X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্রদলের ৩৯ বছরের উপপাদ্য

সর্দার আমিরুল ইসলাম
০১ জানুয়ারি ২০১৮, ১৯:২৭আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০১৮, ১৯:৩৬

সর্দার আমিরুল ইসলাম এই কথা বলে শুরু করলে কোনও অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যত সংগঠন বিকাশ লাভ করেছে, এর মধ্যে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন।
ছাত্রজীবন যেমন কর্মজীবনে প্রবেশের প্রস্তুতিকাল, তেমনি ছাত্ররাজনীতিও জাতীয় রাজনীতির প্রবেশের প্রস্তুতি স্বরূপ। কর্মী সংগ্রহ, নেতৃত্ব বাছাই, প্রতিযোগিতামূলক বিকাশ ও জাতীয় রাজনীতিতে নেতা সরবরাহের যে প্রক্রিয়া ছাত্রদলে অনুসৃত হয়, তা ছাত্রদলকে নিয়ে গেছে শ্রেষ্ঠতম শিখরে।
ব্রিটিশ আমল থেকেই বাংলাদেশসহ পুরো ভারতবর্ষে ছাত্রসংগঠনগুলো যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ছাত্রদল একেবারে তার ব্যতিক্রম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই ভূমিতে শাসক শ্রেণির বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যেই সাধারণত কালে কালে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের। এই বিরোধিতা প্রায় গঠনমূলক হলেও ক্ষেত্রবিশেষে অন্তর্ঘাতমূলকও হয়। তা অবশ্যই ভিন্ন আলাপ।
ছাত্রদলের জন্মলগ্নের অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, এই সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ‘উৎপাদনের রাজনীতি’ তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে। ‘উৎপাদনমুখী শিক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের লক্ষ্য’ স্লোগানকে ধারণ করে ছাত্রদল প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জিয়াউর রহমানের উন্নয়নের রথে সারথির ভূমিকা পালন করে গেছে।  জিয়াউর রহমান তার স্বভাবসূলভ দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীন দেশে উৎপাদন ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, আমলাসহ নানা পেশাজীবীর মতো প্রয়োজন মেধাভিত্তিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের। তাই ‘শিক্ষা ঐক্য প্রগতি’-কে ব্রত করে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছাত্রদল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। এই চাহিদা পূরণে আগামীর প্রয়োজনে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ১ জানুযারি গঠন করেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের গ্রুমিং গ্রাউন্ডে cমূলত ৩ টি ছাত্র সংগঠন। ন্যাপ (ভাসানী) ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রদল, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি) ছাত্রসংগঠন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) ছাত্রসংগঠন জাগ ছাত্রদল। জিয়াউর রহমান ও তার ছাত্র-বিষয়ক উপদেষ্টা মুস্তাফিজুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই তিন ছাত্র সংগঠনের রসায়নে গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।

প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর একান্ত ভক্ত ছিলেন। জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট তৈরির পূর্ব-মুহূর্তে টাঙ্গাইলের সন্তোষে মওলানার দোয়া নিতে যান। মওলানা জিয়াউর রহমানকে তার দলের প্রতীক ‘ধানের শীষ’ ও ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রদল উপহার দেন। যে কারণে জাগ ছাত্রদলের আহ্বায়ক মীর্জা খবির কিংবা মুস্তাফিজুর রহমানের পছন্দের লোক জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রথম আহ্বায়ক কাজী আসাদকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রথম সভাপতি না করে, করা হয় এনামুল করিম শহীদকে। পরবর্তী আহ্বায়ক ও সভাপতি ছিলেন গোলাম সারোয়ার মিলন। এনারা দুই জনই ভাসানী ন্যাপের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রদল থেকে এসেছিলেন।

আমাদের জলবায়ুগত কারণেই কোনও সংগঠন যদি সরকার সমর্থক হয়, বিশেষত তা যদি হয় ছাত্র সংগঠন তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের দালাল উপাধি পেতে বেশি সময় লাগে না। ইতিহাসও তাদের নিক্ষেপ করে আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এখানেও ব্যতিক্রম। জিয়াউর রহমানের উন্নয়নের সহযোগী হয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের ছাত্র-জনতার মণিকোঠায় জায়গা করে নিতে খুব বেশিদিন সময় নেয়নি। প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ টি হল সংসদে ছাত্রদের ভোটে জিতে যায় ছাত্রদল। পরবর্তী বছর ১৯৮১ সালের ডাকসু নির্বাচনে ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল ছাড়া বাকি সব হলে একচেটিয়া বিজয় অর্জন করে ছাত্রদল। ছাত্রদলের এই সর্বজনপ্রিয়তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকা শহরের গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। স্বৈরাচারী এরশাদের সময়ে ডাকসু, বাকসু, রাকসু, চাকসুসহ বিভিন্ন কলেজ পর্যায়ে ৩০৮ টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ২২১ টি সংসদেই বিজয় অর্জন করে  ছাত্রদল। (উৎস: বর্তমান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু’র বক্তব্য থেকে)
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এই অভূতপূর্ব বিজয়ের মধ্যে দিয়েই মূলত সারা দেশে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বীজ রোপিত হয়। জিয়াউর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত ছাত্রদল দেশের মানুষকে দ্বিতীয়বারের মতো মুক্ত আবহাওয়ার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের চার দশকের পথচলায় সবচেয়ে বড় অর্জন ১৯৯০ এর গণ-অভ্যুত্থান, যা আমাদের মহান স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতি’র সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা বলে স্বীকৃত।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল উৎপাদনের রাজনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও সামজিক ন্যায়বিচার-ভিত্তিক মানবকল্যানমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতি গঠনের চিন্তা শুধু ছাত্রসমাজের মধ্যে নয় দেশের নাগরিকদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়। যার ফলে ছাত্রদলের ওপর ভিত্তি করে খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে দেশের জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করেন।
ভিনি, ভিডি, ভিসি-র মতো জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এই উত্থান কোনও অঘটন ছিল না। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শ ধারণ করে দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে পথ চলছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সংগঠনে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা প্রবল কিন্তু কখনও সেটা ভ্রাতৃঘাতী হয়ে ওঠেনি। যার ফলে সুদীর্ঘ এই সময়ে একবারের জন্যও ভাঙনের মুখে পড়েনি ছাত্রদল। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো যেখানে প্রতিনিয়তই ভাঙনের মুখে থাকে, সেখানে প্রায় ৪০ বছর কোনও রকম ভাঙন ছাড়াই পার হয়ে গেলো। নানা স্তরের নেতাকর্মীদের ইস্পাত কঠিন নৈতিকতা বোধ ও সংগঠনের প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাসের কারণেই ছাত্রদল এখন পর্যন্ত তার একাকিত্ব ধরে রেখেছে।
ছাত্রদল দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, মানবিক, উৎপাদন ও উন্নয়নমুখী দেশ এবং সমাজ গড়ার আদর্শকে দেশের জনগণ বিশেষ করে ছাত্রসমাজের হৃদয়ে প্রোথিত করে তা বাস্তবায়নের আন্দোলন সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে। যে কারণে ২০০৭ সালের ১/১১-খ্যাত অস্বাভাবিক সরকার এসেছিল, তখন ছাত্রদলই প্রথম রুখে দাঁড়িয়েছিল।
২০০৮ সালের প্রহসনের নির্বাচন ও ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসা গণতন্ত্রের আড়ালে নব্য স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনেও ছাত্রদল প্রথম কাতারের সৈনিক। বিএনপির হিসাব মতে, এই স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে পার্টির নেতাকর্মীদের মাথায় মিথ্যা মামলার সংখ্যা ৭৮ হাজার ৩২৩টি, আসামির সংখ্যা ৭ লাখ ৮৩ হাজার ২৩৮ জন, সরাসরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মোট খুন ৫২০ জন, অপহরণের সংখ্যা ৭৪৭ জন, এখন পর্যন্ত নিখোঁজ আছে ১৫৭ জন, নির্যাতনের শিকার ৩৭ লাখ।’ দল, দেশ ও গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী ছাত্রদলের ওপর দিয়েই যে এই রোষের মূল খড়্গ পতিত হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গঠনতন্ত্র বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভারী নয় ছাত্রদল। এ দলের কর্মকৌশল এর অভিজ্ঞ সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ের মাধ্যমে সুদক্ষ রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে ব্যবহার করে কর্মসূচি গ্রহণ এবং নতুন নেতৃত্ব গঠনের মাধ্যমে সংগঠনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়। তাই অন্য যেকোনও সংগঠনের চেয়ে গতিশীল সংগঠন ছাত্রদল।
ছাত্রদল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনার রাজনৈতিক সূতিকাগার। এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতি, আদর্শ ও সুযোগ্য নেতৃত্বের সমন্বয়ে গৃহীত কর্মসূচি ও তা বাস্তবায়ন বৃহত্তর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে এতটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, দুই-একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি ছাড়া এখন পর্যন্ত ছাত্রদলের নেতার মধ্যে কোনও দলছুট হওয়ার প্রবণতা নেই। ছাত্রদলের আদর্শের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ, সেই আদর্শকে বাস্তবায়নের আন্দোলনে সরাসরি জড়িত ছাত্রসমাজের সদস্যরা ছাত্রজীবন শেষেও জাতীয়তাবাদী চেতনার আদর্শেই অনুপ্রাণিত থাকেন। এ কারণেই ছাত্রদলের মাধ্যমে গড়ে ওঠা নেতৃত্ব চলমান সুবিধাবাদী রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয় না। বরং সংযুক্ত হয় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী আদর্শের ধারক ও বাহক বিএনপি ও নানা অঙ্গ-সংগঠনে।
ছাত্রদল মূলত বিএনপি ও এর সহযোগী-অঙ্গসংগঠনগুলোর জন্য দক্ষ, মেধাবী, প্রজ্ঞাবান ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে প্রশিক্ষিত নেতাকর্মী তৈরির বিদ্যাপীঠ। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, প্রশিক্ষিত রাজনৈতিক কর্মীই একটি দলের প্রাণশক্তি। ছাত্রদল থেকে উঠে আসা নেতারা প্রশিক্ষিত রাজনৈতিক কর্মীরা  প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহযোগী হয়ে বিভিন্ন অঙ্গ-সঙ্গঠনে নিজেকে যুক্ত রাখেন। যা অন্য যেকোনও ছাত্র সংগঠন থেকে এই সংগঠনটির স্বাতন্ত্র্যকে  দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
১৯৭৯ সালের এই দিনে ভূমিষ্ঠ হওয়া ছাত্রদল আজ ৩৯ বছরের যুবক। শিক্ষা, ঐক্য ও প্রগতির যে সুমহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল, কালের পরীক্ষায় অনেকটাই উত্তীর্ণ। বিগত দিনের মতো অনাগত দিনেও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশকে সবার আগে স্থান দিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল একটি গণতান্ত্রিক, স্পন্দনশীল, বহুত্ববাদী সমাজ বির্নিমাণ করবে বলেই সংগঠনটির একজন কর্মী হিসেবে আশা করি।

লেখক: জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা-বিষয়ক সম্পাদক

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ