X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বড়দিন ও ধর্মীয় বাংলাদেশি

দাউদ হায়দার
২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১০:১৭আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৪৮

দাউদ হায়দার ছোট বয়সে, পাবনা শহরের দিলালপুরে এক শাদা সাহেবকে দেখতাম। চমৎকার একতলা বাড়িতে বাস, বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে। বাড়ির সামনে নানা ফুলের গাছ-গাছালি। সাহেবের বোধহয় কোনও মালি ছিল না। নিজেই মাটি কাটা থেকে শুরু করে বাগানের পরিচর্যা করতেন। কখনও সঙ্গী তার বৌ। ছেলেমেয়ের বয়স ৭/৮ হবে। বাগানে খেলতে দেখেছি। সাহস হয়নি বাগানে ঢোকার। আমাদের কাছে বিস্ময় ছিল সাহেবের বৌয়ের পরনে স্লিভলেস ব্লাউজ, স্কার্ট (যদিও হাঁটুর নিচে)।
ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির পরেও সাহেব কেন থেকে গিয়েছিলেন, তাও আবার পাবনার দিলালপুরে, অজানা। কি করতেন, চাকরি না ব্যবসা বলতে অপারগ। সাহেবের কোনও গাড়ি ছিল না। তার বাড়িতে একটি দশাসই জোয়ান লালচে ঘোড়া  ছিল, ঘোড়া গাড়ি ছিল। ঘোরাগাড়িতে, মাঝে-মাঝে বিকেলে, বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুরতেন। ইছামতি নদীর তীরে হাওয়া খেতে যেতেন। নিজেই সহিস।
পাবনার লোক তাকে ‘টম সাহেব’ বলতো। কারণ ছিল। ‘টমটম’ মানে ঘোড়ার গাড়ি বলা হতো একদা।
বড়দিনে সন্ধ্যায় সাহেবের বাড়ির বারান্দায়, রেলিঙে সারি সারি মোমবাতির আলো দেখার লোভ সামলাতে পারিনি। সাহেবের চোখে পড়লে বলতেন, ‘তোমাকে কেক দিবো, প্রভু যিশুর জন্মদিনে আমার ওয়াইফ করিয়াছেন’। কেক নিয়ে দ্রুত প্রস্থান। পাছে কেউ দেখে ফ্যালে।
সাহেবকে দেখেছি কালাচাঁদ পাড়ায়, রাধানগরে পুজোর মণ্ডপে বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুরতে। মণ্ডপের সামনে মেলা, মেলায় রঙবেরঙের হরেক জিনিস, নানারকম খেলনা। সাহেব কিনে ছেলেমেয়েদের উপহার দিতেন। বাড়ি ফিরতেন টমটমে চড়ে।
একবার বড়দিনে মন খারাপ হয়ে যায়। বড়দিন ছিল রবিবারে। তখন, রবিবারে সরকারি ছুটি। স্কুলও ছুটি। ইউরোপসহ পৃথিবীর নানা দেশে শনি-রবিবারে ছুটি। বড়দিন দিন যদি রবিবারে হয়, পরদিন ছুটি, তারপরের দিনও খ্রিস্টমাসে খ্রিস্টের উৎসব। ধর্মীয় দিক বাদ দিয়ে উৎসব মূলত  ছোটদের। নানা উৎসবের আয়োজন। স্কুলে, পার্কে, হলে (প্রেক্ষাগৃহে), বাড়িতে। খ্রিস্টমাসেই, ইউরোপে ছোটদের জন্যে (শিশু-কিশোর) গল্প, উপন্যাস প্রকাশিত। শিশুতোষ বইয়ে মজার-মজার রঙিন ছবি। বলা হয় ‘ডিসেম্বর শিশু সাহিত্যের মাস’। এবছর জার্মানিতে ১১৭টি বই বেড়িয়েছে। শিশুদের খেলনা ছাড়াও বই উপহার দেওয়াই রেওয়াজ। পোশাক। আমাদের দেশে ঈদে, পুজোয় পোশাকই তালিকায় পয়লা, বই নয়।

বড়দিন উপলক্ষে (বড়দিন শুরু ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে), ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে, ছোটদের স্কুলে (যথা কিন্ডারগার্টেন) নানা অনুষ্ঠান শুরু হয়। হাসিখুশি- আনন্দের অনুষ্ঠান, ছোটদের গানবাজনা, যেমন খুশি সাজো।

বড়দিনের সপ্তাহেই কচি ছেলেমেয়েরা (বয়স যাদের ছয় থেকে আট) স্কুলের সহপাঠীদের বাড়ি যায়। গেলে উপহার পায়। হোক তা পুতুল বা বই, বাবামায়ের ট্যাঁকে নিশ্চয় টান পড়ে। পড়লেও নিরুপায়। ছেলেমেয়েদের সহপাঠী বন্ধুদের খুশি করতেই হবে। না করলে ছেলেমেয়ে ব্যাজার। সমস্যা আরও ঘন। বিশেষত মুসলিমদের ছেলেমেয়ে এদেশের কালচারে বড় হচ্ছে। ধর্ম গৌণ। ধর্ম বাড়িতে। কেউ বাঁধা দিচ্ছে না।

বাংলাদেশের রাজিমুল, রাজিমুলের স্ত্রী রাজিয়া অতীব ধর্মীয়। রোজা, নামাজ তো আছেই, রাজিমুলের লম্বা দাঁড়ি। মাথায় টুপি। রাজিয়ার মাথায় হিজাব, তাও প্রায় বোরখার মতো, চোখ দেখা যায় না। ওদের বাসার দেওয়ালে দুটি ছবি। একটি কাবাশরিফের। একটি আরবিতে লেখা কোনও এক সুরা। কি সুরা জিজ্ঞেস করিনি।

রাজিমুল, রাজিয়ার কন্যার নাম শুনে কান ঝালাপালা। আরবি নাম নয়, নাম কৃষ্ণাবতী। জিজ্ঞেস করলেম, ‘কৃষ্ণাবতী মানে জানো?’ স্বামী-স্ত্রীর অমায়িক উত্তর, ‘ঘনঘুট্টি অমাবশ্যার কালো রাতে জন্ম, তাই নাম দিয়েছি কৃষ্ণাবতী। সুন্দর নাম নয়?’

বলি নিশ্চয়। হিন্দুরাও এ-নাম রাখে না।

রাজিমুল, রাজিয়া কি বুঝলে, কে জানে। বললে, ‘কৃষ্ণাকে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছি। আমরা আল্লাহর পরহেজগার বান্দা। ইসলামই আমাদের জীবন। কিন্তু, মেয়ে আমাদের দোজখে পাঠাচ্ছে। সহপাঠি/পাঠিনীর বাড়িতে গিয়ে দেখছে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো। ট্রি আলোয় ঝলমল। ট্রিতে নানা উপহার সজ্জিত। মেয়েরও বায়না ক্রিসমাস ট্রির। সাজাতে হবে উপহার দিয়ে। না সাজালে স্কুলের বন্ধুরা ওকে আজেবাজে বলবে। মেয়ের জন্যই খ্রিস্টমাস কিনতে হলো, ষাট ইউরো দিয়ে। সাজাতে আরো ৪৫ ইউরো খরচ। গাছের ডালে-ডালে ছোটবড় উপহার টাঙিয়েছি, ১৭৮ ইউরো খরচ। আল্লাহ, গুনাহ মাফ করো’। বললাম, যে-দেশে থাকো সেই দেশের সব সুযোগ সুবিধে নেবে, মেয়েকে ইউরোপিয়ান কালচারে মানুষ করবে, খ্রিস্টিয় উৎসবে সমস্যা কোথায়? ধর্ম ও উৎসব আলাদা। শিশুর ধর্ম নেই, উৎসবই মূল। দুজনই বললো, ‘আল্লাহ, আমাদের গুনাহ মাফ করো, কৃষ্ণাবতী হাসিখুশি, আনন্দে সুখে থাকো’। বার্লিনে বহু সাহেব মুসলমান পূজায় যায়। বাঙালির বড়দিনের অনুষ্ঠানেও।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

/এফএএন/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করলো ইইউ
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করলো ইইউ
মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আ.লীগের, আছে শাস্তির বার্তাও
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আ.লীগের, আছে শাস্তির বার্তাও
সিংড়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে শোকজ, ইসিতে এসে জবাব দেওয়ার নির্দেশ
সিংড়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে শোকজ, ইসিতে এসে জবাব দেওয়ার নির্দেশ
ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে ভারতীয় নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রস্তুতি কেমন?
ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে ভারতীয় নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রস্তুতি কেমন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ