X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ যখন যৌন নির্যাতন

বিথী হক
২৯ অক্টোবর ২০১৭, ১৭:১৮আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০১৮, ১৯:১৮

বীথি সপ্তর্ষি এদেশের মেয়েরা কখনও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় না বলে মনে করেন অনেকে। কারণ যৌন নির্যাতন যে আসলে কোনও নির্যাতন, সে ধারণা জন্মানোর আগেই মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হয়ে পড়ে। 
সত্য হলো, আমাদের মায়েরা ছোটবেলা থেকে একই ধরনের নির্যাতনের ভেতর দিয়ে বড় হওয়ার পরও নিজের সন্তানের সঙ্গে যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, সে ভাবনাকে প্রশ্রয় দেন না। দিলেও নেহাত দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়ে বলেন, ‘সবার জীবনেই এমন ঘটনা ঘটে’। যৌন নির্যাতনকে অলৌকিক ভেবে ‘আমাদের কারও কিছু করার নেই, কারণ আমরা সমাজে বাস করি’ বলে কন্যা সন্তানদের সান্ত্বনা দেন। এখনও কন্যাদের সান্ত্বনার চেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষার গুরুত্বটা সমাজে সমাদৃত হয়নি। সমাজ যৌন নির্যাতনকে নারীর কলঙ্কের হার বানিয়ে ফেলি। এ কারণে যৌন নির্যাতন সমাজে নিপাতনে সিদ্ধ।
কন্যারা আমাদের দেশে ছোটবেলা থেকেই শেখে, যতই শিক্ষিত হই, ছাইকাঠি হাতে নিয়েই মরতে হবে। এরই অংশ হিসেবে বাবা-মা বৈশাখী মেলা বা পূজার মেলা থেকে রঙিন হাড়ি কিনে এনে পড়াশোনার পাশাপাশি রান্না-বাটির প্রাত্যহিক অনুশীলনে বসিয়ে দেন আর পুত্র সন্তানকে কিনে দেন শক্তি-সামর্থ্য আর ভায়োলেন্সের সব উপকরণ। ছেলেরা ছোটবেলা থেকেই পিস্তল-বন্দুক, গাড়ি, হেলিকপ্টার চালাতে চালাতে নিজেকে বোনের চেয়ে তুলনামূলক বেশি কর্তৃত্বের অধিকারী, গুরুত্বপূর্ণ ও বুদ্ধিমান ভাবতে ভাবতে বড় হতে থাকে। এই সমাজ যখন শিশুকে নির্মল, সুন্দর বানানোর আগে কোনটা মেয়েলি আর কোনটা ছেলেমানুষী বৈশিষ্ট্য শেখায়, বড় হয়ে কে কতখানি জেন্ডার সেনসিটিভ হবে, তার ক্ষেত্র ঠিক সেই সময়ই রচিত হয়ে যায়। সেই সময়টাই নির্ধারণ করে ছেলে শিশুটি বড় হয়ে কী ধরনের আচরণ করবে, মেয়ে শিশুটি কী ধরনের আচরণ করবে। শুনতে অবাক লাগলেও শিশুর মনস্তত্ত্ব গঠনে শৈশবের ক্ষুদ্র ঘটনা থেকে বড় বড় ঘটনার যে কোনোটিই শিশুর ভেতর আটকে যেতে পারে, যা বেড়ে ওঠার পরও ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে উঠতে পারে, আপনি হয়ত জানবেনও না।

পারিবারিক শিক্ষা-সংস্কৃতিকে অগুরুত্বপূর্ণ ভাবা নব্য-সভ্য আমরা তাই পরিবারকে যতই দু’হাতে ঠেলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়কে শিশুদের শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান জ্ঞান করি না কেন, যৌন নির্যাতনের ঘটনার জন্য পারিবারিক শিক্ষার প্রভাব অনেকাংশেই দায়ী, কিছু কিছু সময় পুরোটাইও। পাশের বাড়ির লোক বা ড্রাইভার বা বাড়ির দারোয়ানকে আপনি যতই আপনার শিশুর চাচা-মামা-দাদা বানান না কেন, তার কাছে আপনার শিশু যে শতভাগ নিরাপদ, সে গ্যারান্টি আপনাকে কে দিলো?  

ব্যতিক্রমী দু’য়েকজন ছাড়া আমি এখনপর্যন্ত এমন কোনও নারী দেখিনি, যিনি কখনও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়নি, শৈশবে বাজে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি যৌন নির্যাতন ঘটে, আমাদের দেশে আরও বেশি ঘটে। আমাদের দেশে যেহেতু যৌন সম্পর্কের জন্য বিপরীত লিঙ্গের  সংকট, বিয়ে ছাড়া শারীরিক সম্পর্কে যাওয়ার অনুমতি নেই, যেহেতু শারীরিক সম্পর্কের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক সঙ্গীর সংকট এবং এ দেশের বাচ্চাকাচ্চাদের বাবা-মায়ের ইচ্ছেতেই সম্পর্কের মামা, চাচা, খালু, ফুপা, ভাই, দুলাভাই, নানা, দাদা ইত্যাদির সঙ্গে অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক থাকে তাই অবদমিত বাসনার বাস্তবায়ন ঘটাতে মোক্ষম সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বেশিরভাগ বয়ো-বৃদ্ধ-যুবারা  দু’বার ভাবে না। যৌনতাকে অস্বীকার করে এসব সম্পর্কের মানুষজনকে যৌনতার ঊর্ধ্বে সাত আসমানের ওপরে রেখে তাই তাদের ব্যক্তিত্বকে আরও মজবুত করে প্রকাশ্যে সরল-সৌম্য চেহারার আড়ালে এক একটা সত্তাকে আমরা প্রতিনিয়ত শ্রদ্ধাবনত সালাম করি। তাতে অবশ্য তাদের বিকৃত যৌনতার কিছুমাত্র ভেঙে-চুরে যায় না বা সুদূর অদূর কোনও ভবিষ্যতেই ভাঙার সম্ভাবনা খালি চোখে দেখা যায় না।

শিশুদের মানসিক বিকাশ ও সামাজীকীকরণের জন্য শিশুকে খেলাধূলার যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া উচিত বলেই মনে করি। সেটা হোক পুতুল খেলা বা বাস্কেট বল! তবে খেলাধূলা কোথায় করছে, কার সঙ্গে করছে, সেসব নিশ্চিত হয়ে নেওয়াটাও উচিত। কিন্তু আমাদের বাবা-মায়েরা হয় খেলাধূলা করাটা এমন কিছু বিশেষ কাজ না বলে বাচ্চার হাতে স্মার্টফোন, ট্যাব বা গেমিং পিসি তুলে দেন অথবা কোনও নিরাপত্তার কথা না ভেবেই অল্পপরিচিত অথবা আপাত পরিচিত ব্যক্তি বা স্থানে নির্দ্বিধায় শিশুকে ছেড়ে দেন। আমার মতো বা আরও অনেকের মতো বাচ্চারা তাই সমবয়সীদের কাছে মার খেলেও বা বিভিন্নরকম অসচেতন হয়রানির কথা বাবা-মায়ের কাছে স্বীকার করে না। পরেরদিন থেকেই যদি আর খেলতে যেতে না দেয় এই ভেবে। দিনের পর দিন এমন পরিস্থিতির শিকার হলে একটা মেয়েশিশুর মানসিক ও শারীরিক অবস্থা কোথায় যেতে পারে, এমনটা ভাবলে হয়ত যৌন নির্যাতন ও লঘু করে বলতে চাওয়া যৌন হয়রানির ঘটনা অনেকখানিই রোধ করা সম্ভব।

আরও বেশি যৌন নির্যাতন রোধ করা সম্ভব হতো, যদি সবাই যৌন নির্যাতনকে চাঁদের কলঙ্কের হার বা নারীর লজ্জা ইত্যাদি বিশেষণে মহিমান্বিত না করে শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে হাতে হাত ধরে যৌন বিকৃত কীট-পতঙ্গদের পিষে ফেলে, আইনের আওতায় এনে, পাবলিক শেইমিং করে শিশু থেকে বৃদ্ধ নারীদের মাথায় ছায়া হয়ে থাকতে পারতাম। আরও  ফলপ্রসূ হতো, যদি যৌন নির্যাতন বিষয়ে চোখ-কান বন্ধ না করে  যার যার জায়গা থেকে যথাযথ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারতাম। এক টুকরো আলোর কাছে ঘর ভরা আঁধার কত তুচ্ছ, তা প্রমাণ করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।

যৌন নির্যাতনকে যৌন নির্যাতন হিসেবেই আমরা প্রতিহত করতে পারি। আমরা না করলে আর কারা  আলো জ্বালবে? আগুন তো আমাদের কাছে, আমাদের ভেতরেই!

লেখক: সাংবাদিক

এসএএস/এমএনএইচ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ