X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সমস্যা: সমাধানের পথ কোথায়?

লুৎফুল হোসেন
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:৫৯আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:৩৪

লুৎফুল হোসেন ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকানের মুসলমানরা নিরাপদে ছিল ইংরেজদের সহায়তায়। এর পেছনে সম্ভবত আকিয়াব বন্দরই ছিল মুখ্য কারণ। সারা পৃথিবীতে সুপরিচিত এ বন্দরটি ছিল ভারতবর্ষের সঙ্গে তৎকালীন বার্মার বাণিজ্যিক তোরণ। বিশেষত চালের জন্য পৃথিবীব্যাপী এর সুখ্যাতি ছিল। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ, ফরাসি ও মঙ্গোলীয় থেকে শুরু করে নৌবাণিজ্যে বিস্তৃত পৃথিবীর সব দেশের নাবিকই এখানে বসতি গড়েছে কম বেশি। নবম শতক থেকে শুরু হয়ে তা চলমান ছিল সব সময়ই।
বন্দরকেন্দ্রিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে গোটা উপমহাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় মগ জলদস্যু পরিচয়টি তৎকালীন বার্মার পশ্চিম উপকূলবাসীর জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। বঙ্গোপসাগরের সবকয়টি বন্দরে মগদের দাপট আর দখল ছিল প্রায় দুই শ বছর। ১৬৬৬ সালে মুঘলরা চট্টগ্রাম বন্দর দখল করে সেই মগের মুল্লুকের ইতি ঘটায়। তার অনেক পরে ১৯৩১ সালের শুমারিতেও বিভিন্ন দেশের নাগরিকের পাশাপাশি প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয়ের বসবাসের তথ্য পাওয়া যায় আকিয়াবে।
জেনারেল অং সান, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তৎকালীন বার্মার শাসনকার্যে নিয়োজিত একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা। কর্মসূত্রে জাপানে গেলে জাপানিদের সঙ্গে 'আঁতাত' করেন বার্মাকে স্বাধীন করতে। ফলে ১৯৪২ সালে জাপানিরা তৎকালীন বার্মা বর্তমানে মিয়ানমার দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। জাপানিদের আশ্রয়ে শুরু হয় আরাকানদের ওপর তৎকালীন বার্মার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধদের অত্যাচার। মূলত আরাকানের মুসলিম রোহিঙ্গারাই ছিল এই সহিংসতার শিকার।


বার্মার সেনাবাহিনীর সঙ্গে ‘আঁতাত’ করে ইংরেজরা আবার দখল নেয় ১৯৪৫ সালে। আঁতাতের জের ধরে রোহিঙ্গাদের প্রতি ইংরেজদের পূর্বের নমনীয়তা ফিরে আসেনি। ১৯৪৮ সালে ইংরেজরা ভারত ছাড়ার সময় বার্মাকে একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা দেয়।
তবু প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে জেনারেল অং সানকে স্বাধীন বার্মার রূপকার বা জনক হিসেবে দেখা হয়। যদিও বিরোধী শিবির তাকে হত্যা করে চূড়ান্ত স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাস ছয়েক আগেই। তার অনেক স্মৃতিস্তম্ভও ভেঙে ফেলে দেশটার জান্তা সরকার। কিন্তু জনতার মন থেকে তাকে মুছতে অপারগ হবে বুঝতে পেরে ওরা থেমে যায়।
সেই জেনারেল অং সানের সন্তানদের মধ্যে কনিষ্ঠ সন্তানের নাম অং সান সু চি। আজকের নোবেল জয়ী মিয়ানমার নেত্রী। ১৯৬৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার পর তিন বছর জাতিসংঘে কাজ করা সু চি ১৯৭২ সালে বিয়ে করেন। স্বামী মাইকেল এরিস ছিলেন কিউবা বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক এবং ইতিহাসবেত্তা। যিনি ভুটান, তিব্বত ও হিমালয় পাদদেশের অঞ্চলগুলোর সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন।
১৯৮৮ সালের বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে বাবার জাতীয়তাবাদী দল এনএলডি-র মহাসচিব হিসেবে ’৯০-এর নির্বাচনে ৮১ শতাংশ ভোটে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হলেও ক্ষমতায় বসতে পারেননি সু চি। বিপরীতে ২১ বছর গৃহবন্দি থেকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছেন। নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন গৃহবন্দিত্বের শুরুতেই।
আসলে নোবেল পেয়ে মিয়ানমারের পরাশক্তির একটা দরজা হয়েছেন সু চি, এই যা। তার বাবার হাত ধরেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিদ্বেষ পাকাপোক্ত হয় পঞ্চাশের দশকে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে এর ইতি ঘটানোর একটা আশাবাদ জাগছিল পৃথিবীব্যাপী। সু চি ছিলেন সেই আশাবাদ বেড়ে ওঠার স্বর্ণলতিকা। অথচ ঠিক বিপরীত প্রক্রিয়াটিই বাস্তবায়িত হচ্ছিল নির্বাচনের আগে থেকে। ৯০’-এ গণতন্ত্রের সুবাতাস তাই রোহিঙ্গাদের রক্তের দাগ ও পোড়া গন্ধ তাই মেলাতে পারেনি। শ্বেতাঙ্গ স্বামী ও ভিনদেশী নাগরিকত্বের সন্তানদের কারণে রাষ্ট্রপতি পদের যোগ্যতা হারালেও ফার্স্ট স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে এক রকম সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন সু চি।
যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট বরাবরই অর্জন তালিকায় ছিল, তবু রোহিঙ্গা প্রশ্নে তিনি গণতন্ত্রের আড়ালে সেনাশক্তির দোহাই বরাবরই উচ্চারণ করেছেন। প্রচারমাধ্যম বিমুখ এবং রোহিঙ্গা প্রশ্নে নীরবতার কারণে সু চি প্রশ্নবিদ্ধতার তীর থেকে তাই দূরে সরতে পারেননি। যখন ২০১৫ সালের আদমশুমারিতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব নিবন্ধন ঠেকাতে সক্রিয় ছিল মিয়ানমার সরকার। সু চি ছিলেন তার নীরব সমর্থক। রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার বঞ্চিত করার এই শুমারিকে প্রত্যয়ন করেছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ। এখানে বিশ্ববাসী স্বভাবতই গোপন আঁতাতের গন্ধ পায়।
অথচ ৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর দেশটার সংসদে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এক দুই নয়, অন্তত এমন দশ জনের নজির পাওয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এমনটা ঘটছিল প্রকৃত গণতন্ত্রের যুগ সূচিত হওয়ার আগে পর্যন্ত। গণতন্ত্র কায়েম হয়ে বার্মা আজ মিয়ানমার। কিন্তু সেই গণপ্রতিনিধির ছেলেমেয়ে বা পৌত্র-প্রপৌত্ররা আজ আর সে দেশের নাগরিক নয়। প্রাণ বাঁচাতে তারা পালিয়ে বিদেশে আছে। এমন এক জনের পৌত্রই আজ যুক্তরাজ্যের রোহিঙ্গাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র। যাকে বিবিসি-সিএনএন-আলজাজিরা’র মতো প্রচারমাধ্যমগুলো নিয়মিত অন এয়ার করেন। যেমন করেছে গত দু’সপ্তাহও। তার নাম রো টুন কিং।
সার্বিক বিবেচনায় সু চিকে ঘিরে আশা-হতাশার দোলাচল আবর্তিত হলেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে সত্যিকারের কাজ যিনি করে যাচ্ছেন, তিনি কোনও মুসলমান নন, একজন বার্মিজ বৌদ্ধ। যিনি মিয়ানমারের বাইরে রয়েছেন আড়াই দশক ধরে। প্রথম সারির সেনা কর্মকর্তা পারিবারিক মুরুব্বিদের পরামর্শে ৮৮ সালে মিয়ানমার ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান। সেই থেকে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর গবেষণা এবং সামাজিক ও মানবিক আর্জির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। যার পাশে সু চিকে ম্রিয়মান মনে হয় যেকোনও আন্তর্জাতিক সভায়। সত্যিকারের মানবাধিকারের প্রশ্নে যাকে সদুত্তর দিতে পারেনি আন্তর্জাতিক শক্তি ও মানবাধিকারের সোল এজেন্টরা। লোকটার নাম ড. মঙ জার্নি। যিনি সব তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বার বার প্রমাণ করছেন যে, রোহিঙ্গা সমস্যাটা আসলে বহুজাতিক সমাজের গণতান্ত্রিক বিবর্তনের ফসলগত কোনও জাতিগত সংঘাত নয়। স্রেফ পরিকল্পিত ‘এথনিক ক্লিনজিং’।
তিনি বলছেন, একই মিথ্যাকে বারবার বলে তাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার তত্ত্বে সফল মিয়ানমার সরকার। তারা মিয়ানমারের সব বৌদ্ধ ধর্মের মানুষকে এটা আমূল বিশ্বাস করিয়েছে যে, মুসলিম রোহিঙ্গারা অনৈতিকভাবে অভিবাসিত। তারা জাতীয় শত্রু। তাদের উৎখাত করতে হবে। সেনাবাহিনীর পাশে আজ ধর্মীয় গুরুরাও বুদ্ধের অহিংসার বাণী ফেলে রোহিঙ্গা নিধনের মন্ত্র যপছেন, সোজা-সাপ্টা মাঠে নামছেন। বাংলার নিকটবর্তী দূরত্বে থেকে ভাষা, কৃষ্টি ও সাহিত্যে সাযুজ্য থাকার অভিযোগে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নামকরণ হয়েছে ‘বাঙালি’।
প্রোপাগান্ডার লক্ষ্যে মিয়ানমার তুলে এনেছে সুবিধা মাফিক ইতিহাসের অংশ। ’৪৮-এ ইংরেজরা যখন স্বাধীনতা উপহার দিচ্ছিল কাগজের ওপর মর্জি মাফিক কলমের আঁচড় কেটে এবং ধর্মভিত্তিক বিভাজনে সেটাকে করছিল সংজ্ঞায়িত। তখন রোহিঙ্গারা মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানের অংশ হতে জোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত টেকনাফে থেমে গিয়েছিল। তবে সেই সূত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রীতির সম্পর্কটুকু বজায় আছে অদ্যাবধি।
মিয়ানমার সরকার সচেতনভাবেই উচ্চারণ করে না যে, অষ্টম শতকের স্বাধীন আরাকানই অষ্টাদশ শতকে বর্মীদের দখল করে নেওয়া আজকের রাখাইন প্রদেশ। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে যারা মানুষ হিসেবেও স্বীকৃতি পায়নি, যাদের কারাবন্দির মতো পরিচয়পত্র নিয়ে সেনাবাহিনীর পূর্বানুমতি সংগ্রহ করে চলাচল করতে হয়, ১৯৭৭ সালে অপারেশন ‘নাগামিন’ বা ‘ড্রাগন কিং’-এর মাধ্যমে সেই রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার ভয়াবহতম পর্বের শুরু।
২০১৬-১৭ সালের রোহিঙ্গা খেদাও কর্মকাণ্ড চাঙ্গা হওয়ার আগে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লাখ। বাংলাদেশে আশ্রিত সাড়ে ছয় লক্ষাধিক, পাকিস্তানে দুই লাখ, সৌদি আরবে দুই লাখ, থাইল্যান্ডে একলাখ, মালয়েশিয়া ও ভারতে চল্লিশ হাজার করে, ইন্দোনেশিয়ায় বারো হাজার, নেপালে দুই শত। বর্তমান সময়ে রোহিঙ্গারাই পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ স্টেটলেস জনগোষ্ঠী।
আশ্চর্যের বিষয় যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইউএন বা উন্নত বিশ্ব কখনোই কার্যকর অর্থে সোচ্চার হয়নি। মানবাধিকারের ভূলুণ্ঠন তাদের চোখে পড়েনি জাতিগতভাবে নির্মূল করার একের পর এক নৃসংশতম ঘটনায়ও। অথচ তারাই সোচ্চার হয়েছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার লক্ষ্যে সীমানা উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবিতে। যে পাকিস্তান বা তুরস্ক নিজ দেশে মানবাধিকারের শ্রাদ্ধ করে আসছে, সে তারাই মানবাধিকারের নামে মাঠে নেমেছে রোহিঙ্গাদের পক্ষে। অন্যদিকে আমেরিকা, চীন, ভারত, রাশিয়া সবাই মিয়ানমারের পক্ষে। এথনিক ক্লিনজিং-এর সমর্থক এরা সবাই নিজ নিজ স্বার্থে। আমাদের সৌভাগ্য ইরান সাহায্য পাঠিয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সামলাতে। সুবিবেচক কানাডা সরকার ট্রুডোর নেতৃত্বে গণহত্যা বন্ধের কথা বলেছে। গণহত্যার সমর্থনে অবস্থান নেওয়া সুচির শুভেচ্ছা নাগরিকত্ব বাতিল করার পদক্ষেপ নিয়েছে।
অতীত ইতিহাসে থেকে মগ জলদস্যুর নৃসংশতা মুছে না গেলে আশ্রয় দিলেও এদেশের মানুষ সহজ হতে পারবে না আরাকানদের ব্যাপারে। পাকিস্তানের আঁতাত ঘিরে সংকট সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারবে না।
বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ বর্তমান সময়ে মাঠে নামা সব পক্ষকেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক সিদ্ধান্তের দিকে টেনে আনার জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ক্রিয়াশীল থাকা। নাহলে এ রোহিঙ্গা আশ্রিতদের হাত ধরে ঢুকে পড়বে ধর্মান্ধ মৌলবাদের নামে পৃথিবীব্যাপী সক্রিয় সব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আর তাতে দেশ যত বেসামাল হবে, তত বেশি লাভবান হবে বিদেশি শক্তি বা পরাশক্তিরাই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

/এসএএস/ এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ