X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফরহাদ মজহারের অপহরণ প্রসঙ্গে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৬ জুলাই ২০১৭, ১৯:১৩আপডেট : ০৬ জুলাই ২০১৭, ১৯:১৫

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ফরহাদ মজহার একজন কবি, বুদ্ধিজীবী। ইদানিংকালে পরিচিতি পেয়েছেন বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত গোষ্ঠীর পরামর্শক হিসেবে। দীর্ঘদিন ধরে লেখেন তবে তার লেখাগুলো মতলবি এবং অসৎ উদ্দেশ্যে লেখা হয় বলে লেখার সঙ্গে বেশিরভাগ সময় একমত হতে পারি না। ক’দিন আগে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রির সমান মর্যাদা প্রদান করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে কওমি লাইনের বহু আলেমের সঙ্গে বসে কথাবার্তা বলেছেন। সেখানে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহাম্মদ শফীও উপস্থিত ছিলেন। ফরহাদ মজহার কওমিদের অনুরূপ কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। কটু কথা বলেছেন। ওই প্রবন্ধে প্রদত্ত তার মতামতের সঙ্গে একমত হতে না পেরে আমি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবাদ স্বরূপ আরেকটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম।
সব লেখক সব সময় সব বিষয়ে একমত পোষণ করবেন তেমন কথা নেই। তাই অনেক সময় লেখকে-লেখকে কলম যুদ্ধ হয়। লেখার সংঘাতের মাঝে প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসে। লেখকের মতামতের দ্বন্দ্বের কারণে কখনও একে অপরকে শত্রু মনে করে না। লেখকের কাজই হচ্ছে সমাজের, মানুষের বৃহত্তম মঙ্গল কামনা করা। কোনও লেখক যখন ব্যক্তি পূজারী, গোষ্ঠী পূজারী হয়ে ওঠেন তখন তার লেখায় সত্যের অপলাপ থাকে। সত্যভ্রষ্ঠ হয়ে লিখলেতো লেখা আর কারও কোনও কল্যাণে আসে না। টাকার প্রশ্নে সাধারণ মানুষ সবাই এক ধর্মাবলম্বী। কিন্তু টাকার লোভে লেখক ধর্ম বদলায় না। এটাই কোনও লেখকের কাল উত্তীর্ণ গুণ।    

ফরহাদ মজহার সাহেব অপহরণের আগের দিন রিপোর্টার্স ইউনিটির হলে ভারতে গোমাংস নিয়ে মুসলমানদের ওপর যে অনাচার চলছে তার বিরুদ্ধে মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন। বিপন্ন মানুষের পক্ষে কথা বলা বাঙালির স্বভাব। আমরা এক সময়ে ভিয়েতনামকে নিয়ে মিটিং মিছিল করেছি। মেন্ডেলার মুক্তি চেয়ে সভা করেছি। এ কয়দিন আগে রোহিঙ্গা নিয়ে তো গোটা দেশই সরব হয়েছিলো।

ফরহাদ মজহার, মাহমুদুর রহমান গংরা এক পথের মানুষ আজ। মাহমুদুর ভারতের মুসলমানদের পক্ষে গিয়ে কতটা বলতে চেয়েছেন আর কতটা এখানে দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তাকে ইস্যু করতে চেয়েছেন--অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন। করতেই পারেন। অতীতে শাহবাগে গণজাগরণ বিরোধী অবস্থান নিয়ে এরা দেশের মধ্যে ধর্মীয় গুজব, হিংসা, হানাহানি ছড়িয়ে একের পর এক ভিন্ন মতের মানুষদের হত্যায় উৎসাহ দিয়েছেন। প্ররোচনা দিয়েছেন। হেফাজতিদের দিয়ে শাপলা চত্ত্বরে তাণ্ডব চালিয়েছেন। সেটা মানুষ ভুলে যায়নি। এই মজহারই শাপলা চত্ত্বরে পুলিশ কর্তৃক হেফাজতের কর্মীদের হত্যা, গায়েবের গুজব ছড়িয়েছেন।

মাহমুদুর-মজহার ছাড়াও সরকারের বিরুদ্ধে অনেকে লেখেন। ভিন্নমত পোষণ করেন কিন্তু দেশে হানাহানির ষড়যন্ত্র সবাই করেন বলা যাবে না। এক ঘরানার চিন্তা চেতনা দোষেরও কিছু না। উদার হোক আর রক্ষণশীল ঘরনার লেখক হোক প্রকৃত লেখক কিন্তু তিনি কখনও কারো পক্ষ অবলম্বন করেন না- সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে তার কোনও দ্বিধা নেই।            

অপহৃত কোনও মানুষ যখন মুক্ত হয় তার স্বজনদের কাছে ফিরে এসে সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে অশ্রু ফেলে এমন ছবি পত্রিকায় দেখলে আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি। কারণ ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করার পর চট্টগ্রামে বহু লোককে অপহরণ করা হয়েছিলো। বিএনপি নেতা জামাল উদ্দীনকেও তখন অপহরণ করা হয়। জামাল উদ্দীনের অপহরণের ১৪/১৫ দিন পর আমাকেও চট্টগ্রাম নগরীর সাগরিকার মোড় থেকে অপহরণ করা হয়েছিলো।

সাগরিকার মোড়ের যে স্থানে আমি বসেছিলাম সে স্থানে হঠাৎ করে একটা সাদা প্রাইভেট এসে দাঁড়ায় আর ২০/২৫ জন অস্ত্রধারী যুবক আমাকে ঘেরাও করে ফেলে। তৎক্ষণাৎ এ সংবাদটা পেয়ে তৎকালীন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান, মীর নাছির উদ্দীন পুলিশকে চট্টগ্রাম-মীরসরাইয়ের রাস্তা, চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি রোড আর চট্টগ্রাম কাপ্তাই রোড ব্লক করে তল্লাশি চালানো নির্দেশ দেন। সে কারণে আমাকে জামালউদ্দীনের মতো পাহাড়ে নিয়ে যেতে পারেনি তারা। ২/৩ ঘণ্টা শহরের ভেতর গাড়িটা আমাকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করার পর পতেঙ্গার কাছে সমুদ্র উপকূলের এক নির্জন কুটিরে নিয়ে রাখে।

নেওয়ার সময় তারা চোখ বেঁধে ফেলেছিলো আর পেছন সিটে ফেলে তারা দুইজন আমার ওপর বসেছিলো। এ ঘরটার মালিক সম্ভবতো কোনও এক ভুট্টো নামের লোক কারণ গাড়ি থেকে তারা এ ভুট্টোকে মোবাইল করেছিলো যে একটা ‘মুরগি’ ধরেছি রাখার জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাকে ছাড়ার সময় তারা মাথায় কোরআন দিয়ে শপৎ দিয়েছিলো যেন কোনও ঘটনার কথা কাউকেও না বলি। পরে তালাশ করে দেখেছি এ ভুট্টো সমুদ্র উপকূলের এক কালো বাজারি। আর যারা আমাকে অপহরণ করেছিলো তারা ভুট্টোর মালামাল শহরে ঢুকার সময় পাহারা দিতো। অপহরণকারীদের নেতা ছিলো বিএনপির এক ওয়ার্ড সভাপতি এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল হালিশহরের এক ছাত্র শিবির নেতা।

যাক। তারা আমাকে অস্ত্র দিয়ে কয়েকবার মাথায় আঘাত করেছিলো। তাতে আমার দৃষ্টিশক্তি আর শ্রবণ শক্তির গুরুত্বরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার বিনিময়ে মুক্ত হয়েছিলাম, টাকা চেয়েছিলো ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিয়েছি পাঁচ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে র‌্যাব গঠিত হলে ওই বিএনপির ওয়ার্ড সভাপতিকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। সেকেন্ড ইন কমাণ্ড শিবির নেতার মৃত্যু হয়েছে ব্লাড ক্যান্সারে। আমার অপহরণের বিষয়টি নিয়ে আমার লেখা লেখিতে তেমন কখনও উল্লেখ করিনি। আমি মোরশেদ খান, মীর নাসির, আবদুল্লাহ আল নোমান এবং জাতীয় ও চট্টগ্রামের স্থানীয় পত্রিকাগুলোর কাছে কৃতজ্ঞ। তাদের জোর প্রচেষ্টার বিষয়টা গুরুত্বরভাবে অনুভূক্ত না হলে সন্ত্রাসীরা আমাকে এত অল্প টাকায় ছাড়তো না। সর্বোপরি পুলিশের বর্তমান আইজি শহীদুল হক তখন ঢাকা থেকে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকেও চাপে রেখেছিলেন।

ফরহাদ মজহারের অপহরণের বিষয়টা খুবই গুরুত্ব সহকারে তদন্ত হওয়া দরকার। কারণ কেন তাকে অপহরণ করলো? কেন তাকে খুলনায় নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো? কেন আবার ঢাকাগামী বাসে টিকেট কেটে তুলে দিলো? বিষয়টাতো রহস্যাবৃত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন সীমান্ত পার করে নিয়ে যেতে পারলে খুবই মুশকিল হতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাথায় সীমান্ত পার করার কথাই বা আসলো কেন? রহস্যের জট খোলার জন্য ফরহাদ মজহার আর সালাউদ্দীনের বিষয়টা খুবই গুরুত্ব সহকারে তদন্ত হওয়া উচিৎ বলে মনে করি।

মজহার সাহেব বলেছেন সম্ভবতো সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য কেউ এ কাজটা করেছে। এটা কি তার সত্য ভাষণ? না সরকারকে সন্তুষ্ট করার জন্য বুদ্ধি করে বলেছেন। তাও খতিয়ে দেখা দরকার। আবার এখন অনেককে বলতে শুনেছি র‌্যাডিকাল ইসলামিস্টদের সঙ্গে নাকি ফরহাদ মজহারদে যোগাযোগ আছে। তারাও সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য অনুরূপ কাজ করতে পারে। যে সব অবাঙালিরা স্বাধীনতার পর সীমান্তের ওপারে চলে গেছে এবং ভারতের নাগরিক হয়ে গেছে তাদের সঙ্গেও নাকি এ পারের র‌্যাডিকাল ইসলামিস্টদের যোগাযোগ রয়েছে। এ বিষয়টা সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত।

ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করে অপহরণকারীরা যদি টাকাই চাইতেন তাহলে কোনও টাকা ছাড়াই ছাড়লেন কেন? এবং টাকার কথা বলে তার স্ত্রীকে টেলিফোন করলেন কেন? সব কিছু খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। ফরহাদ মজহার একজন বুদ্ধিজীবী লোক; অনেক প্রশ্নের অবতারণা করে তার জন্য কোনও বিপদ সৃষ্টি করতে চাই না। তবে বাংলাদেশের সব পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ দিয়ে বলবো অন্তরে ক্রোধ রেখে কলম চালানো ভালো কাজ নয়। কারণ ক্রোধ মনুষ্যত্বের আলোক শিখা নিভিয়ে দেয়। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, ঐক্যবদ্ধ সমাজের জন্য, দেশের উন্নয়নের জন্য লেখক সমাজকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ক্রোধ পরিহার করতে হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]                

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ