X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আনিসুল হককে দেখতে যেতে পারতেন খালেদা জিয়া

মাসুদা ভাট্টি
০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:০৮আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৩২

মাসুদা ভাট্টি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র, জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, সফল ব্যবসায়ী আনিসুল হককে যেভাবে দেশবাসী (বা ঢাকাবাসীও বলতে পারেন) বিদায় জানালো, তা অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ঘটবে কিনা, সন্দেহ রয়েছে। সর্বস্তরের মানুষ এই  মানুষটিকে অন্তর থেকে ভালোবেসেই বিদায় জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসে প্রয়াত আনিসুল হকের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, বুকে টেনে নিয়েছেন তার স্ত্রীকে, সান্ত্বনা দিয়েছেন ছেলেকে, ভাইকে, পরিবারের বাকিদের। জাতি দেখেছে এক বেদনার দৃশ্য। আনিসুল হক ভাগ্যবান, তিনি এ রকম তুমুল জনপ্রিয়তা, অগণিত মানুষের ভালোবাসা আর দোয়া নিয়ে পৃথিবী ছেড়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক এবং নিন্দাজনক হলো, আজকে আমরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে এরকম একজন জনপ্রিয় ব্যক্তির মৃত্যুতেও বিদায় জানানোর অনুষ্ঠানে দেখিনি। অনেকেই হয়তো বলবেন, আনিসুল হক তো তার দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছিলেন। মেনে নিচ্ছি সে কথা এবং তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মৃত্যুতে শোক না জানাতে কিংবা তাকে শেষ বিদায় জানাতে না আসতেই পারেন। কিন্তু আনিসুল হক তো কেবল ঢাকা শহরের মেয়রমাত্র নন, তিনি এদেশের একজন জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, তৈরি পোশাক শিল্পের পুরোধা ব্যক্তি এবং দেশের ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সাবেক প্রেসিডেন্টও। তার মৃত্যুও করুণ ও মানুষ-কাঁদানো, এমন নয় যে তিনি পরিণত বয়সে দীর্ঘ রোগে ভুগে মারা গিয়েছেন, এ মৃত্যু নাড়া দেয়নি, এমন মানুষ এদেশে কমই পাওয়া যাবে। ফলে আনিসুল হককে বিদায় জানাতে, তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে দু’টো সান্ত্বনার বাক্য শোনাতে, দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা এবং দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে খালেদা জিয়া আজকে আসতেই পারতেন। তার বাসভবন থেকে আনিসুল হকের বাসভবন খুব বেশি দূরেও ছিল না যে, তিনি শারীরিক অসুস্থতার বাহানায় আসতে পারবেন না কিংবা আজকে তার দলের ডাকা হরতালও ছিল না। কিন্তু তিনি আসেননি। আমার মনে হয়, এখানেই আমাদের দেশের রাজনীতির একটা ভয়ঙ্কর ও অসুন্দর জায়গা নিহিত আছে। আজ সে বিষয়টিতে আলোকপাত করতে চাই।

ধরুন, আজকে খালেদা জিয়া প্রয়াত আনিসুল হকের মৃতদেহ দেখতে এসেছেন তার বনানীর বাসভবনে। সে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেখানে আছেন, আছেন দুই দলের অনেক নেতাকর্মী। দু’পক্ষ একজন জনপ্রিয় মানুষের মৃত্যুতে শোক জানাতে এসেছে, দেশের মানুষের সামনে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য কী আর হতে পারতো? পারতো না। ধরুন, খালেদা জিয়া যদি শেখ হাসিনার মুখোমুখি নাও হতে চাইতেন কিংবা শেখ হাসিনা যদি খালেদা জিয়ার মুখোমুখি না হতে চাইতেন, তাহলেও সেটি কোনও সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। দু’পক্ষই দু’জনকে এড়িয়ে আনিসুল হককে দেখতে আসতে পারতেন। তাতে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞাই প্রকাশিত হতো, তিনি তার দলীয় রাজনীতিবিদ বা কর্মী-সমর্থকদের কাছেও বাহবা পেতেন। আর সবচেয়ে বেশি তিনি প্রশংসা পেতেন মিডিয়ার কাছ থেকে। কারণ তিনি এখন যেখানেই যান, যে কথাই বলেন, মিডিয়া তা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে, যদিও তার দলের পক্ষ থেকে বার বার মিডিয়াকে দোষারোপ করা হয়। অথচ তারা সবাই ভুলে যান যে, আজও বিএনপি যতটুকু রাজনীতি করছে, তার বেশিরভাগটাই আসলে মিডিয়ায়। এমনকি আন্তর্জাতিক বন্ধুদের কাছেও খালেদা জিয়া প্রশংসিত হতেন যদি আজ আনিসুল হকের বাড়িতে আসতেন। কিন্তু তারাও আজ কী বার্তা পেলেন? তারাও জানলেন যে, বিএনপি নেতা আসলে রাজনীতি করেন শুধু, তিনি রাজনীতির বাইরে কোনও কিছুই দেখেন না, এমনকী মানুষের মৃত্যুও তার কাছে কেবলই রাজনীতি।

আমরা সব সময়ই এদেশের রাজনীতিতে কেবল আশা করি যে, আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা এগিয়ে যাবেন সমঝোতার বার্তা নিয়ে, তিনিই হাত বাড়াবেন সম্মিলনের। কেউ একথা একবারও বলি না যে, আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার বাড়ানো হাত কতবার কতভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে? আমরা স্মরণ করি, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগের দিনগুলোর কথা। কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে, রাজনীতিকে যেতে হয়েছে। কোনও সমঝোতার জায়গা নেই বলে ধরে নিয়ে অসহায় বাঙালি কেবল রাজনীতির আগুনে পুড়ে কয়লা হয়েছে, নষ্ট হয়েছে দেশের সম্পদ। শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সমঝোতার আহ্বান জানানো হয়েছে একাধিকবার। আমাদের স্মরণে আসে সেই বিখ্যাত টেলিফোন কথোপকথনের কথা, যেখানে শেখ হাসিনাকে খালেদা জিয়া কেবলই ধমক দিয়েই যাচ্ছেন আর শেখ হাসিনা তাকে অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আবার দেখেছি খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখা করতে গিয়েও পারেননি, তাকে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। আমরা এই ঘটনার সমালোচনা করেছি, নিন্দা করেছি কিন্তু একথা কেউই বলিনি যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ঘটনা আরেকটি ন্যাক্কাজনক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকলো। একই রকমভাবে আনিসুল হকের মৃত্যুর পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা হিসেবে খালেদা জিয়ার জন্য তার লাশ দেখতে না যাওয়া, তার পরিবারকে একটুখানি সান্ত্বনা না দেওয়ার বিষয়টিও এদেশের রাজনীতিতে, এদেশের ভবিষ্যতের জন্য কোনও ইতিবাচক উদাহরণ হলো না, বরং আমি আগামীতে জনগণকে জিম্মি করা রাজনীতির ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখাই দেখতে পাচ্ছি।

রাজনীতিতে সমঝোতা এবং সহযোগিতার বিকল্প নেই, তা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যতোই তাত্ত্বিক, নীতিগত বা ঐতিহাসিক বিরোধ থাকুক না কেন। পৃথিবীর কোনও দেশেই গণতান্ত্রিক রাজনীতি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকৃত রাজনীতির ক্ষেত্রে সহাবস্থানপূর্বক ঐক্য না থাকলে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এক ব্যাপার আর দেশের স্বার্থে ও রাজনীতিতে সংঘাত এড়ানোর জন্য সব পক্ষকে সহনশীলতা প্রদর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। প্রথমটি গণতন্ত্রের জন্য জরুরি, দ্বিতীয়টি দেশের অস্তিত্বের জন্য অত্যাবশকীয়। কারণ দেশের জন্য গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের জন্য দেশ নয়। দেশ থাকলে, দেশের অস্তিত্ব (পড়ুন স্বাস্থ্যবান অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাস্থ্যকর রাজনীতি) টিকে থাকলে গণতন্ত্র স্বাস্থ্যবান হতে বাধ্য কিন্তু দেশের অস্তিত্বই যদি বিপন্ন হয় তাহলে সেখানে গণতন্ত্র থাকার প্রশ্নই আসে না। পাকিস্তানের উদাহরণ আমাদের সামনে জ্বলজ্বল করছে, এখন সেখানে যে অবস্থা তাতে দেশটির সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র ধুয়ে পানি খাবে, নাকি নিজের জীবনটা বাঁচাবে?

সত্যি কথা বলতে কী, আজকে আনিসুল হকের মৃত্যুই হতে পারতো দেশের দু’টো রাজনৈতিক দলের ভেতরকার উত্তপ্ত অবস্থাকে শান্ত করার সামান্য বা প্রথম প্রয়াস। অন্তত দেশের মানুষ এটাও ভাবতে পারতো যে, না একজন মানুষ বেঁচে থাকতে যেমন দুই নেত্রী বা দু’টো দলকে সমঝোতায় আনার চেষ্টা করেছেন, তার মৃত্যুতেও তিনি সেই কাজটি করে গিয়েছেন। বিএনপি’র পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল এসেছিল জানাজায় অংশ নিতে, কিন্তু সত্যিই ভালো হতো যদি বিএনপি নেত্রী খোদ আনিসুল হকের বাড়িতে আসতেন। তিনি কিন্তু আজকে তার দলীয় কার্যালয়ে ঠিকই তার পুত্র তারেক রহমানকে নিয়ে লেখা পুস্তকের মোড়ক উন্মোচন করেছেন দলীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে। সেখানে তিনি বিএনপি’র প্রতি মানুষের ভালোবাসায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এই ভালোবাসা আরও হাজার গুণে বাড়তো যদি তিনি আজকে আনিসুল হককে দেখতে আসতেন, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটি হয়নি, হওয়ার নয় আসলে এদেশে। রাজনীতির ঊর্ধ্বে আমরা যেন উঠতেই পারছি না কখনও। তাই একটু আগেই বলেছি যে, বাংলাদেশের রাজনীতি আসলে খুব সহজে বা শিগগিরই কোনও শান্তিপূর্ণ জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে না, জনগণকে আরও কষ্ট আর যন্ত্রণা দিয়ে আবারও একটি সংঘাতের পথেই হাঁটছে। আবারও হয়তো আমরা আশা করছি যে, আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা হাত বাড়িয়ে দেবেন সমঝোতার, আর খালেদা জিয়া আবারও তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তা প্রত্যাখ্যান করবেন। আবারও সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠবে দেশ, আবারও দেশের মানুষ হবে তার জিম্মি।

আনিসুল হক কেমন মানুষ ছিলেন, আজকে দেশের মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সেসব বলছে। তিনি যখন লন্ডনে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তখন তাকে নিয়ে অসংখ্য গুজব তৈরি হয়েছে। কখনও কখনও সেসবের কিছু কিছু বিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়ায় আজকে নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে খুব। সে জন্য ক্ষমা চাওয়ারও জায়গা তিনি রাখেননি আর, চলে গেছেন। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

ঘুমান আপনি শান্তিতে আনিসুল হক, বাংলাদেশের অশান্তি আপনাকে স্পর্শ করবে না আর, এই মুক্তি আপনি পেয়েছেন। যারা আমরা এদেশে বেঁচে আছি তাদের মুক্তির জন্য ওপার থেকে আপনি শুভাকামনা পাঠাবেন আশা করি।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
আজও উদঘাটন হয়নি ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা বাবু হত্যার রহস্য
হৃদয় বিদারক সেই ঘটনার ১১ বছরআজও উদঘাটন হয়নি ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা বাবু হত্যার রহস্য
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ