X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

সু চি’র ভাষণেই মিয়ানমার

মোস্তফা হোসেইন
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:১০আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:১৬

মোস্তফা হোসেইন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন ১৯ সেপ্টেম্বর। আগ্রহ ছিল সবার- নতুন কিছু বলবেন কি সু চি? তবে বাংলাদেশের মানুষ সন্দেহমুক্ত ছিল ভাষণের বক্তব্য সম্পর্কে। কারণ আত্মসমালোচনা কিংবা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করার মতো মানুষ তিনি নন। প্রমাণিত সত্য এটা। কারণ যে মানুষটি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পান– তিনি যখন নিজ দেশে ক্ষমতাসীন হয়ে গণহত্যা চালাতে পারেন, তিনি আমাদের কোনও আশার আলো দেখাবেন না এটাই স্বাভাবিক। তাই অপরাধকে হালাল করার জন্য গতানুগতিক নিয়মে তিনি মিথ্যাচার করবেন সেটা সবার ভাবনাতে  ছিল। নির্লজ্জ মিথ্যাচার আর স্ববিরোধিতায় ভরপুর ছিল তার ভাষণ। এই যেমন তিনি বললেন, ‘রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধার পুরোটাই পায়’ বলে। কতবড় মিথ্যাচার! রাখাইন রাজ্যের মুসলমানদের জনসংখ্যা যাতে বৃদ্ধি না পায় সেইজন্য তার সরকার মুচলেকা আদায়ের বাধ্যবাদকতা করেছে। রোহিঙ্গাদের মুচলেকা দিতে হয়, তারা দুই সন্তানের বেশি জন্ম দেবে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিরোধের জন্য এটি সার্বজনীন কোনও আইন নয়। রোহিঙ্গা ছাড়া অন্যদের জন্য এই বিধান প্রযোজ্য নয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ওই এলাকায় যাতে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বৃদ্ধি না হয় সেই জন্যই এই বাধ্যবাধকতা।
তিনি কি জানেন না, রোহিঙ্গাদের মৃত্যুমুখে পড়লেও রাখাইনের বাইরে চিকিৎসার জন্যও যাওয়া সম্ভব হয় না। তাদের যে নিজ এলাকার বাইরে স্বাধীনভাবে যাওয়ার কোনও সুযোগই নেই। নিজ এলাকার বাইরে ভ্রমণ কিংবা অন্য কোনও কারণে যেতে হলে তাদের সরকারের অনুমতি নিতে হয়। এটা কি কোনও সভ্য দেশের নিয়ম হতে পারে? রোহিঙ্গারা কি মিয়ানমারের কারাগারে বন্দী? কারাবন্দীরা নাকি সব নাগরিক সুবিধা পায়! এমন দুঃখজনক ও মিথ্যা ভাষণ শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নারীর কাছ থেকে কিভাবে প্রত্যাশিত হতে পারে?

তিনি যদি রাখাইনের অধিবাসী বলতে রোহিঙ্গাদের বাইরের নাগরিকদের বুঝিয়ে থাকেন তাহলে হয়তো প্রশ্ন আসবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, রাখাইনের অধিবাসীরা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত বলেইতো রোহিঙ্গা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বলে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের সব নাগরিক অধিকার বাতিল করে দেওয়াতেই তো এই সমস্যা। সেখানে তিনি কী করে বলেন, ওখানে বসবাসরত সবাই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নাগরিক সুবিধা পেয়ে থাকে?

তার ভাষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে- অধিকাংশক্ষেত্রে তিনি স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি নিজেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। আবার তিনি যে মানবধিকার লঙ্ঘনের কথা বলছেন, সে বিষয়েও যে কোনও পদক্ষেপ নেবেন না তাও স্পষ্ট। যদিও তার বক্তব্য অনুযায়ী মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে তিনি তদন্ত করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তার ভাষণে মানবাধিকারের প্রসঙ্গটি আনতে আসলে তিনি বাধ্য হয়েছেন। আর যে কোনও কারণেই হোক শেষ পর্যন্ত তাকে স্বীকার করতে হয়েছে, সেখানে সহিংসতা ঘটিয়েছে একটি গ্রুপ। কিন্তু তার বক্তব্যে একবারও বলা হয়নি সেই অপরাধের সঙ্গে জড়িত কারা?  শুধু তাই নয়, তিনি ৫ সেপ্টেম্বরের পর সহিংস অভিযান চালানো না হওয়ার যে কথা বলেছেন তারপরও কি তিনি অপরাধমুক্ত বলে বিবেচিত হতে পারেন? ধরা যাক ৫ সেপ্টেম্বরের আগে সহিংস অভিযান চালিয়েছে। এবং তিনি যেসব শরণার্থীর কথা বলেছেন, তারা সেই সহিংসতা এড়াতে দেশ ছেড়েছে। তাতেও কি তার অপরাধ কমে যাবে?

তিনি যে রোহিঙ্গা বিষয়টিকে ফাইলচাপা দেবেন তা বোঝা যায় তার বক্তব্য থেকেই। তিনি বলেছেন, যেসব শরণার্থী দেশত্যাগ করেছে, তাদের মধ্যে বৈধ নাগরিকত্বের প্রমাণ আছে এমন সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে- রোহিঙ্গাদের তো ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন মাধ্যমে আগেই নাগরিকত্ব হরণ করা হয়েছে। এখন তারা কি নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনও কাগজপত্র দেখাতে পারবে? বৈধ নাগরিক শর্তজুড়ে দিলেও তিনি ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি।

কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব তার বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে। আর তা প্রমাণের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে রাখাইন ঘুরে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। এখানে কিছু প্রশ্ন আসতেই পারে। যারা পর্যবেক্ষণ করতে আসবে তাদের কি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেবে তার সরকার? ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের ভিসা দেয়নি তারা। শুধু তাই নয় যখন তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন তখনও সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এমনকি সিএনএন এর এক সাংবাদিক যখন বক্তৃতা শেষে তার মন্তব্য জানতে চেয়েছেন, তাকেও বাধা প্রদান করা হয়েছে। সেই সু চি স্বাধীনভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেবেন তা কি বিশ্বাসযোগ্য?

রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেওয়ার মানসিকতা তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি শরণার্থীদের সমস্যা নিয়ে বলেছেন- আমরা নবীন ও দুর্বল রাষ্ট্র। আমাদের বহু সমস্যা। ছোটখাটো দিকে নজর দেই কিভাবে? আবার তিনি তদন্তের কথা বলেছেন। সেখানেও একটা শর্ত যুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এত বেশি মানুষের ব্যাপারে তদন্ত করতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে। তদন্তের ব্যাপারে আরেকটা জটিল শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাখাইনের মুসলিমদের অভিযোগ আছে, আবার তাদের প্রতিপক্ষের মানুষেরও অভিযোগ আছে। স্পষ্টত বিষয়টিকে জটিল করা হয়েছে এখানে। তিনি এই বক্তব্য মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন, বিষয়টি স্থানীয় অধিবাসীদের সমস্যা হতে পারে। এই প্রতিপক্ষ যে সরকারি বাহিনী সেই বিষয়টি তিনি স্পষ্টত এড়িয়ে গেছেন। যদি তিনি স্থানীয় বৌদ্ধদের কিংবা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রতিপক্ষ মনে করে থাকেন, তাহলে সেই পক্ষ কি কখনও মিয়ানমারের ওই মুসলমানদের পক্ষে কিছু বলবে? কিংবা কোনোভাবেই কি তারা নিরপেক্ষ কথা বলবে? এটাতো প্রমাণিত, রোহিঙ্গা নির্যাতনের মূল হোতা সেদেশের সামরিক বাহিনী।

এতেই বোঝা যায় তারা নজর দিতে নারাজ। যতই ভাষণে মুখরোচক কথাই বলা হোক না কেন? তারা বিষয়টি সমাধানের পথে যাচ্ছে না।

মিয়ানমারের নোবেল বিজয়ী এই নেত্রীর ভাষণ তাই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের আশাব্যঞ্জক বলে গণ্য হতে পারে না। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা যে মানসিকতা পোষণ করে, সেখানকার সাম্প্রদায়িক শক্তি যে ভাষায় কথা বলে, সু চিও একই ভাষায় কথা বলেছেন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই নেত্রী শান্তির পথে হাঁটছেন না এটাই তিনি প্রমাণ করে দিলেন তার ৩০ মিনিটের ভাষণে।

তার এই বক্তব্য ছিল আন্তর্জাতিক চাপের প্রতিক্রিয়া, সেটাও স্পষ্ট। অথচ তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক কোনও চাপকে তারা তোয়াক্কা করেন না। কিন্তু কিছু বিষয় প্রমাণ করে আন্তর্জাতিক চাপ এড়াতে তিনি পারেননি। কঠিন সমালোচনা থেকে বাঁচতে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ সভার বৈঠকে যোগ দেওয়া থেকে বিরত রয়েছেন। দ্বিতীয়ত তিনি এমন সময় ভাষণ দিলেন যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ সভা শুরু হওয়ার কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর ‘পুতুল’ এই নারী মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে যাবেন নাকি সত্যিই শান্তির জন্য নিজের ক্ষমতাকে ত্যাগ করবেন। ক্ষমতার লোভ যে প্রকট সেটাও তিনি জানিয়ে দিলেন। তিনিও শান্তির পক্ষে নন, মিয়ানমারেরই মানুষ।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ