X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা’

বিভুরঞ্জন সরকার
০৪ আগস্ট ২০১৭, ১৪:১৬আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০১৭, ১৫:০৭

বিভুরঞ্জন সরকার সম্প্রতি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম সিরাজগঞ্জের কিশোরী পূর্ণিমার ছবি দিয়ে। লিখেছিলাম ক’লাইন মন্তব্য: এই ছবিটার কথা কেউ মনে করতে পারছেন?  হ্যাঁ, এটা পূর্ণিমা শীলের ছবি। ২০০১ সালে নির্বাচনের পর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ব দেলুয়া গ্রামের পূর্ণিমাকে বিএনপি-জামায়াতের দুর্বৃত্তরা মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে গণধর্ষণ করেছিল। তার অপরাধ কী? তার বাবা-মা নৌকায় ভোট দিয়েছিলেন। শুধু এক পূর্ণিমা নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন অপরাধ বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা অনেক চালিয়েছিল। বিএনপি এখন মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে সোচ্চার। কিন্তু বিএনপি কি দেশের সংখ্যালঘুদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে চায়? আগামী নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে গিয়ে সংখ্যালঘুদের জীবন-সম্ভ্রম- সম্পদ নিরাপদ থাকবে কি? পূর্ণিমাদের কান্না-হাহাকার কি বিএনপিকে এতটুকু ভাবায়?
আমার প্রশ্ন ছিল আগামী নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যালঘুদের নিরাপদ ভোটাধিকার চায় কিনা? এই স্ট্যাটাসের প্রতিক্রিয়ায় কয়েকজন যে মন্তব্য করেছেন তার বেশির ভাগেই মূল প্রশ্ন এড়িয়ে  অন্য প্রসঙ্গ সামনে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিএনপি-জামায়াতের অপকীর্তির ধারা বর্তমান শাসনেও বহমান। আওয়ামী লীগ আমলেও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চলছে, কাজেই বিএনপিকে এ ব্যাপারে দায়মুক্তি দেওয়া যেতে পারে। আমি এই অবস্থানের ঘোরতর বিরোধী। বিএনপির কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে বিএনপিকে। আওয়ামী লীগেরটা আওয়ামী লীগের। দুই জনেই অপরাধী কাজেই একজনের সমালোচনা করা যাবে না – এই মানসিকতা আমাদের দেশে অপরাধের সংস্কৃতি লালন করছে বলে আমি মনে করি। আওয়ামী লীগ যে বিএনপির খারাপটা অনুসরণ করছে, তার পেছনেও সম্ভবত এই চিন্তা কাজ করে যে, যে অপরাধ করে বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থন কমে না, সে অপরাধে আওয়ামী লীগ কেন দোষী সাব্যস্ত হবে?
কয়েকটি প্রতিক্রিয়া এখানে তুলে ধরছি মানুষের চিন্তার গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্য। লক্ষণীয় যে সবাই কিন্তু একধারায় চিন্তা করছেন না।
খালেদুল ইসলাম লিখেছেন: বাংলাদেশের মানুষ খুব তাড়াতাড়ি সব ভুলে যায়, এটাই এই জাতির সবচেয়ে কষ্টের বিষয়।
রায়হান ফেরদৌসের মন্তব্য: জাতীয় এই লজ্জার কথা ভোটারগণ কি মনে রেখেছে? মনে রাখার কথা নয়, বাঙালি এসব বেশিদিন মনে রাখে না। তার কত কাজ!
পুলক রাহা লিখেছেন: আমাদের দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সব সময় বলির পাঠা। এম. তাহিরুল ইসলাম আবার অন্য প্রান্তের মানুষ। তার মন্তব্য আমাকে আক্রমণ করে। লিখেছেন: দাদা, আপনি বুঝি ২০০৯ থেকে চশমা পরা শুরু করেছেন?  সুতরাং ২০০৯-২০১৭ পর্যন্ত কোনও ঘটনা আপনার চোখে পড়ে না।

একটু বড় মন্তব্য যারা লিখেছেন তাদের একজন মাজেদুল ইসলাম আকাশ। লিখেছেন: বাংলাদেশের রাজনীতির আড়ালে অপরাজনীতিতে বিযুক্ত সবাই। এইতো সেদিন বালিয়াডাঙ্গিতে ( ঠাকুরগাঁও ) আওয়ামী এমপির লোকেরা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালিয়ে জমিজমা কেড়ে নিয়েছে। এমন কি ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেও চা-বাগান ও বাংলো বানিয়েছে। সাঁওতাল পল্লী, আর বৌদ্ধ মন্দিরসহ আলোচিত ঘটনাগুলো এখনও কিন্তু বেশ দগদগে হয়ে আছে। সভ্য স্বাধীন দেশে এখনও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নির্মমভাবে ধর্ষিত হয়ে হত্যা হতে হয় তনুদের কেন? কী অপরাধ ছিল রুহিয়ার ( ঠাকুরগাঁও )  আফসানার?  ছাত্রলীগ নামের একটি সংগঠন এতবেশি বেপরোয়া যে, নেশার ঘোরে কোনও দিন যেন জন্মদাতা পিতাকেই বলবে শরীর টিপতে। এমন কোনও উপজেলা, ইউনিয়ন নেই যখানে আওয়ামী ক্যাডারদের দ্বারা সাধারণ মানুষসহ জ্ঞানী-গুণিরা নিগৃহীত হচ্ছেন না। ড. জাফর ইকবালের মতো ভদ্র মানুষকেও বৃষ্টিতে ভিজে অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে হবে কেন?  সাংবাদিক রুনির মতো কলম সৈনিকদেরও কেন মরতে হয় --। প্রতিকার কই?  সদুত্তর কোথায়?  আামার, আমাদের নিরাপত্তা আছে?  কীভাবে?

এই প্রতিক্রিয়াগুলোতে কিছু প্রশ্ন এবং কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে যে গুলো উপেক্ষা করার মতো নয়। আমার স্ট্যাটাসে ২০০১ সালে নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা, বিশেষত সংখ্যালঘুদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়কালেও দেশে যে প্রায় একই ধরনের জুলুম-নির্যাতন অব্যাহত আছে, তার বেলা? প্রতিক্রিয়ায় গুরুতর এপ্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া দরকার বলেই আমি মনে করি। কোনও প্রশ্ন চেপে গিয়ে বা এড়িয়ে গিয়ে প্রকৃত সমস্যার সমাধান করা যায় না।

এ প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত যে, যারা ২০০১ সালে দুর্বৃত্তপণা করলো, অপরাধ করলো তাদের কারো কি বিচার ও শাস্তি হয়েছে? তাদের কেউ কেউ এখন আওয়ামী লীগে ভীড়ে একই ধরনের অপরাধ করে চলেছে। অপরাধীরা শাস্তি না পেলে দেশ থেকে অপরাধপ্রবণতা কমবে কিভাবে? এতদিন একটা ধারণা ছিল, সংখ্যালঘুদের জন্য আওয়ামী লীগ একটি নিরাপত্তাবলয় দিয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে সংখ্যালঘুরা নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা বোধ করে থাকে। কিন্তু  গত কয়েক বছরে এই ধারণাটা ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে, ক্ষেত্রবিশেষে আওয়ামী লীগেরই প্ররোচনায় সংখ্যালঘু স্বার্থবিরোধী কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার প্রতিকার-প্রতিবিধান তেমন কিছু হয়নি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি আওয়ামী লীগ শাসনে অনিরাপদ বোধ করে তাহলে আগামী নির্বাচনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া অবশ্যই পড়বে। হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে দল বেধে ভোট দেওয়ার অপরাধে এতদিন তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এবার কি তাহলে তাদের ওপর নির্যাতন হবে আওয়ামী লীগকে ভোট না দেওয়ার অপরাধে?

আওয়ামী লীগের লোকজন অবশ্য সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি মানতে চান না। তাদের কথা হলো, দেশে আইনশৃঙ্খলাজনিত কিছু অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাকে হিন্দু নিগ্রহ বলে প্রচার করা ঠিক হবে না। সমাজের নিম্ন বর্গের মানুষ, দুর্বল শ্রেণির মানুষ,  তার ধর্ম বিশ্বাস যাই হোক না কেন, তাকে শক্তিধরের হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগের এই মতটা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকের কাছেই গ্রহণীয় নয়। তাদের কথা হলো, সংঘটিত অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া প্রভাবিত হচ্ছে ভিক্টিমের ‘ধর্ম’ দেখে। এই অবস্থা সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করছে। সামাজিক স্থিতির জন্য এটা ক্ষতিকর।

কেউ কেউ বলে থাকেন, শেখ হাসিনার শাসনে হিন্দুরা যথেষ্ট ভালো আছেন। চাকরিতে নিয়োগ, প্রমোশন, পদায়নে হিন্দুদের আধিপত্য এখন দৃশ্যমান। এরকম কথা শুনে মনে হয়, বর্তমান সরকার বুঝি করুণা করে, দয়া দেখিয়ে হিন্দুদের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি এসব করছে। ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। হিন্দুরা যেখানে যে দায়িত্ব পাচ্ছেন সেটা যোগ্যতার ভিত্তিতেই পাচ্ছেন। এটা কারো অনুকম্পা নয়, এটা নাগরিক হিসেবে তার প্রাপ্য অধিকার। এটা অবশ্য ঠিক যে অন্য সরকারের আমলে হিন্দুরা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল, বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। এখন সেটা একটু কমেছে। তারপরও সংখ্যানুপাতে হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব নেই। যদি দেশের জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগও সংখ্যালঘু হয়ে থাকে তাহলে মন্ত্রী, এমপি, সচিব, ভিসি, ডিসি সব পদেইতো ১০ ভাগ সংখ্যালঘু থাকার কথা। আছে কি?

বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। একটা সময় পর্যন্ত এটা সত্য থাকলেও এখন কতটা আছে তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। অবশ্য সম্প্রীতি বলতে যদি শুধু দাঙ্গা-হাঙ্গামা বোঝানো হয় তাহলে এখানে এখন পর্যন্ত সম্প্রীতি বজায় রয়েছে। কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে নৈকট্য ও সংযোগ যদি সম্প্রীতির একটি মাপকাঠি হয় তাহলে বলতে হবে যে সম্প্রীতির জায়গায় বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। মুসলমান-হিন্দু দুই প্রতিবেশীর মধ্যে কয়েক বছর আগেও যে মধুরতা ছিল এখন সেখানে কিছুটা কৃত্রিমতা এসেছে। পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বসের মাত্রা এখন বেশি। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদী তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়া, সংখ্যালঘু পুরোহিত-যাজকদের ওপর আক্রমণ চালানো, মুসলমান নারীদের পোশাক-আশাকে হঠাৎ ব্যাপক পরিবর্তন আসায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসিক ব্যবধান যে বাড়তে শুরু করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। হিন্দুদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও মনে করেন যে, মাথা পেতে অর্যাদাকর সবকিছু মেনে নেওয়া হয় বলেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ এখনও অটুট আছে। যেমন আজানের সময় হিন্দুদের পূজা আয়োজন সারতে হবে নীরবে, শাঁখ বাজানো যাবে না, উলুধ্বনি দেওয়া যাবে না, বাদ্যবাজনা বাজানো যাবে না।

তাই কেউ যদি বলেন যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকার মূল কৃতিত্ব হিন্দুদের নতজানু মানসিকতা, কিংবা তাদের উদারতা, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে কি? যারা চান বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাক, তাদের একটু চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগ মানেই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি- এই অবস্থাও আর বজায় নেই। আওয়ামী লীগ যেভাবে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের কৌশল নিচ্ছে তার পরিণতির কথাও মাথায় রাখতে হবে। কেবল দাঙ্গা হলেই সংখ্যালঘুদের মধ্যে অনাস্থা তৈরি। হয় না। ভারতে অনেক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে কিন্তু সেখানে দেশত্যাগের ঘটনা এত কম কেন? বাংলাদেশে দাঙ্গা নেই অথচ নীরব দেশত্যাগ বন্ধ হচ্ছে না কেন?  বাংলাদেশে কোনও সরকারই হিন্দুদের মনে আস্থা তৈরিতে সমর্থ হলো না কেন?  হিন্দুরা  এদেশে থাকলে ভোট, না থাকলে জমি-বাড়ি-পুকুর-বাগান সব দখল করা যাবে- এই মনোভাব কি দূরত্ব তৈরিতে ভূমিকা পালন করছে না? এসব নিয়ে ভাবার সময় চলে যাচ্ছে।

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ