X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

এবার পিষ্ট হবে তুমিও...

শুভ কিবরিয়া
০৪ জুলাই ২০১৭, ১৭:৩৯আপডেট : ০৪ জুলাই ২০১৭, ১৭:৪৮

শুভ কিবরিয়া দু’দিন ধরে ফেসবুক সরগরম। দু’পক্ষেই বিস্তর যুক্তি-প্রশ্ন উত্থাপন চলছে। কেউ বলছেন তিনি স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছেন, কেউ বলছেন তিনি অপহৃত হয়েছেন। যার যার রাজনৈতিক অবস্থান সমর্থন করেই এই ঘটনার বিষয়ে নিজেদের ক্ষোভ, ঘৃণা, পছন্দ-অপছন্দ সব উগরে দিচ্ছেন যে যার মতো। একটা বিপত্তিকর পরিস্থিতিতে ঘটনার পরিণতি দেখার জন্য যে ধরনের অপেক্ষা দরকার হয়, সেই পর্যন্ত ধৈর্য্য না করেই একদল অতি উৎসাহী মানুষ তাদের হিংসাজাত মতামত রেখে চলেছেন। একদল মানুষ যারা বাম রাজনীতির স্কুলিংয়ে বড় হয়েছেন, যারা যুক্তিকে আবেগের চেয়ে বড় বলে দীক্ষা নিয়েছেন, তারাই দেখলাম এই ঘটনায় সবচেয়ে অসাধু ভাষায়, চরমতম বিদ্বেষে, এক ধরনের পৈশাচিক উল্লাসে তাদের ফেসবুক রাঙিয়ে চলেছেন। সেই তুলনায় বরং প্রত্যক্ষভাবে যারা মূল রাজনীতির সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত, এই ঘটনায় তাদের অভিব্যক্তি অনেকটাই সহনশীল। তারা ঘটনার একটা পরিণতি পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন। বাস্তব অবস্থা এবং ঘটনা পরম্পরার মোড় পরিবর্তন বুঝতে চেয়েছেন।
কবি, প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার পরের দিন এবং উদ্ধার হওয়ার পরদিন পর্যন্ত ফেসবুকের নানাজনের কমেন্ট, স্ট্যাটাস পড়ে এইটুকু নিশ্চিত হয়েছি উভয়পক্ষেই আমাদের অনেক ঘৃণা জমেছে। একটা বড় উপলক্ষ পেলে এই বিদ্বেষ পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করতে দ্বিধা করবে না। যারা বাংলাদেশকে বহুধা বিভক্ত করে, এখানকার আত্মশক্তিকে খণ্ডিত করে নানাভাবে ফায়দা নিতে চায় তারা বেশ সাফল্য যে পেয়েছে জাতির জীবনে নানান ঘটনায় তার প্রমাণ মিলছে। এবারও মিলল। এটা কুলক্ষণ কিনা বলতে পারি না। তবে এই সময়ে বেশ কিছু সংবেদনশিল স্থিত বাণিও দেখেছি ফেসবুকে বন্ধুদের স্ট্যাটাসে।
তার একটি হলো স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত বাণি- ‘আমি তোমার মত মানি না, কিন্তু তুমি যাতে অবাধে তোমার মত প্রকাশ করতে পারো, সেটা নিশ্চিত করার জন্য আমি নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত।’ আর খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে, জার্মানির নাৎসি বিরোধি ধর্মযাজক, কবি ও গ্রন্থকার মার্টিন নাইমোলার (১৮৯২-১৯৮৪)-এর বিখ্যাত সেই ‘ফার্স্ট দে কেম’ বা ‘ওরা প্রথমত এসেছিল’ কবিতার আলোচিত পংক্তিমালা:
‘যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কোনও কথা বলিনি,

কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।

তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেলো, আমি নীরব ছিলাম,

কারণ আমি শ্রমিক নই।

তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে, আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,

কারণ আমি ইহুদি নই।

আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে, আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,

কারণ আমি ক্যাথলিক নই।

শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,

আমার পক্ষে কেউ কোনও কথা বললো না, কারণ, কথা বলার মতো তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।’

দুই.

বাংলাদেশ সেই পরিস্থিতির দিকে এগুচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বা সেইরকম পরিস্থিতি দেখা দিলে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে আলোকপথে হাঁটার উপায় কী হতে পারে সেটা নিয়েও আলোচনা চলতে পারে। তবে সবচেয়ে আগে যেটা দরকার অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতার একটা পরিবেশ তৈরি জরুরি। রাজনীতিতে না পারা গেলেও রাজনীতির বাইরে অন্তত অন্যের কথা ধৈর্য্য সহকারে শোনা দরকার। সবার সব বিষয়ে একমত হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। কিন্তু সবাই যাতে তার কথাটা বলতে পারে এবং অন্যরা যাতে সেটা শুনতে পারে সেই ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করা জরুরি। রাজনীতির বাইরের সমাজে এই অভ্যেসটা তৈরি হলে রাজনীতির ওপর তার প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশে সেইরকম সমাজ নির্মাণটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

সমাজের সেই চ্যালেঞ্জটা উপেক্ষা করলে আমাদের পরিস্থিতি কোনদিকে গড়ায় এবং শেষাবধি তা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় কী না সেইটে দেখার বিষয়।

তিন.

এইরকম পরিস্থিতিতে আমার খুব করে মনে পড়ে ইরানের নোবেল বিজয়ী ভীন্নমতাবলম্বি মানবাধিকার কর্মী শিরিন এবাদির লেখা ‘জেগে ওঠছে ইরান’ বইটির কথা। ইসলামি বিপ্লবোত্তর সেক্যুলার সমাজ কিভাবে নিপীড়ক হয়ে ওঠে, সেই নিপীড়কের বিরোধিতা করতে গিয়ে ইসলামপন্থীদের সমর্থন কিভাবে বাড়ে, আবার ধীরে ধীরে ইসলামি বিপ্লবিরা কিভাবে নিপীড়ন যন্ত্র চালু করে তার এক অনুপম বর্ণনা আছে এই বইটিতে। একটি ঘটনা এরকম- ‘সরকার বললো, দেশে জার্মান চর প্রবেশ করেছে। কিন্তু কে? কোথায়? সরকার সন্দেহ করলো অত্যন্ত বিনয়ী সাংবাদিক ফারাজ সারকুহিকে। ফারাজ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনেরও সদস্য ছিলেন। তার দুর্ভাগ্য, জার্মানে ওর পরিবার বাস করে। তাছাড়া জার্মান কূটনীতিকের বাড়িতে ডিনারের সময় যেবার ঘেরাও করা হয়েছিলো, সেবার ফারাজও ছিল ওই পার্টিতে। ব্যস, ফলাও করে ওই ঘটনাকে ফারাজের গোয়েন্দাগিরির আলামত হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে।

এক সন্ধ্যায় জার্মানি যাওয়ার উদ্দেশে মেহরাবাদ বিমানবন্দরে গিয়েছিলো ফারাজ। কিন্তু আর কোনও খোঁজ নেই। জার্মানি থেকে ফারাজের স্ত্রী জানালো সে জার্মানি পৌঁছায়নি। অথচ বিমানবন্দরের রেকর্ড বলছে, তার পাসপোর্ট সিল দিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। মাসখানেক পর তাকে আবার মেহরাবাদ বিমানবন্দরে দেখা গেলো। ও বললো, জার্মানিতে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে পালিয়ে গিয়েছিলো তাজিকিস্তান এবং জর্জিয়ায়। ওকে আটক করা বা গুম করার কথা কিছুই বলেনি, আমরাও বোকা বনে গেলাম। নাটকীয় ওই সময়ে হঠাৎ করেই তেহরানের বই দোকানগুলোতে ওর হাতের লেখা চিঠির ফটোকপি পাওয়া যেতে লাগলো। চিঠিতে বিস্তারিত বিবরণ আছে কিভাবে বিমানবন্দর থেকে ওকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং রহস্যজনকভাবে ফেরত পাঠানো হয়। চিঠিতে আছে, জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে তারা চাপ দিয়ে ক্যামেরার সামনে জার্মানির গোয়েন্দাগিরির বিষয়ে ফারাজের স্বীকারোক্তি নেয়। নারী সংসর্গের ব্যাপারেও স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয় তাকে। সে লিখেছে, ‘আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং আমি নিশ্চিত, আমাকে মেরে ফেলা হবে।’ এ ঘটনার দু’সপ্তাহ পরে আবার তাকে গ্রেফতার করা হয়।’

চার.

লেখক শিরিন এবাদি ছিলেন ফারাজ সারকুহিকের আইনজীবী। তার অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন এভাবেই, ‘একদিন বিকেলবেলা আমার অফিসে আসলেন ফারাজের মা। বৃদ্ধা মহিলা আমার সামনের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলেন, ফারাজের মামলাটি আমি নিতে পারবো কিনা। বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি বললেন, শাহ আমলেও ফারাজ কারাভোগ করেছে। তারপরও? শাহ আমলের কারাবাসের স্মৃতি বলেছেন ফারাজের মা।’

ফারাজের এক বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। ভাগ্য ভালো। সে জীবিত অবস্থায় বেরিয়ে আসে। কারামুক্ত হয়ে ফারাজ শিরিন এবাদিকে ডিনারের নিমন্ত্রণ করে। এখানে সে যা বলে তা বর্ণনা করেছেন লেখক এভাবে, ‘সে বললো, সে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়। কিন্তু পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলেই আবার ওকে গ্রেফতার করা হবে ভেবে সে ভীত। আমি আশ্বস্ত করলাম, ‘ভয় পাবেন না, আমি সঙ্গে যাবো।’ পরদিন আমরা তেহরানের পাসপোর্ট অফিসে যাই, ভয়ে ভয়ে ঢুকলো ফারাজ। পাসপোর্ট পেয়ে ইরান ছেড়ে জার্মানি চলে যায় ফারাজ। আর কখনো ফেরেনি।’

পাঁচ.

শিরিন এবাদির অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগতে পারে আমাদেরও। তিনি লিখেছেন, ‘সন্দেহভাজন বিরোধীদের কিভাবে শাস্তি দেয় রাষ্ট্র, ফারাজের ঘটনার মাধ্যমে সেটা পুরোপুরি বুঝতে পারলাম আমরা। বিদেশিদের চর কিংবা সরকার পতন আন্দোলনের সদস্য, যেভাবেই সন্দেহ করা হোক না কেন, শাস্তি একই রকমের। এবং সেই নির্যাতন এতোটাই সুচারু যে, শরীরে কোনও দাগ দেখা যাবে না। অথচ মিথ্যে স্বীকারোক্তি রেকর্ড করে জাতীয় টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হতো। নির্ঘুম রাত কাটাতে বাধ্য করা, প্রহসনের মৃত্যুদণ্ড, পায়ের তলায় চাবুকের আঘাত থেকে শুরু করে গণগ্রেফতার, ইত্যাদি খবরে ভরপুর থাকতো সংবাদপত্রগুলো। নিঃসঙ্গ কারাবাসের কক্ষের সাইজ শিয়ালের গর্তের চাইতেও ছোট। এক কথায় সাবাক বাহিনীর নির্যাতনের বিকল্প হিসাবে এসব পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। নখ তুলে নেওয়া, বা বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার পদ্ধতি তুলে নেওয়া হয়েছে। তাই কারাবাস শেষেও দণ্ডপ্রাপ্তদের কারও গায়ে তেমন কোনও নির্যাতনের দাগ পাওয়া যেতো না। হয়তো ততদিনে তিরিশ পাউন্ড ওজন কমে গেছে, রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, তবু রাষ্ট্র বিশ্বের কাছে বুক ফুলিয়ে বলতে পারে, দেখো, আমার আসামীর গায়ে কোনও শারীরিক আঘাতের চিহ্ন নেই।’

ছয়.

রাষ্ট্রকে তাই একটা বিপদজনক মাত্রার বাইরে যেতে দিতে নেই। রাষ্ট্র নিজে নিপীড়ক হয়ে উঠলে কারও আর রক্ষা নেই। যেই ক্ষমতায় বসবে নির্বিবাদে সে তার বিরোধিদের নিপীড়নের মাধ্যমে দমন করতে চাইবে। আজ একপক্ষ নির্যাতন সইবে, পাশার দান উল্টে গেলে অন্যপক্ষকেও সেই বিভীষিকার মধ্যে যেতে হবে। এটা একটা প্রক্রিয়া। পৃথিবীর দেশে দেশে এটা চলেছে। এর পরিণাম কী হয় তাও অজানা নয়। রাষ্ট্রকে তাই অসহিষ্ণুতা আর নিষ্ঠুরতার পথে যেতে প্রবলভাবে বাধা দিতে হয়। জনসমাজের তাই উচিত নিজেদের হিংসা-ঘৃণা-বিদ্বেষকে সংবরণ করা। নইলে জনসমাজের এই রোগ রাষ্ট্রকে আক্রান্ত করতে পারে। রাষ্ট্র এই রোগে আক্রান্ত হলে কারও রক্ষা পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। অন্যের নিপীড়ন দেখে যে আজ হাততালি দিচ্ছে কাল সেও পিষ্ট হতে পারে এই দানবের হাতে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ