X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আহ্ ক্রিকেট, বাহ ক্রিকেট!

রেজানুর রহমান
৩১ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:১৩আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:২৮

রেজানুর রহমান আহারে, দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমের ক্রিকেট মাঠের গ্যালারিতে বসা সেই অশ্রুসিক্ত তরুণের মুখোচ্ছবি বার-বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তাকে আমি চিনি না। সে আমার আত্মীয় নয়। তবুও তার জন্য মায়া হচ্ছে? কষ্টে বুকের ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে। বুকে সবুজের মাঝে লাল সূর্যের পতাকা আঁকা টিশার্ট পরে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের প্রেরণা জোগাতে মাঠে এসেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলতে এসে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল একের পর এক পরাজয় বরণ করছে। তবুও প্রবাসী বাঙালির চোখে-মুখে প্রত্যাশার লাল সূর্যই যেন উঁকি দিচ্ছিলো। একবার না পারিলে দেখো শতবার– এই বিশ্বাসে ভর করেই পচেফস্ট্রুমের ক্রিকেট মাঠে সেদিনও জমায়েত হয়েছিল কয়েকশ প্রবাসী বাঙালি। অনেকেই চাকরিতে ছুটি নিয়ে এসেছিল। জন্মভূমি বাংলাদেশের লড়াকু ক্রিকেটাররা আফ্রিকায় খেলতে এসেছে। কাছ থেকে তাদেরকে একনজর দেখতে পারাও তো পরম আনন্দের। আর যদি বাংলাদেশ জিতে যায় তাহলে তো বোনাসের ওপর বোনাস। দক্ষিণ আফ্রিকার বন্ধুদের কাছে গর্ব করে বলা যাবে– এই যে দ্যাখো আমার দেশ, এরই নাম বাংলাদেশ।
যে তরুণটির কথা বলছি বোধকরি সেও তার বন্ধুদের কাছে দেশের লড়াকু ক্রিকেটারদের নিয়ে এমনই গর্ব করেছিল। সে কারণে হয়তো অনেক আশা নিয়ে এসেছিল পচেফস্ট্রুমের ক্রিকেট মাঠে। যদিও এর আগে বাংলাদেশ টেস্ট, ওয়ানডে দুটোতেই শোচনীয়ভাবে হেরেছে। টি-২০’র দুটি খেলার প্রথমটিতেও জয়ের দেখা মিলেনি। তাতে কী? কথায় আছে একবার না পারিলে দেখ শতবার। শেষ খেলায় নিশ্চয়ই বাংলাদেশ জিতবে। কিন্তু এ-কী জেতার তো কোনও লক্ষণই নেই। বরং জেতার আগেই হারার ভঙ্গি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের শরীরে। দক্ষিণ আফ্রিকার ডেভিড মিলার বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটার সাইফুদ্দিনের করা এক ওভারের ৫ বলেই পর পর ছক্কা মারলেন। তখনই টিভিতে বার-বার ভেসে উঠছিল প্রবাসী বাঙালি তরুণের সেই করুণ মুখোচ্ছবি। দু’চোখ ছল ছল। হয়তো এতটা অসম্মানের মুহূর্তের কথা সে কল্পনাও করেনি। দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক শক্তিধর ক্রিকেট দল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে তাদেরই মাঠে তাদেরকে বার-বার হারাবে এটা হয়তো সেই তরুণ কল্পনাও করেনি। তবে এই স্বপ্নটা বোধকরি সে দেখেছিল বাংলাদেশ টেস্টে হেরেছে আফসোস নাই। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ কোনও অংশেই ফেলনা নয়। কাজেই ওয়ানডে’র তিন ম্যাচেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। সিরিজ জিততেও পারে বাংলাদেশ। কিন্তু সেটা হলো না। বাংলাদেশ টেস্টের মতোই ওয়ানডেতেও শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করলো। এলো টি-২০ এর লগ্ন। এবারও প্রত্যাশা-দুই টি-২০ ম্যাচের একটিতে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ জিতবে। তা নাহলে তো মুখ দেখানো যাবে না। এবারও লক্ষ্য পূরণ হলো না। একজন ডেভিড মিলারের কাছেই হেরে গেলো বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের ব্যাপারে আমার একটি পক্ষপাতপূর্ণ অবস্থান আছে। যেখানেই থাকি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলা মিস করি না। কারণ এই একটি খেলায় আমি কোনও বিরোধী পক্ষ পাই না। গোটা দেশের মানুষ একটি পক্ষ। আর তাই মাঠে বাংলাদেশের ক্রিকেট হাসলে গোটা বাংলাদেশ হাসে। ক্রিকেট পরাজিত হলে সেই হাসি মিলিয়ে যায়। এজন্য ক্রিকেট সবার প্রিয়। আমারও প্রিয়। আর তাই নিশ্চিত পরাজয় জেনেও টিভি পর্দা থেকে চোখ সরাই না। সে কারণে সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় পচেফস্ট্রুমের মাঠে ক্রিকেট লড়াইয়ে বাংলাদেশ দল শোচনীয়ভাবে হেরে যাচ্ছে দেখেও টিভি পর্দা থেকে চোখ সরাইনি। সে কারণেই প্রবাসী সেই তরুণের কষ্টকাতর চোখ আমাকে কাঁদিয়েছে। বার-বার নিজেকে প্রশ্ন করেছি– এখানে কান্নার কী আছে? ক্রিকেট একটি খেলামাত্র। খেলায় জয় পরাজয় থাকবেই। এনিয়ে এতটা আবেগ দেখানোর তো কোনও মানে হয় না। বাংলাদেশ আজ হেরেছে কাল নিশ্চয়ই জিতবে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো– বাংলাদেশ ক্রিকেট দল দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের কাছে যে ভাবে অব্যাহত গতিতে পরাজয় বরণ করেছে তার ব্যাখ্যা কী? বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কি এতটাই খারাপ দল? ২ টেস্ট, ৩ ওয়ানডে এবং ২টি-২০ মোট ৭টি খেলার মধ্যে একটিতেও কি জেতার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন দল নয়? না জিতুক লড়াই তো করবে? তার কোনও লেশমাত্র দেখা গেলো না। তাহলে তো প্রশ্ন এসেই যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট আদৌ এগিয়েছে নাকি পিছিয়েছে?

এটাইতো স্বাভাবিক চিত্র। যে কোনও ক্ষেত্রেই হোক না কেন দল জিতলে হয়ে যায় হিরো। আর হারলে হয়ে যায় জিরো। জিতলে মাথায় তোলা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আর হারলে­– ‘তোকে দু’চোখে দেখতে পারি না’ এমন মানসিকতাও পোষণ করেন অনেকে। এই যে হার-জিতের খেলা, এজন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। কোথায় কার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছি সে ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে তারপর এগুতে হয়। বাংলাদেশ শক্তিধর ক্রিকেট প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাদেরই দেশে ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার আগে তেমন প্রস্তুতি কি আদৌ নিয়েছিল? দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার আগে দলের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় হঠাৎ জানালেন তার ছুটি চাই। আমার ধারণা দলে নেতিবাচক ধাক্কাটা সেদিনই লেগেছিল। একটা সহজ সরল বাস্তবতা তুলে ধরি। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড অথবা জাপানের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে দু’জন মন্ত্রী, কয়েকজন সচিব থাকবেন। হঠাৎ শোনা গেলো মন্ত্রীদের কেউ যেতে পারবেন না। সচিবদের মধ্যে একজন ছাড়া অন্যরা অপারগতা প্রকাশ করেছেন। আর কী করা, একজন প্রতিমন্ত্রী ও যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার কয়েকজনকে নিয়ে প্রতিনিধিদল বিদেশে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখল সে দেশের বাঘা বাঘা সব মন্ত্রী তাদের প্রতিনিধি দলে যুক্ত হয়েছেন। বৈঠকে তারা যে টেকনিকে বক্তব্য উপস্থাপন করতে থাকলেন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অনেকই সে টেকনিক জানেন না। বাংলাদেশের অনেকে আফসোস করতে থাকলেন আহারে! দলে যদি আমাদের মন্ত্রীদের একজনও থাকতেন তাহলে দেখিয়ে দিতাম। এখানে দলে একজন মন্ত্রী থাকা মানেই সাহস জন্ম নেওয়া।

বোধকরি আমাদের ক্রিকেট দলের মধ্যে পরিস্থিতিটা দাঁড়িয়েছিল এরকমই। সাকিব আল হাসান দলে থাকবেন না তার মানে দলের অলরাউন্ডার খেলোয়াড় নাই। মানসিক ধাক্কাটাতো শুরু হলো এখান থেকেই।

অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলবেন একজন সাকিব আল হাসানের ওপর এতো ভরসা করা ঠিক নয়। তিনি তো ছুটি চাইতেই পারেন। তাছাড়া সাকিব যদি সে সময় অসুস্থ থাকতেন তাহলেতো সাকিবকে ছাড়াই দলকে সাউথ আফ্রিকা যেতে হতো। এটাই বাস্তবতা। তবুও যদির কথা নদীতে ফেলতে চাই। সাকিব কেন দলের যে কোনও খেলোয়াড়ই দল থেকে ছুটি নিতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন আসে সাকিব কখন ছুটিটা নিলেন? যখন তাকে দলে খুবই প্রয়োজন তখন। এমন যদি হতো তিনি ছুটি নিয়ে বাসায় বিশ্রামে সময় কাটিয়েছেন তাহলে না হয় কথা ছিল। কিন্তু ছুটিতে থাকা কালীন সাকিবকে আমরা সামাজিক ও বিজ্ঞাপনী নানান কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে দেখেছি। তখন অবচেতন মনে একটা প্রশ্নই বার বার উঁকি দিয়েছে এই কাজগুলো তো তিনি সাউথ আফ্রিকা থেকে ফিরে এসেও করতে পারতেন?

এটা বাস্তব সত্য যে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বর্তমানে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। অথচ বিগত দুটি বছর দলের উন্নতির গ্রাফ ছিল অনেক ওপরে। দেশের মাটিতে ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এমনকি সাউথ আফ্রিকাকেও হারিয়েছে। সেই ক্রিকেট দলের হঠাৎ কেন এই দুর্গতি? নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে জবাবদিহি শুরু হবে? পত্রিকায় পড়লাম জবাবদিহি চাওয়া হতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ হাথুরু সিং-এর কাছ থেকেও। হ্যাঁ, এটাই তো হওয়ার কথা। দলকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনিই ভালো বলতে পারবেন দক্ষিণ আফ্রিকায় দল কেন এতো শোচনীয়ভাবে অব্যাহত গতিতে পরাজয় বরণ করেছে। দলের মূল সমস্যাটা কোথায়?

আমার ধারণা দলের মূল সমস্যাটা মানসিক। শক্তিধর প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলতে যাচ্ছি সেই তুলনায় কতটা শক্তি নিয়ে যাচ্ছি? এমন দুর্বল মানসিকতায় পেয়ে বসেছিল দলের তরুণ সদস্যদের মধ্যে। সাকিব আল হাসান নিজেও এমন একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সাকিবের চোখে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের হার অপ্রত্যাশিত নয়। অপ্রত্যাশিত হারের ধরন। তিনি প্রচার মাধ্যমে বলেছেন একটার পর একটা হার ড্রেসিংরুমের পরিবেশ যারপরনাই ভারি করে তুলেছিল। এটা অনেকটা ভাইরাসের মতো। একটা থেকে আরেকটায় এসেছে। যদি আমরা টেস্টে ভালো করতাম তাহলে আমি নিশ্চিত, ওয়ানডেতেও অনেক ভালো পারফরমেন্স হতো। ব্যাপারটা এভাবেই ঘটে। সাকিব আল হাসান আরো বলেছেন, যে কোনও সংকটে নিজেদের ফিরে পেতে অথবা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানসিক বাধা কাটিয়ে ওঠাটাই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক ফিটনেসের চেয়ে মানসিক ফিটনেস জরুরি হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে এখন মানসিক ফিটনেসটাই জরুরি।

নিউজিল্যান্ড সফরেও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হোয়াইট ওয়াশ হয়েছিল। কিন্তু ওই সফরে বাংলাদেশ দল প্রতিটি খেলায় লড়াই করে হেরেছে। লড়াই করে হারার মধ্যেও একধরনের আনন্দ আছে। তখন গর্ব করে বলা যায় ভাই আমি তো লড়াই করেছি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। তাই জয় পাইনি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল প্রতিটি খেলায় লড়াই করাতো দূরে থাক প্রতিপক্ষের সামনে ঠিকমত দাঁড়াতেও পারেনি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কেন দাঁড়াতেই পারলো না এই প্রশ্নের উত্তর আমিও খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমি নিশ্চিত সবাই একমত হবেন যে, এটাই বাংলাদেশের ক্রিকেট নয়।

হ্যাঁ আমরা এটাই ভাবতে চাই। দক্ষিণ আফ্রিকার দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যেতে চাই। সে জন্য দলের মধ্যে মানসিক দৃঢ়তা দরকার। সেটা কে সৃষ্টি করবে? হেড কোচ, অধিনায়ক নাকি ক্রিকেট বোর্ড?

দলের ক্রিকেটারদেরকেও নাকি প্রশ্নের মুখোমুখি করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। তাহলে ব্যর্থতার দায় কি শুধুই ক্রিকেটারদের? দলের ক্যাপ্টেনের? অন্যদের কি কোনোই দায় নাই? একথা সত্য, আমাদের ক্রিকেট কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। কাউকে দোষারোপ করে নয় বরং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সংকট মোকাবিলা করা জরুরি। জয় হোক বাংলাদেশের ক্রিকেটের।

লেখক: সাংবাদিক, কথা সাহিত্যিক, নাট্যকার

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
বাবার সঙ্গে অভিমান করে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
বাবার সঙ্গে অভিমান করে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
প্রেম নাকি বিয়ে, মুখ খুললেন ইলিয়ানা
প্রেম নাকি বিয়ে, মুখ খুললেন ইলিয়ানা
কুড়িগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালককে শোকজ
কুড়িগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালককে শোকজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ