X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রুত নাকি ন্যায়বিচার?

আমীন আল রশীদ
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৬:৩০আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৬:৩২

আমীন আল রশীদ ছবিটি আপনার চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়মত ভাইরাল হওয়া অজস্র ছবির ভিড়ে খুব ব্যতিক্রমী, খুব বেদনার এবং একইসঙ্গে লজ্জার এই ছবিটি একটি সংবাদ সম্মেলনের; যেখানে উপস্থিত একজন বাবা তার ধর্ষিত মেয়েকে নিয়ে। ধর্ষণের বিচার চাইতে এসেছেন। ঘটনা গত ১০ ফেব্রুয়ারির। ধর্ষিত শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে একজন বিচারপ্রার্থী অসহায় বাবার এমন সংবাদ সম্মেলনের দৃশ্য এর আগে বাংলাদেশ কবে দেখেছে?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ২৪ জানুয়ারি দুপুরে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া পৌরশহরের পূর্ব হারোয়া এলাকার মাহবুবুর রহমান বাইসাইকেল চালানো শেখানো এবং চকলেট দেওয়ার নাম করে বাড়িতে নিয়ে যায় শিশুটিকে। এরপর তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। শিশুটি বাড়ি ফিরে আসার পর অসুস্থ অবস্থায় তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। ওই দিন বিকেলেই শিশুটির পিতা বাদী হয়ে বড়াইগ্রাম থানায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। কিন্তু তার অভিযোগ, ২৫ জানুয়ারি দুপুর দেড়টায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডা. ডলি রানী শিশুটির মেডিক্যাল পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। অথচ মেডিক্যাল রিপোর্টে তারিখ দেখানো হয় ঘটনার দিন ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। চিকিৎসক একই রিপোর্টে একদিকে যেমন ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করেন, তেমনি শিশুটিকে খাবারের জন্য দেন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধ। যদিও পুলিশ বলছে, প্রাথমিক তদন্তে তারা ধর্ষণের আলামত পেয়েছেন। আসামিকে আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সেও ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রদানকারী ডাক্তার ডলি রানীর অপসারণ ও বিচার দাবিতে মানববন্ধনও করেন স্থানীয়রা।

নাটোরের এই বাবার সঙ্গে আমরা মিল খুঁজে পাই গাজীপুরের হযরত আলীর, যিনি মেয়ের শ্লীলতাহানির বিচার চাইতে গিয়েছিলেন। বিচার পাননি। তখন তার মনে হয়েছিল, যে সমাজ একটি মেয়ের শ্লীলতাহানির বিচার করতে পারে না, সেই সমাজে বেঁচে থেকে কী লাভ? হযরত আলী হতাশ হয়েছেন এবং ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েছেন মেয়েকে নিয়েই। মেয়ে আয়েশা আক্তারের (৮) ওপর নির্যাতন ও যৌন হয়রানির বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিলেন হযরত আলী ও তার স্ত্রী হালিমা বেগম। গত বছরের জানুয়ারিতে ফারুক হোসেন নামে স্থানীয় বখাটের লাম্পট্যের শিকার হয় শিশু আয়েশা। মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষায় স্থানীয় প্রভাবশালী থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসন সবার কাছেই গিয়েছিলেন হযরত আলী। কিন্তু পদে পদে অপদস্থ হতে হয়েছে তাকে। পেয়েছেন পাগল উপাধি। সবশেষ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের আয়োজনও চূড়ান্ত করা হয়। প্রকাশ্যে দা, লাঠিসোটা নিয়ে দরিদ্র হযরত আলী দম্পতির ওপর চড়াও হয় স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। অবশেষে ছোট্ট মেয়ে আয়েশা আক্তারের সম্ভ্রম রক্ষা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় হযরত আলী মেয়েকে বুকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে মুক্তির পথ খোঁজেন।

হযরত আলীর জীবনে যা ঘটেছে, এমনটা নাও হতে পারত। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা সালিশের মাধ্যমে ঘটনার বিচার করতে পারতেন। তারা ব্যর্থ হলে থানা পুলিশ-আদালত। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। দুর্বলের পাশে তারা দাঁড়ানোর প্রয়োজনবোধ করেননি। জনপ্রতিনিধিরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করলে যে সমাজে দুর্বলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, সমাজে ন্যায়বিচারের সংকট ঘনীভূত হয়, হযরত আলীর ঘটনাটি আমাদের সেই বাস্তবতাই মনে করিয়ে দেয়।

একইভাবে একজন চিকিৎসক, একজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন বিচারক যদি সত্যের পক্ষে না থাকেন, যদি তিনি প্রভাবশালীর ভয়ে কিংবা পয়সার কাছে নিজের বিবেক বিকিয়ে দিয়ে ভুল মেডিক্যাল রিপোর্ট দিয়ে ধর্ষককে বাঁচানোর চেষ্টা করেন,অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাকে খুঁজে পায় না––তখন বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।

তবে কিছু সংবাদ মানুষকে আশাবাদীও করে। যেমন নাটোরের এই ঘটনার কিছুদিন পরেই ১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রুপাকে গণধর্ষণ ও হত্যা মামলায় চারজনের ফাঁসির আদেশ দেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে অপর এক আসামিকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন ময়মনসিংহ-বগুড়া সড়কে চলাচলকারী ছোঁয়া পরিবহনের বাসচালক হাবিব মিয়া (৪৫), বাসের তিন হেলপার শামীম মিয়া (২৬),আকরাম (৩৫) ও জাহাঙ্গীর আলম (১৯)। গত বছরের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রুপাকে চলন্ত বাসে পরিবহন শ্রমিকরা ধর্ষণ করে এবং বাসেই তাকে হত্যার পর টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে মৃতদেহ ফেলে যায়।

২.

সম্প্রতি আরেকটি বিষয় নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। তা হলো দ্রুত বিচার আইনে সাজার মেয়াদ বাড়ানো। ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে করা ওই আইনটি দুই বছরের জন্য করা হলেও পরবর্তীতে সব সরকারই আইনটির মেয়াদ বাড়িয়েছে। সবশেষ এর সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ ৫ থেকে ৭ বছর করা হয়। সেই সাথে এই আদালতে বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত একজন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়। গত ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এ সম্পর্কিত বিলটি পাস হয়। অন্যান্য বিলে সাধারণত সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সংশোধনীর প্রস্তাব দিলেও এ বিলের ওপর দলটির কোনও সংসদ সদস্য সংশোধনী দেননি। আবার জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর জন্য একজন স্বতন্ত্র ও ৬ জন বিরোধীদলীয় সদস্য নোটিশ দিলেও এদের মধ্যে পাঁচজনই সংসদে উপস্থিত ছিলেন না। বাকি দুজনের প্রস্তাব মন্ত্রী গ্রহণ না করলে তা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়।

এই আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ করলে দ্রুত বিচার আইনে তার বিচার হবে। যেমন ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বা বেআইনি বল প্রয়োগ করে কোনও ব্যক্তি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা, সাহায্য বা অন্য কোনও নামে অর্থ বা মালামাল দাবি বা আদায় বা আদায়ের চেষ্টা করলে তা এ আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া স্থল, রেল, জল বা আকাশপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, ইচ্ছের বিরুদ্ধে যানের গতি ভিন্নপথে পরিবর্তন করা, ইচ্ছাকৃত কোনও যানবাহনের ক্ষতি করা; ইচ্ছাকৃতভাবে সরকার, ব্যক্তি বা কোনও প্রতিষ্ঠানের স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ভাঙচুর করাসহ ৯ ধরনের অপরাধের জন্য এই আইনের অধীনে সাজা দেওয়া যাবে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, শুরু থেকেই দেখা গেছে এই আইন ব্যবহার করা হয় মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে। ২০০২ সালে যখন আইনটি করা হয় তখন তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল এবং তারা এই আইনকে ‘আওয়ামী লীগ দমন আইন’ বলে অভিহিত করেছিল। অথচ এবার তারাই এই আইনে সাজার মেয়াদ বাড়ালো। নির্বাচনের বছরে গিয়ে এরকম একটি আইনে সাজার মেয়াদ বাড়ানোর রাজনৈতিক সমীকরণ অস্বীকারের উপায় নেই। ভবিষ্যতে অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলে তারাও এই আইনকে তাদের প্রতিপক্ষ দমনের কাজেই ব্যবহার করবে। পরিসংখ্যান বের করলে দেখা যাবে, গত ১৬ বছরে এই আইনের আওতায় যত বিচার হয়েছে তার সিংহভাগই রাজনৈতিক মামলা।

বলা হয়, বিচার বিলম্বিত হলে অবিচারের ঝুঁকি বাড়ে। সেক্ষেত্রে যেকোনও ঘটনার দ্রুত বিচার হলে সেখানে ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা বাড়ে। ফলে আইনের নাম যখন হয় দ্রুত বিচার আইন, তাতে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু যদি এর উদ্দেশ্য থাকে প্রতিপক্ষ দমনের জন্য তাদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, সেটি আখেরে ন্যায়বিচারকেই পরাস্ত করে। ফলে দ্রুত বিচার নয়, বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। হযরত আলীরা যাদের কারণে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন, যাদের কারণে ধর্ষিত মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সংবাদ সম্মেলনে একজন অসহায় বাবাকে কাঁদতে হয়, সেই ঘটনাগুলোর পুনঃপৌনিকতা রোধে একদিকে যেমন দ্রুত বিচার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। না হলে প্রবৃদ্ধির চাকা দ্রুত ঘুরতে থাকবে এবং সেই চাকার নিচে পিষ্ট হবে আমাদের বোধ, মানবিকতা, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ