাষায় নিয়মের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করা ও সকলকে সেটা জানানো? কোটি কোটি মানুষের মুখের ভাষার উপর আপনি তো নিয়ম চাপিয়ে দিতে পারেন না। শব্দকে অতৎসমের গোত্রে ফেলে দীর্ঘ-ই’র লেজছেটে দেয়ার নিয়ম কোথা থেকে পেলেন, যেখান থেকে পেলেন সেটার গ্রহণযোগ্যতাই বা কতটুকু? আমার মনে হয় এসব নিয়েও প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। বাংলা ভাষায় এখনো পর্যন্ত একটি সুন্দর ব্যাকরণ বই না থাকার পেছনের কারণ এগুলো নিয়ে সহজে কেউ প্রশ্ন করেন না।কেউ আজ  জোর গলায় জিজ্ঞেস করেন না, বাংলা যে সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে, মুণ্ডা থেকে আসেনি সেটা কি করে প্রমাণ করবেন?

ব্যতিক্রম সলিমুল্লাহ খান, তিনি বলছেন, “সিলবাঁ লেবি, জঁ পসিলুস্কি প্রভৃতি কতকগুলি বিদেশি পণ্ডিতের দোহাইক্রমে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একদিন খানিক ভিন্নকথা বলিবার কোশেশ করিয়াছিলেন। তাঁহার মতে বাংলার গর্ভে সংস্কৃতিতের টনটন বীর্য পড়িলেও এই ভাষার পেটে কিন্তু মুণ্ডা মহাজাতির আণ্ডাবাচ্চা। এই গবেষণা বেশিদূর চলে নাই। (শহীদুল্লাহ, ‘মুণ্ডা এফিনিটিস,’) ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ বইয়ে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলিয়াছেন, ‘আলোচনা শেষ করিবার পূর্বে একটি কথা বলা দরকার। অস্ট্রিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষার ব্যাকরণ ও অভিধানের অভাবে পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক আলোচনা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নাই’।” বাংলা কেন সংস্কৃত নয়—সলিমুল্লাহ খান বলেন—এই প্রশ্নের উত্তর মুণ্ডা ভাষাগোষ্ঠীর ব্যবহার হতেই পাওয়া যাবে। মুণ্ডা ভাষার আলোচনা বাদ দিয়ে বাংলা বানানের নিয়ম বের করা আর ডিম ছাড়া মুরগি বানানো একই কথা।

পরিহাসের বিষয় এই ডিম ছাড়া মুরগি দিয়েই মুরগি-মাসাল্লাম তৈরি করে নানাবিধ অভিধানে পরিবেশন করা হচ্ছে। এই রূপে বানানের নিয়ম বের করার ভিত্তিটাই নড়বড়ে। ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ প্রকাশ হয় প্রথমবারের মতো। এবং সেটি ছাপানোর আগে নয়, পরে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে পাঠানো হয়, আবার সেটা সঠিক কতজনের কাছে পাঠানো হয়েছে সেই সংখ্যাও জানা যায় না। যে একাডেমি ও ‘ভূগোলবিজ্ঞানীরা’ কথায় কথায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোহাই দেন, তারাই কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ অনুসরণ করেন না। একাডেমি বানান সংস্কার করে গোটা কয়েক ‘পণ্ডিত’দের নিয়ে, সেখানে অন্যের মতামত নেওয়ার ইচ্ছা যতটা থাকে, তারচেয়ে বেশি থাকে নিজেদের মতামত অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বানান সংকলনের জন্য যে সমিতি তৈরি করা হয়েছিল সেটির সদস্য বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের ‘বঙ্গভাষা ও বঙ্গসংস্কৃতি’ বই থেকে দেখা যায়, প্রায় দুশো বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপকের অভিমত আলোচনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োজিত সমিতি বানানের নিয়ম সংকলিত করেছিলো। প্রত্যেককেই বানান ও ভাষা সম্পর্কিত তিনশ বা চারশ প্রশ্ন করা হয়েছিল। সেসব প্রশ্নের জবাব যুক্তি দিয়ে যাচাইবাছাই করার পর সমিতির সদস্যদের মতৈক্যের ভিত্তিতেই বানানের বিধি রচিত হয়েছিলো।

কাজটি কিন্তু এখন আরো সহজ হয়ে গেছে। কারণ এখন আপনাকে আর প্রশ্ন ছাপানোর ও সেগুলো প্রেরণের কষ্ট না করলেও চলে। ওয়েবসাইট বানিয়ে, আমন্ত্রিতদের নিবন্ধিকরণের মাধ্যমে প্রশ্নোত্তর আহ্বান করা যেতে পারে। এরপর কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত কমিটির সদস্যরা সেই সাইটেই তাঁদের মতৈক্য বা মতানৈক্য প্রকাশ করতে পারেন। এই বাহাস চলতে পারে বছরব্যাপী। এতে খরচ একেবারেই কম, যেহেতু ব্যবহার হবে অনলাইন মাধ্যম। বানান বা ভাষা সংক্রান্ত এই যে পরিবর্তন সেগুলো প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে, অনেক মানুষকে যুক্ত করে, গণতান্ত্রিক উপায়ে করা যেতে পারে। আপাতত এতটুকুই। 

সহায়:
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বাংলা-ভাষা পরিচয়, রবীন্দ্র-রচনাবলী,বিশ্বভারতী, অগ্রাহায়ন ১৪২১, কলকাতা।
২. ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাঙ্গালা ব্যাকরণ, মাওলা ব্রাদার্স, শ্রাবণ ১৪১০, ঢাকা।
৩. মনসুর মুসা, ঈদ বানানে সমস্যা কোথায়?, প্রথম আলো অনলাইন, ২২ জুন ২০১৭, লিংক: http://bit.ly/2swU0o0
৪. সলিমুল্লাহ খান, বাংলা বানানের যম ও নিয়ম,শিল্পসাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা ‘নতুনধারা’, ৭ম সংখ্যা, ১৫ মে ২০১০।
৫. সলিমুল্লাহ খান, ঠাকুরের সহিত বিচার: বাংলা বানানে হ্রস্ব ইকার, শিল্পসাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা ‘নতুনধারা’, ৮ম সংখ্যা, ১৫ জুন ২০১০।
৬. ডক্টর শিশির ভট্টাচার্য্য, ‘ঈদ’ না ‘ইদ’?, ২২ জুন ২০১৭, এনটিভি অনলাইন, লিংক: http://bit.ly/2t1KTw3
৭. বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, জামিল চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত, বৈশাখ ১৪২৩, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
৮. বাংলা একাডেমি বাংলা বানান-অভিধান, জামিল চৌধুরী কর্তৃক সংকলিত ও সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, মাঘ ১৪২১, ঢাকা।
৯. বাংলা একাডেমী বাঙলা উচ্চারণ অভিধান, নরেন বিশ্বাস সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, মাঘ ১৪০৫, ঢাকা।
১০. জামিল চৌধুরীর সাক্ষাৎকার, এই অভিধানে আমরা ‘গাছবিশেষ’ বা ফুলবিশেষ লিখে ছেড়ে দিইনি: জামিল চৌধুরী, ১ এপ্রিল ২০১৬, প্রথম আলো, লিংক: http://bit.ly/2sZMUJ4
১১. প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম, বাংলা একাডেমি, আশ্বিন ১৪১৯, ঢাকা।
১২. সুকুমার রায়, শব্দ কল্প দ্রুম, সুকুমার রায় সাহিত্য সমগ্র (প্রথম খণ্ড), সত্যজিৎ রায় ও পার্থ বসু সম্পাদিত, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৪, কলকাতা।
১৩. John Lyons, Language and linguistics: an introduction, Cambridge University Press, 1981, India.
১৪. Oxford Advanced Learner’s Dictionary, Edited by Sally Wehmeier, Oxford University Press, 2002, China.
লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক      

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ