X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘ঘুষ বাণিজ্য’ই শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য!

রেজানুর রহমান
২৪ জানুয়ারি ২০১৮, ১৭:০৪আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০১৮, ১৭:০৬

রেজানুর রহমান হেড কেরানির সামনে কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছেন আজিজুল মাস্টার। হেড কেরানি তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। আজিজুল মাস্টার যত ভাবে পারা যায় হেড কেরানিকে কনভিনস করার চেষ্টা করছেন। কোথায় হেড কেরানি তাকে স্যার স্যার বলে অস্থির হয়ে কথা বলবেন তা না আজিজুল মাস্টারই হেড কেরানিকে ‘স্যার স্যার’ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। যদিও প্রটোকলের মধ্যে পড়ে না। তবুও কাজ উদ্ধার করা নিয়ে কথা। স্কুলের সবাইকে বড় মুখ করে বলে এসেছেন কাজটা এবার হয়ে যাবে। কাজ না হওয়ার তো কারণ নাই। আবেদনপত্রে এলাকার এমপি, একজন মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের সুপারিশ আছে। শুধু সুপারিশে আজকাল কাজ হয় না সেটা জানেন আজিজুল মাস্টার। সে জন্য স্কুলের ৭ জন শিক্ষক মিলে চাঁদা দিয়েছেন। কাজটা আদায় করতে হলে ঘাটে ঘাটে নানা ধরনের ঘুষ ও বকশিস দিতে হবে। তার জন্য বাজেট ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ জনপ্রতি চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ হাজার টাকা। স্কুলের দুইজন শিক্ষক তাদের ভাগের পুরো টাকাটা দিতে পারেননি। সে জন্য ঘাটে ঘাটে ঘুষ আর বকশিস দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন আজিজুল মাস্টার। এই যেমন ঢাকায় শিক্ষা অধিদফতরে হেড কেরানির সামনে বসে আছেন প্রায় এক ঘণ্টা। যথারীতি তার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়েছেন। খাম না খুলেই সে বুঝে নেয় খামের স্বাস্থ্য ততটা সুবিধার নয়। সে কারণে আজিজুল মাস্টারের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে না। হেড কেরানি এরই মধ্যে আজিজুল মাস্টারকে অভদ্র ভাষায় ধমকও দিয়েছে। আজিজুল মাস্টার মনে মনে কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু দমে যাননি। ঢাকায় আসার আগে স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা সবাই তাকে বাসে উঠিয়ে দিয়েছেন। একজন বয়স্ক শিক্ষক তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভাই এবার আমাদের কাজটা হবে তো? চাকরি করি অথচ নিয়মিত বেতন পাই না। স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের কাছে মুখ দেখাইতে পারি না। এবার বেতন পাবো তো?

সহকর্মীদেরকে আশ্বস্ত করেই ঢাকা এসেছেন আজিজুল মাস্টার। কিন্তু ঢাকায় এসে পড়েছেন মহা বিপদে। কেউইতো কথা শুনতে চায় না। ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হচ্ছে। হেড কেরানির কাছে আসার জন্য পিয়নকে বকশিস দিতে হয়েছে ১০০ টাকা। সে শুধু হেড কেরানির টেবিলটা দেখিয়ে দিয়েছে। এজন্যই নাকি তার বকশিস প্রাপ্য। লজ্জা শরম বলে তো একটা ব্যাপার আছে। পিয়ন এমনভাবে বকশিস চাচ্ছিলো যে আজিজুল মাস্টার লজ্জায় পড়ে যান। এই ছেলেকে কত টাকা বকশিস দিলে খুশি হবে? দশ নাকি বিশ টাকা? তাকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে দেন আজিজুল মাস্টার। সাথে সাথে বিরক্ত হয়ে তা ফিরিয়ে দেয় পিয়ন। যেন আজিজুল মাস্টার মারাত্মক কোনও অন্যায় করেছেন। তাই তার প্রতি মহা বিরক্ত হয়ে পিয়ন বলে– স্যার এইটা কী দিলেন? এক কেজি আলুও তো কেনা যাবে না...

আজিজুল মাস্টার বিব্রত হয়ে ২০ টাকা ফেরত নিয়ে পকেট থেকে ৫০ টাকার একটা নোট বের করে পিয়নকে দেন। পিয়ন এবার আরও বিরক্ত হয়। ৫০ টাকার নোটটা আজিজুল মাস্টারের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে মন খারাপ করে চলে যাওয়ার ভঙ্গি করে। আজিজুল মাস্টার তাকে ডাক দিয়ে পুরো ১০০ টাকার একটা নোট তার হাতে তুলে দেন। তাতেও খুশি হয় না পিয়ন। যেতে যেতে বলে, আইজ কাইল ১০০ টাকা কোনও টাকা নাকি স্যার... ঠিক আছে আপনি যখন দিচ্ছেন তখন নিলাম...

হেড কেরানির সামনেই ঘটনা ঘটলো। পিয়ন চলে যাওয়ার পর আজিজুল মাস্টার আবার হেড কেরানির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন– স্যার আমার ফাইলটা যদি...?

হেড কেরানি গুরুত্বহীন ভঙ্গিতে বলল– ফাইল তো ওপরে যাবে না।

কেন, কেন স্যার? ফাইলে কোনও সমস্যা আছে। এলাকার এমপি, মন্ত্রীসহ অনেকের সুপারিশ আছে। তাছাড়া যেখানে যা দেওয়ার তাতো দিয়েছি...

আজিজুল মাস্টারের কথা শুনে হঠাৎ যেন গোখরো সাপের মতো ফোঁস করে উঠলো হেড কেরানি– কী বললেন আপনি? যেখানে যা দেওয়ার দিয়েছেন মানে? আমরা কি এইখানে ঘাস কাটার জন্য বইস্যা আছি? কাজ কইর‌্যা দিমু আমরা আর আপনেরা অন্য জায়গায় প্যাকেট দেবেন তা তো হবে না। যান আপনার ফাইল ওপরে যাবে না... যান, যান বলতেছি... অনেকটা কুকুরকে যেমন মানুষ তাড়ায় তেমনি আজিজুল মাস্টারকে তাড়িয়ে দিলেন হেড কেরানি।

বিষন্ন মনে শিক্ষা অধিদফতরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। সাথে সাথে একজন অপরিচিত লোক তার কাছে এসে দাঁড়ালো। সহানুভূতি প্রকাশের ভঙ্গি করে জানতে চাইল– স্যার কী হয়েছে আমারে খুইল্যা বলেন তো... দেখি আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি কিনা...

লোকটিকে দেখে ‘বিশ্বাসী’ মানুষ বলে মনে হলো। তাকে স্কুলের ঘটনাটা খুলে বললেন আজিজুল মাস্টার। স্কুল ইনসপেক্টর একদিন তাদের স্কুলে সারপ্রাইজ ভিজিটে গিয়েছিলেন। তাকে সেই ভাবে আদর যত্ন করা সম্ভব হয় নাই। আদর-যত্ন মানে স্বাস্থ্যবান খাম তাকে দেওয়া যায় নাই। সে কারণে স্কুলের ব্যাপারে তিনি শিক্ষা অধিদফতরে নেতিবাচক প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকার বেতন ভাতার সরকারি অংশের ‘ছাড়’ বন্ধ হয়ে যায়। এই ‘জট’ খুলতেই ঢাকায় এসেছেন আজিজুল মাস্টার। লোকটি মনোযোগী শ্রোতার মতো আজিজুল মাস্টারের কথা শোনে। মাস্টারের শেষ হতে না হতেই অকৃত্রিম শুভাকাঙ্ক্ষীর ভূমিকায় অভিনয় শুরু করে।

কেসটা স্যার বেশ জটিল। ঘোড়া ডিঙাইয়া তো স্যার ঘাস খাইতে পারবেন না। হেড কেরানি কি আপনার কাছে কিছু আবদার করেছে?

হ্যাঁ।

কত? কত টাকা চাইছে?

অনেক টাকা...

তবুও বলেন না কত, দেখি আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি কিনা। তাকে খুশি না করতে পারলে কিন্তু আপনাদের ফাইলটা ওপরের টেবিলে যাবে না। এইটা কিন্তু সত্যি কথা... এইটাই বাস্তব? হেড কেরানি কত চাইছে? আজিজুল মাস্টার বিব্রত হয়ে বললেন, সে চাইছে ১০ হাজার। আমি তাকে পাঁচ হাজার দিয়েছি। খাম না খুলেই বলেছে খামের নাকি স্বাস্থ্য ভালো নয়। খাম না খুলেই সে কী করে বুঝলো খামের স্বাস্থ্য ভালো নয়? সে কি জাদু জানে?

আজিজুল মাস্টারের কথা শুনে লোকটি মৃদু হেসে বলল, এইটাই তো স্যার তার যোগ্যতা! আপনি এক কাজ করেন, খামের ভেতর আরও দুই হাজার টাকা ভরায়া দেন। দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা।

লোকটির কথায় পকেট থেকে দুই হাজার টাকা বের করে পূর্বের খামটির ভেতর ভরিয়ে লোকটির হাতে তুলে দিলেন আজিজুল মাস্টার। লোকটি খাম হাতে নিয়ে দ্রুত চলে গেল।

প্রায় দশ মিনিট পর লোকটি ফিরে এলো। মুখে বিজয়ীর হাসি। স্যার আপনার কাজ হয়ে গেছে। ফাইল ওপরে চইল্যা গ্যাছে...

আজিজুল মাস্টার খুশি হয়ে লোকটিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ভাই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমাদের অনেক উপকার করলেন।

লোকটি এবার মৃদু হেসে তার আসল চেহারা প্রকাশ করলো। আজিজুল মাস্টারকে সরাসরিই বলল– স্যার আমাকে কিছু দেবেন না?

আজিজুল মাস্টার অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকালেন– আপনাকে কিছু দেব মানে?

লোকটি কুাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, না, মানে আপনার এতবড় একটা কাজ করে দিলাম, কিছু দেবেন না? আপনারা কিছু না দিলে... আজিজুল মাস্টার বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে ৫০০ টাকা বের করে লোকটির হাতে দিতেই সে অবাক হয়ে বলল, এইটা কী দিলেন? ৫০০ টাকা কি কোনও টাকা স্যার?

আজিজুল মাস্টার বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন– কী বলেন আপনি ৫০০ টাকা কোনও টাকা নয়? আপনাকে কত দিতে হবে?

লোকটি এবার চামারের মতো ময়লা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল– আমি তো ৫ হাজারের নিচে কোনও কাজ করি না। আপনাকে আমার খুব পছন্দ হইছে। আপনার জন্য দুই হাজার মাইনাস। তিন হাজার দেন...

লোকটির কথায় যারপর নাই অবাক হলেন আজিজুল মাস্টার। একেই বোধকরি জল ঘোলা করে খাওয়া বলে। শুরুতে হেড কেরানিকে দশ হাজার দিলেই তো ল্যাঠা বুকে যেতো। একি সিস্টেমরে বাবা! এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনোই উপায় নাই?

প্রিয় পাঠক, এটি নিছক একটি গল্প। আমার এক বন্ধুর সাথে গল্পটি শেয়ার করেছিলাম। শুনে সে বলল, আমি নাকি গল্পের গভীরে যেতে ব্যর্থ হয়েছি। কারণ বাস্তব ক্ষেত্রে এই গল্প নাকি আরও করুণ ও হৃদয় বিদারক। বন্ধু সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট দুই কর্মকর্তার ঘুষ বাণিজ্যের প্রসঙ্গ তুলে বললেন, আমরা কথায় কথায় বলি- শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রই ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত। পত্র-পত্রিকায় খবর পড়ে তো তাই মনে হচ্ছে। একটি পত্রিকায় ‘শিক্ষার ঘুষের হাটের কারবারি’ শিরোনামে বিশেষ রিপোর্টে ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।‘মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তার সম্পদের পাহাড়, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হয়েও বাড়ি নির্মাণ করেছেন সাড়ে ৪ কোটি টাকায়। শিক্ষা মন্ত্রীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে...

কী অবিশ্বাস্য খবর-মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ৪ কোটি টাকায় বাড়ি নির্মাণ করছেন? তার বেতন কত? কিভাবে তিনি এত অর্থ সম্পদের মালিক হলেন? তার মানে ঘুষ বাণিজ্যই কি এখন শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য?

লেখক: সম্পাদক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ