X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘জঙ্গি দুলাল’ এবং দুষ্ট সিএনজি চালক

আহসান কবির
২৬ নভেম্বর ২০১৭, ১২:৫৭আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:২৩

আহসান কবির বাংলাদেশে সবচেয়ে ‘অজনপ্রিয়’শ্রেণির নাম সিএনজিচালক। আইন হাতে তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে পাবলিকের হাতে সিএনজিচালকদের অবস্থা যে কী হতো, সেটা বিধাতাই জানেন। এই সিএনজি সংক্রান্ত কারণে কয়েকদিন ধরে দুলাল সাহেব আলোচনায় এসেছেন। সাখাওয়াৎ হোসেন দুলালের প্রতি আমার মায়া জন্মেছিল দু’টি কারণে। প্রথম কারণ, তার স্ত্রী। তিনি কথায়, তা একটু পরে আসা যাবে। দ্বিতীয় কারণ হলো, মিশুক কাম সিএনজি।
তিন চাকার খুবই হালকা পরিবেশবান্ধব বাহন ‘মিশুক’, যা একদা সরকারই প্রমোট করেছিল ঢাকার রাস্তায়, সাতাশ-আটাশ বছর পরে মিশুক যখন আবার তুলে নেওয়া হয়, তখন দুলাল সাহেব মিশুকচালকদের পক্ষে সরব হয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন–একসময় আদর করে বলা হতো, আহ কী সুখ, মিশুক মিশুক। সেই মিশুককেই এখন ঢাকা শহরের রাস্তায় নামতে দেওয়া হচ্ছে না, অথচ ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মিশুকের সৎ ভাই সিএনজি! ইদানিং এই দুলাল সাহেব আবার সিএনজি ও এর চালকদের নিয়ে কেমনতর একটা আন্দোলনে নেমেছেন! সিএনজি বিষয়ে যাওয়ার আগে মায়াগত সেই প্রথম কারণে যাই।

সাখাওয়াৎ হোসেন দুলালের স্ত্রী একবার সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে কান্নাকাতর হয়ে দুলালের স্ত্রী বলেছিলেন–তার স্বামীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে। সম্ভবত তাকে গুম করা হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যরা এখন কিভাবে বেঁচে থাকবেন? দুলালের স্ত্রীর কান্নাকাটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীরও মায়া জন্মে। তিনি নির্দেশ দেন দুলাল সাহেবকে খুঁজে বের করার জন্য। এরপরই ঘটে যায় সেই ‘বোমা ফাটানো ঘটনা’! র‌্যাব এক সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেয়, তারা ১৯৯৯ সালে পল্টনে সিপিবির (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) সমাবেশে বোমা হামলা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিদের এগারো/বারো বছর পরে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। আসামিদের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত করে জানানো হয়, এরা সবাই জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য। এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের একজন স্পষ্ট করে জানতে চান–এরা সবাই কি জঙ্গি? র‌্যাবের মিডিয়া সেলের সেই সময়কার পরিচালক স্পষ্ট করে বলেন, হ্যাঁ সবাই জঙ্গি। তখন ওই সাংবাদিক আবারও জানতে চান–আসামিদের একজন হচ্ছেন সাখাওয়াৎ হোসেন দুলাল। তার স্ত্রী কয়েক মাস আগে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, তার স্বামীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে। তখন জোর দিয়ে বলা হয়–দুলাল জঙ্গি এবং তাকে কয়েকমাস বা দিন আগে না গতকালই গ্রেফতার করা হয়েছে! যাই হোক পরে জানা যায়, র‌্যাব যাদের চার্জশিটভুক্ত আসামি বলছে, সেই মামলার চার্জশিটই দেয়নি সিআইডি (মামলাটা তদন্ত করছিল সিআইডি)! একটি জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী পত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরে দুলাল সাহেব জামিনে ছাড়া পেয়ে যান!


মিশুকের মতো সিএনজি ও তার চালকদের নিয়েও কেমন একটা আন্দোলনে নেমেছেন আমাদের সেই দুলাল সাহেব! সিএনজি চালকদের নিয়ে কথিত আন্দোলন, ধর্মঘট, অ্যাপভিত্তিক ভাড়া নেওয়া যায়, এমন গাড়ির কোম্পানি ‘উবার’ও মোটরসাইকেল সার্ভিস ‘পাঠাও’ নিষিদ্ধ করারও নাকি ঘোষণা দিয়েছিলেন ভদ্রলোক! তবে জেনে রাখা ভালো যে, ২০১৬ সালের নভেম্বরে উবার এদেশে বৈধভাবে গাড়ি চালানোর অনুমতি চেয়েছিল। এখনও সেটা বাস্তবায়িত হয়নি এবং সরকারের এই সংক্রান্ত নীতিমালা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে গত একবছরে উবারের মতো মোটরসাইকেল সার্ভিস ‘পাঠাও’ এদেশে ধুন্দুমার জনপ্রিয় হয়েছে। এ রকম ‘স্যাম’ এবং ‘লেটস গো’ যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশে। সিএনজি চালকদের ওপর মহাবিরক্ত এদেশের মানুষ সিএনজি বাদ দিয়ে এইসব অ্যাপসভিত্তিক সার্ভিসের দিকেই ঝুঁকেছে। সিএনজি চালকদের মাথায় হাত এখন। তাদের ভাব ও ইনকাম দুটোই কমে গেছে। আর সিএনজি ও তার চালকদের নিয়ে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে আলোচিত হচ্ছেন দুলাল সাহেব।
তবে একশ জন সিএনজি চালকের সঙ্গে কথা বলে একটা জরিপ তৈরি করা হয়েছে। জরিপটা বেশ মজার। এই একশ জন সিএনজি চালকের কেউই দুলাল সাহেবকে সামনা-সামনি দেখেননি, তবে ওনার কথা শুনেছেন। বিশ/একুশ জন দাবি করেছেন, তারা দুলাল সাহেব সম্পর্কে ভালো জানেন। এই চালকদের মতে দুলাল সাহেব শুধু আল্টিমেটাম দেন এবং দুর্বার আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েও মাসের পর মাস কোন ফলপ্রসূ কর্মসূচি ঘোষণা করেন না। মিশুক চালকদের নিয়েও তিনি নাকি শুধু আল্টিমেটাম দিতেন! তার আন্দোলন নাকি শুধু সাংবাদিক সম্মেলনের ভেতর ও প্রেসক্লাবের সামনে! জরিপের এই সিএনজি চালকরা জানিয়েছেন সিএনজি মালিকরা ২০ টাকা করে করে ভাড়া বাড়িয়ে দিনে দিনে সেটা এক হাজার টাকায় উন্নীত করেছেন। আগে সিএনজি মালিকদেরকে সাড়ে চারশ থেকে ছয়শ টাকা প্রতিদিন দিতে হতো চালকদের। সেটি এখন নয়শ থেকে বারশ টাকা হয়েছে। চালকরা দুঃখের সঙ্গে জানিয়েছেন এখন তারা আর ‘সিঙ্গেল’প্যাসেঞ্জার পান না। এরা নাকি সব ‘পাঠাও’তে যাওয়া-আসা করেন। এমনকী নারীরাও নাকি এখন মোটরসাইকেলের দুইপাশে দুই পা দিয়া পাঠাওতে চড়ে বসে! যে সিএনজি চালকরা মিটারে যেতে চাইতো না, প্রচণ্ড রোদ কিংবা সামান্য বৃষ্টিতে দুই গুণ ভাড়া চাইতো, অসুস্থ বা বিপদে পড়া মানুষকে যেভাবে জিম্মি করে টাকা নিত তারাই এখন উবার বা পাঠাও এর মতো অ্যাপসভিত্তিক সার্ভিসে রূপান্তরিত হতে চায়! তাদের এই বদলে যাওয়ার কারণ কি দুলাল সাহেবের আন্দোলন? উত্তর–না! আগে সিএনজি চালকরা অর্ধেকদিন কাজ করে যে টাকা কামাতেন এখন তারা দিন ও রাতে দ্বিগুণ পরিশ্রম করেও সেই টাকা কামাতে পারছেন না। এছাড়া ২০০৩-২০০৪ সালে বেবিট্যাক্সি উঠিয়ে দিয়ে যেসব সিএনজি (কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস। তিন চাকার এই গাড়ি বেবিট্যাক্সির মতো তেলে চলে না, গ্যাসে চলে। বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী ভারতবিরোধী রাজনীতি করলেও ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা ভারতের তৈরি লাখো সিএনজি আমদানি করে। ভারতের কাছ থেকে এই সিএনজি কিনতে যতো টাকা লাগতো তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ লাগতো সেই সময়কার প্রেসক্রাইবড কোম্পানি থেকে সিএনজি কিনতে ও রুট পারমিট বের করতে) রাস্তায় নামানো হয়েছিল, সেগুলোর সবটা ২০১৭-১৮ সালে এসে ফিটনেস ও অন্যান্য সার্টিফিকেট পাবে কিনা, সন্দেহ আছে। সিএনজির মালিক ও চালকরা তাই চিন্তিত আর দুলাল সাহেব এটাকে ইস্যু বানিয়ে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে চমক তৈরির চেষ্টা করছেন।
তাহলে সিএনজির কি কোনও কিছুই ভালো না? ভারতের তৈরি বলে কি এর চালকরা এত অজনপ্রিয়? কোনও চমক নেই এই বাহনে? উত্তর, অবশ্যই আছে। ট্রাকের পরে এদেশে সিএনজিই সবচেয়ে বেশি ক্রিয়েটিভ। ট্রাকের তেলের ট্যাংকি কিংবা সিএনজি সিলিন্ডারের গায়ে যতো ছন্দ আছে সেটা অন্য কোনও বাহনে নেই। যেমন-ডিজেল আমি বলছি/জন্ম থেকে জ্বলছি। মোজে পিনে দো। যদি থাকে পেটটা ভরা ভয় পাই না বিদেশ ঘোরা! সিএনজির পেছনে তেমনি লেখা থাকে-আমি ছোট্ট দয়া করে আমাকে মারবেন না (কখনও কখনও লেখা থাকে আমাকে ধাক্কা দিবেন না!) দেহ কাটবে পোকে/সম্পদ খাইবে লোকে! দুনিয়াটা অনেক বড়/মনটা কেন ছোট করো? অথবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদালত হচ্ছে মানুষের বিবেক। এত ক্রিয়েটিভ বাহন আমরা কোথায় পাবো? তবে সিএনজির পেছনে লেখা দুটো লাইন দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। লাইন দুটো হচ্ছে–ডালিম পাকিলে এমনি ফাটিয়া যায়/ছোটলোক বড় হলে বন্ধুরে কাঁদায়!

বিশেষ দ্রষ্টব্য: সিএনজির চালক কিংবা মালিকরা কি পাবলিককে এতদিন কাঁদিয়েই এসেছেন? এইজন্য কি পাবলিক এখন তাদের কাঁদাবে? কে কাকে কাঁদাবে সেটা বিশ্লেষণ না করে আসুন কয়েকটা প্রশ্ন ও এর সঠিক উত্তর শুনে বিদায় নেই।

প্রশ্ন: ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে–ওকে। সংকেত দিন। এই ‘ওকে’ মানে কী?
উত্তর: ওকে হচ্ছে দুটো ইংরেজি শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। পূর্ণরূপ হচ্ছে–অরিজিনাল কিলার!

প্রশ্ন: চালকদের এযাবৎ কালের আন্দোলনের সবচেয়ে বড় পাওয়া কী? কমপক্ষে দু’টি উদাহরণ দাও।

উত্তর: প্রথমটা অ্যালার্মিং। কোনও এক আমলে নিয়ম করা হচ্ছিল যে চালকদের ন্যূনতম এসএসসি পাস করতে হবে। চালকরা তখন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। আর দ্বিতীয় হচ্ছে শিল্পী মমতাজ বেগমের জনপ্রিয় গান–বন্ধু তুই লোকাল বাস/আদর কইরা ঘরে তুলিস ঘাড় ধইরা নামাস! (আশা করি মমতাজ সিএনজি ড্রাইভারদের নিয়েও গান গাইবেন)

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ