X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্টিফেন হকিং, আপনি বড় ভুল সময়ে জন্মেছিলেন!

চিররঞ্জন সরকার
১৮ মার্চ ২০১৮, ১৩:৪৮আপডেট : ১৮ মার্চ ২০১৮, ১৩:৫০

চিররঞ্জন সরকার তার নাম বলতেই চোখে ভেসে ওঠে হুইলচেয়ারে বন্দি,ঘাড়টা ডান দিকে একটু কাত করে থাকা মানুষটির কথা। যার চশমার মোটা কাচের আড়াল থেকে উঁকি দিতো দীপ্তিমান দুটি চোখ। যে চোখ একসময় খোঁজ দিয়েছিল মহাকাশের এক অদ্ভুত আঁধার কৃষ্ণগহ্বরের অনেক রহস্যের। মৃত্যুর আগেও তার এই দীপ্তিমান চোখ দুটি খুঁজে বেড়িয়েছে বিজ্ঞানের নানা কত রহস্য!
১৯৬৩ সালে চিকিৎসকেরা জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন—দু’বছরের বেশি আর বাঁচবেন না তিনি। তার বয়স তখন মাত্র ২২। চিকিৎসকদের ধারণা সত্যি হলে,মহাবিশ্বের রহস্যসন্ধানী তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, দার্শনিক স্টিফেন হকিংকে পেতই না বিশ্ব। কিন্তু মারাত্মক স্নায়ুর অসুখ মোটর নিউরনকে সঙ্গে নিয়েই ৭৬ বছর লড়ে গেলেন তিনি। শুধু লড়াই নয়,কাজ করে গেলেন আমৃত্যু। অবশেষে শেষ হলো সেই মহাজীবনের। গত বুধবার ভোররাতে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন স্টিফেন হকিং।
সামান্য বাধাবিপত্তি-অসুখবিসুখেই বেঁচে থাকার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন যারা,তাদের সাক্ষী রেখেই যেন ৭৬ বছর বেঁচে ছিলেন হকিং। প্রতি মুহূর্তে যারা মৃত্যুভয়ে কাতর,তাদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন এই ছোটখাটো গড়নের মানুষটি। ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্ম প্রবাদপ্রতিম এই বিজ্ঞানীর। ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’-এর লেখকের আপেক্ষিকতাবাদ, কসমোলজি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং ব্ল্যাকহোলের ওপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি মানুষের বাঁচা বেসিক্যালি পজিটিভ, মানুষ যে হাজার কষ্টের পরও বেঁচে আছে,এটাই পজিটিভ। তাকে আলাদা করে পজিটিভ করে তোলার কোনও মানে নেই।’ স্টিফেন হকিংয়ের বেঁচে থাকাকে আলাদা করে পজিটিভ করে তোলার কোনও মানে নেই। তারপরও বলতে হয়, তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই ‘মহাবিশ্বের বিস্ময়’! প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেও যে বিশ্বখ্যাত হওয়া যায়,তার এত বড় প্রেরণাপুরুষ বোধহয় আর দেখা পাবে না পৃথিবী। স্টিফেন হকিংয়ের জীবনের সেই চমকপ্রদ দিকের দিকে তাকালে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়!

একেবারেই মাঝারি মানের ছাত্র ছিলেন হকিং। বহুদিন ঠিকঠাক পড়তে পর্যন্ত পারতেন না। ক্লাসে যা নম্বর পেতেন তাতে পেছনের সারির ছাত্রের তকমাই জুটেছিল ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীর। ক্লাসে পড়াশোনার যখন এরকম হাল,তখনই হকিংয়ের চমক। মোটে ১৭ বছর বয়স, তখনই অক্সফোর্ডে পদার্থবিদ্যা পড়ার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেন। শুধু তাই নয়,পান স্কলারশিপও।

ছোটবেলা থেকেই বিশ্বের সৃষ্টিরহস্য তাকে বুঁদ করে রাখত। পড়াশোনায় যেমনই হোন না কেন,তাকে আইনস্টাইন বলেই ডাকতেন অনেকে। ঘটনাচক্রে আইনস্টাইনের জন্মদিনেই পরলোকে পাড়ি দিলেন হকিং। গ্যালিলিওর মৃত্যুদিনে তার জন্ম। আর আইনস্টাইনের জন্মদিনে তার মৃত্যু। এ যেন আশ্চর্য সমাপতন।

২০০৭ সালে জিরো গ্রাভিটি ফ্লাইটে শামিল হয়েছিলেন হকিং। তার বিশ্বাস ছিল,এ পৃথিবী একদিন মানুষের বসবাসের উপযোগী থাকবে না। তাই জিরো গ্রাভিটিতে বসবাসের জন্য মানুষকে তৈরি হতে হবে। অন্য কোনও দুনিয়াও যাতে মানুষের অধীনে আসে, সে কারণেই ছিল তার এই প্রয়াস। যে স্পিচ সিন্থেসাইজারের মাধ্যমে হকিংয়ের আওয়াজ শোনা যেত, তা আসলে ছিল আমেরিকান উচ্চারণ। এদিকে হকিং জন্মসূত্রে ব্রিটিশ। তাও পরিবর্তনের ভাবনাকে আমল দেননি বিজ্ঞানী। তার মতে,এই স্পিচ সিন্থেসাইজারটিও ছিল তার পরিচয়ের একটি অংশ।

কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোনও কিছু বেরিয়ে যেতে পারে না। এমনকি কোনও তথ্যও নয়। বাজি ধরেছিলেন হকিং। দীর্ঘদিন তার দাবি অক্ষত ছিল। শেষমেশ অবশ্য বাজি হারতে হয়েছিল হকিংকেও।

ব্ল্যাকহোল নিয়ে গবেষণার জন্যই তার খ্যাতি। আবার এর জন্যই নোবেলের জন্য কখনও মনোনীত হননি তিনি। হয়তো নোবেল কমিটি তার কৃতিত্বকে বুঝতেই পারেনি। ২০১৪-তে তার জীবন অবলম্বন করেই হয় ছবি- ‘দ্য থিওরি অফ এভরিথিং’। পাঁচটি বিভাগে অস্কারে নমিনেশন পেয়েছিল ছবিটি।

টেলিভিশনেও দেখা যেত এই বিজ্ঞানীকে। ‘দ্য সিম্পসনস’ নামে একটি কার্টুন শো-তে তার অ্যানিমেটেড ভার্সনেরও দেখা মিলেছিল। সেখানে ব্যবহৃত কণ্ঠস্বর ছিল হকিংয়ের স্পিচ সিন্থেসাইজারের স্বর।

লেখার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন হকিং। কিন্তু এমন একটি ভিজুয়াল পদ্ধতি তিনি তৈরি করেছিলেন, যার ফলে জ্যামিতির মাধ্যমেই সমাধান করতেন জটিল অঙ্ক। কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল নিয়ে মানুষের চিন্তা,গবেষণা বহু দিনের। বিজ্ঞানীদের দেওয়া ব্যাখ্যা এবং জটিল গাণিতিক সমীকরণ সাধারণ মানুষের বিচারবুদ্ধির অনেক বাইরে। মহাবিশ্ব কী? তার উৎপত্তিইবা হলো কীভাবে? এই প্রশ্ন মনে এলেও সেটা বোঝার ক্ষমতা বিজ্ঞানীরা ছাড়া আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের নেই। জটিল বিজ্ঞান আর সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই যোগসূত্রটাই রচনা করেছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী।

সালটা ১৯৮৪। ব্ল্যাকহোল নিয়ে হকিংয়ের তত্ত্ব তখন বিজ্ঞানী মহলে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। প্রথম জনসাধারণের জন্য দরজা খুলে দিলেন হকিং। মহাবিশ্বের তত্ত্ব নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করলেন, যার নাম ‘শর্ট হিস্ট্রি অব টাইম’। সেই প্রথম মানুষ জানল আপেক্ষিকতাবাদ কী,ব্ল্যাকহোল নিয়ে গবেষকদের চিন্তাভাবনার গতি কোনদিকে। শত শত লোক যোগ দিলেন এই আলোচনা সভায়। এই বক্তৃতার বিপুল জনপ্রিয়তার পরেই, বিজ্ঞানীদের অনুরোধে ১৯৮৮ সালে কসমোলজি নিয়ে ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ লিখলেন হকিং। বিগ ব্যাং থিওরি থেকে ব্ল্যাকহোল— মহাবিশ্বের নানা তত্ত্ব নিয়ে এই বই সাদরে গ্রহণ করল বিজ্ঞানীমহল।

স্টিফেন হকিং এমন একজন মানুষ, যিনি প্রথম দেখালেন কীভাবে সহজ করে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করা যায়। জনসাধারণের ওপর তার প্রভাব ছিল সাংঘাতিক। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে একটুও কাবু করতে পারেনি। জটিল স্নায়ুর রোগ তার শরীরকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেয়। একসময় গলার আওয়াজও চলে যায় তার। অথচ সীমাহীন দক্ষতায় কৃত্রিম ভোকাল বক্সের মাধ্যমে বক্তৃতা দিতেন তিনি। একটা একটা করে অক্ষর টাইপ করে আলোচনা সভায় সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। মুখে কখনও বিরক্তির লেশমাত্র দেখা যায়নি। মেধার সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের এক আশ্চর্য মিশেল ছিলেন হকিং।

বাস্তববাদী ছিলেন হকিং। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে তিনি মানতে চাননি। গ্যালিলিও এবং আইনস্টাইনের মধ্যে সেতু রচনা করেছিলেন হকিং। গ্যালিলিও তুলে ধরেছিলেন মহাবিশ্বের তত্ত্ব। আইনস্টাইন অঙ্ক কষে দেখিয়েছিলেন তার বাস্তব প্রয়োগ। আর হকিং,এই দুজনকেই সঙ্গে নিয়ে সহজভাবে দেখিয়েছিলেন পদার্থবিদ্যাকে সঙ্গী করে কীভাবে মহাবিশ্বকে জানা যায়। ছোট গবেষণাগারে বিজ্ঞানচর্চা করেও, সুদূর গ্যালাক্সির গোপন রহস্যের সমাধান কীভাবে করা যায়, তারই হদিস দিয়েছিলেন এই মহাবিজ্ঞানী।

অনেক জটিল তত্ত্বের সহজ ব্যাখ্যা দিতে পারলেও একটি ক্ষেত্রে হার মেনেছেন হকিং। নারী-মনের রহস্য অধরাই থেকে গেছে তার কাছে। তিনি নিজে অন্তত এমনটাই বলেছেন কয়েক বছর আগে এক সাংবাদ সম্মেলনে। অবশ্য নারীবিবর্জিত নয় তার জীবন। বিয়ে করেছেন দু’বার। আছে তিন সন্তান ও তিনটি নাতি-নাতনি। মেয়ের সঙ্গে ছোটদের জন্য মহাকাশবিদ্যা নিয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন তিনি।

হকিং ছিলেন একজন মুক্তমনের মানুষ। তিনি বলেছেন, ‘দর্শন এ যুগে মৃত। কারণ, দার্শনিকেরা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেননি।’

সারা জীবন ‍যিনি যুক্তি, বুদ্ধি,কার্যকারণ ও বিজ্ঞান নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন,সেই হকিং-ই মৃত্যুর পর যুক্তিবুদ্ধিহীনদের হীন অপপ্রচারের শিকার হচ্ছেন। অনেকে তাকে ‘নাস্তিক’ আখ্যায়িত করে তার মৃত্যুকে ‘কৃষ্ণগহবরে নিক্ষিপ্ত’ হওয়া হিসেবে দেখছেন! অনেকে আবার তার এতদিন ‘বেঁচে থাকা’ নিয়েই সংশয় প্রকাশ করছেন! হকিং নাকি ১৯৬৫ সালেই মারা গেছেন! এতদিন তার নামে একটি ‘রোবট’ বসিয়ে রাখা হয়েছিল!

যে দেশের মানুষ একটি বিমান দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ‘নারী বৈমানিক’কে দায়ী করে, যারা দেশের সবচেয়ে যুক্তিবাদী মানুষগুলোকে চাপাতি-ছুরি চালিয়ে হত্যা করতে চায়, যারা চাঁদে সাইদীর ছবি দেখতে পায়, সে দেশে স্টিফেন হকিং ‘ভিলেন’ হবেন আর নায়ক হবে ফয়জুররা—এ আর বিচিত্র কী!

পরিশেষে, স্টিফেন হকিংয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলছি, স্যার, আপনি আসলে বড় ভুল সময়ে জন্ম নিয়েছিলেন! আমরা এখনও মানুষ হতে পারিনি, মানুষকে চিনতে, মূল্যায়ন করতে শিখিনি। আমরা এখনও ধর্মের ষাঁড়ই রয়ে গেছি। যদি পারেন, তাহলে আপনি আমাদের ক্ষমা করে দেবেন! দেখছেন না, যে যুবক জাফর ইকবাল স্যারকে কুপিয়ে মারতে চেয়েছিল, সেই যুবককেও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন!

ক্ষমা চাওয়া,আর ক্ষমা করে দেওয়াই আপাতত আমাদের একমাত্র ‘স্পর্ধা’!

লেখক: কলামিস্ট

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
চ্যাম্পিয়নস লিগআর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
টাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগটাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কোন পদে লড়ছেন কে
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কোন পদে লড়ছেন কে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ