X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আইন কি শুধু সাধারণের জন্য?

রেজানুর রহমান
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৬:১০আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৬:১৩

রেজানুর রহমান বহু বছর আগের ঘটনা। স্কুলে পড়ি। সাহিত্য, অভিনয় সহ সংস্কৃতির নানা বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ। হাতে লিখে দেওয়াল পত্রিকা বের করতাম। সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু ছিল। আমাদের সঙ্গে প্রায়ই একটি মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা হতো। সবাই তাকে ‘হুজুর’ বলে ডাকতো। আমরা তাকে বেশ শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সমীহ করতাম। শ্রদ্ধা-ভক্তি পাওয়ার মতো মানুষও ছিলেন তিনি। কী মোলায়েম ব্যবহার। আমাদেরকে সামনে পেলে ধর্মীয় নানা বিধান তুলে ধরতেন। গান বাজনা করা হারাম। সিনেমা দেখা মহাপাপ ইত্যাদি বিষয়ে বুঝাতেন। হুজুরের পরামর্শে আমাদের এক বন্ধু সত্যি সত্যি সিনেমা দেখা বন্ধ করে দিল। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে দেশের সিনেমা হলগুলো বেশ সচল ছিল। নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে অগ্রিম টিকিট কেনার জন্য হলের সামনে দীর্ঘ লাইন পড়ে যেতো। বলা বাহুল্য সেই সময়ে সিনেমা হলের মালিক অথবা ম্যানেজার ছিলেন শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। অভিজাত পরিবারের লোকজনও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। একটাই কারণ সিনেমা হলের ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে সহজেই সিনেমার টিকেট জোগাড় করা যাবে। ব্ল্যাকে অর্থাৎ কালোবাজারে টিকেট কিনতে হবে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সিনেমা হলেও দিনে ৪/৫টি করে শো চলত। শুক্রবার অর্থাৎ ছুটির দিনে মর্নিং শো চলত। সপ্তাহের অন্যান্য দিনে বেলা ১২টা, বিকেল ৩টা, সন্ধ্যা ৬টা এবং রাত ৯টায় সিনেমার শো চলত। মর্নিং শো, ম্যাটিনি শো, ইভিনিং শো এবং নাইট শো এই শব্দগুলো সিনেমা প্রেমীদের কাছে দারুন জনপ্রিয় ছিল।

সৈয়দপুর শহরে লিবার্টি নামে একটি সিনেমা হলের সামনে একটি চায়ের দোকানে আমরা বন্ধুরা আড্ডা দিতাম। সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। অখণ্ড অবসর। তাই আড্ডাটা কখনও কখনও দীর্ঘ সময় ধরে চলতো। হোটেলটা সিনেমা হলের সামনে হওয়ায় রাত ১২টার আগে বন্ধ হতো না। কারণ রাত ১২টায় ইভিনিং শো শেষ হয়। শো থেকে বেরিয়েও কিছু মানুষ হোটেলে আড্ডা দিতে বসে...

একদিনের ঘটনা। ইভিনিং শো শেষ। দর্শক হল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমরাও হোটেল থেকে বেরিয়েছি। যার যার বাসায় যাব ভাবছি। হঠাৎ দেখি চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ একজন আমাদের সামনে দিয়ে হন হন করে চলে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করতেই বুঝলাম– আরে এতো আমাদের হুজুর। আমাদের এক বন্ধু দৌড়ে গিয়ে হুজুরের সামনে দাঁড়াল। হুজুর সাপ দেখার মতো চমকে উঠলেন। আমরা তাকে চিনে ফেললাম– হুজুর আপনি? এখানে? সিনেমা দেখলেন? সিনেমা দেখা না হারাম কাজ... হুজুর এদিক ওদিক দেখে নিয়ে অতি সন্তর্পণে যা বোঝালেন তার অর্থ হলো– বাবারা আমি যা বলি তা করো। কিন্তু আমি যা করি তা তোমরা করতে যেও না...

গল্পটা এই পর্যন্ত থাকুক। তবে গল্পটা বলার একটা কারণ আছে। দেশের পত্র-পত্রিকায় গত কয়েকদিন ধরে একটি বিষয় বেশ ফলাও করে প্রকাশ হচ্ছে। বিষয়টা হলো উল্টো পথে গাড়ি চালানো। দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার প্রথম পাতায় একই দিনে একই কলামে গুরুত্ব সহকারে দুটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। একটি দৈনিকে লিখেছে ‘তবু উল্টো পথে গাড়ি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নাই’। আরেকটি দৈনিকে লিখেছে, ‘অভিযানের মধ্যেও তারা উল্টোপথে। এক সচিব দুইবার ধরা’।

পত্রিকায় সম্মানিত এই সচিবের কর্মকাণ্ডের বর্ণনা পড়ে বহুদিন পর আগের দিনের সেই হুজুরের কথা মনে পড়ে গেলো। দু’জনের ভূমিকাই আমাদের সমাজে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তারা যা বলেন আমরা সাধারণ মানুষেরা মূলত সেটাই করার চেষ্টা করি। যানজট ঢাকা শহরের জীবনযাত্রাকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্যই মূলত উল্টো পথে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ। কিন্তু যারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারাই যদি সিদ্ধান্ত না মানেন তাহলে সাধারণ মানুষ তা মানবে কেন? নাকি কথাটা সেই হুজুরের মতো করেই বলতে হবে– বাবারা আমি যা বলি তাই করো। আমি যা করি তা করতে যেও না... কিন্তু যারা আইন প্রণয়ন করে নিজেরাই আইন ভাঙেন তাদের বোঝা উচিৎ সময় বদলে গেছে। এখন আর ছেলে ভুলানো ছড়ায় কাজ হয় না।

একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকার সংবাদ পড়ে শুধু অবাক নয়, বিস্মিত হয়েছি। যারা নিয়ম করেন তারাই এভাবে নিয়ম ভাঙেন কোন যুক্তিতে? সেখানে লিখেছে– ‘পরপর দু’দিন উল্টো পথে চলে আইন ভঙ্গ করল পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিবের সরকারি গাড়িটি। দুদিনই গাড়িতে ছিলেন সচিব নিজে, অফিস শেষে বাড়ি ফিরছিলেন... সচিব নিজে আইন ভাঙ্গলেন। এর ব্যাখ্যা কি হতে পারে? আইন না মানার চিত্রটা কতো ভয়াবহ একবার দেখুন– পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে–মাত্র একদিনে রাজধানীর হেয়ার রোডে পুলিশের দুইঘণ্টার অভিযানে ধরা পড়ে ৫৭টি যানবাহন। যার মধ্যে ৪০টি ছিল সরকারি যানবাহন। এগুলোর মধ্যে ছিল প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সাংবাদিক, বিচারক ও ব্যবসায়ীর গাড়ি। ভেবে দেখুন একবার যারা মূলত আইন প্রণয়ন করেন অথবা এব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তারাই আইন ভঙ্গ করেছেন। তাহলে আইন করে লাভ কী? নিজে মানবেন না অথচ অন্যকে তা মানতে বলবেন তা কি কখনও হয়? আইন কি শুধু সাধারণ মানুষের জন্য? যারা আইন প্রণয়ন করেন তারা কি আইনের ঊর্ধ্বে?

লেখক: সাংবাদিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রতি শ্রেণিতে ৫৫ শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর
প্রতি শ্রেণিতে ৫৫ শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর
উত্তাল চুয়েটে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ
উত্তাল চুয়েটে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
‘বিএনপি যেকোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
‘বিএনপি যেকোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ