X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতা দিবসের বিক্ষিপ্ত ভাবনা

বিভুরঞ্জন সরকার
২৬ মার্চ ২০১৮, ১৪:০০আপডেট : ২৬ মার্চ ২০১৮, ১৪:০৭

বিভুরঞ্জন সরকার

আজ ২৬ মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৭ বছর পূর্ণ হলো। প্রায় চার যুগ। একেবারে কম সময় নয়। আজ  স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানমালা হচ্ছে দেশব্যাপী। সকালে রমনা পার্কে হাঁটতে গিয়েও দেখলাম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পার্ক জুড়েই নানা আয়োজন। রমনা পার্কে সুন্দর সুন্দর নামের অনেকগুলো সংগঠন আছে। প্রায় সব সংগঠনই তাদের মতো করে স্বাধীনতা দিবস পালন করছে। এই অনুষ্ঠানগুলো সরকারি উদ্যোগে বা পৃষ্ঠপোষকতায় হয় না বলে এগুলোতে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে। যেসব আলোচনা হয় তাতেও প্রকাশ পায় মানুষের প্রকৃত মনের কথা।
একটি অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ একজনের আলোচনা শুনলাম। তিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই একাত্তরের যুদ্ধদিনের কথা বললেন। শ্রদ্ধা জানালেন শহীদদের প্রতি। তারপর দেশের বর্তমান অবস্থা বলতে গিয়ে কিছুটা হতাশার সুরে বললেন, এখন দেশে যা চলছে, যেভাবে সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে, দুর্নীতি বাড়ছে, গণতন্ত্র যে সংকটমুক্ত হতে পারছে না–এসব দেখে নিজেকেই প্রশ্ন করি এমন দেশই কি আমরা একাত্তরে হাতিয়ার তুলে নেওয়ার সময় চেয়েছিলাম? ভদ্রলোক আরও অনেক কথা বললেন, সেসব এখানে উল্লেখের প্রয়োজন নেই।
আমার মনের মধ্যে গত রাত থেকেই কিছু বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাধীনতা যে কোনও জাতির জন্য গৌরবের, অহঙ্কারের।কিন্তু,স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৪৭ বছর পর দেখা যাচ্ছে আমাদের কারও কারও মধ্যে স্বাধীনতা নিয়ে উচ্ছ্বাস নেই, কারও মধ্যে বা কিছুটা বিরূপতাও। আমি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে অনেককে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছি। দু’একজন দেখলাম এতে বিব্রত হয়েছেন। একজন তো লিখেছেন, তিনি এই দিবস উদযাপনের কোনও অর্থ খুঁজে পান না।
একজন লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা খুঁজে পাই না। বাংলাদেশ এখন মৌলবাদী এবং নিরঙ্কুশ মুসলিমদের দেশে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আঁতাত করে দেশকে এতোটাই পিছিয়ে নিয়েছে যে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলেও নাকি এতোটা পশ্চাৎধাবন হতো না।
আমি এ ধরনের ঢালাও মন্তব্য পছ্ন্দ করি না। আমাদের দেশের বাম রাজনীতি চর্চাকারীদের একটি প্রবণতা হলো, যাকে দেখতে নারি তার বিরুদ্ধে একটি তাত্ত্বিক যুক্তি দাঁড় করিয়ে তার ভুল বা সীমাবদ্ধতাগুলো বড় করে তুলে ধরে সাফল্যগুলো আড়াল করা বা ধর্তব্যের মধ্যে না নেওয়া। আমি নিজে এই ধারা থেকে এসেছি বলে জানি—তত্ত্ব দিয়ে, যুক্তি দিয়ে এরা সব সময় নিজেদের অবস্থানকে অভ্রান্ত প্রমাণে সক্ষম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, তাদের অবস্থান ছিল ভুল। জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা তার সবই ভুল নয়। আবার জীবন শুধু নির্ভুলও হতে পারে না।
স্বাধীনতার ৪৭ বছরে বাংলাদেশের অনেক সাফল্য আছে। অগ্রগতি আছে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে দুর্যোগ-দুর্বিপাকের দেশ হিসেবে পরিচিত নয়। বাংলাদেশ এখন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বমোড়লদের কাছে ছোটাছুটি করে না। সামাজিক ও মানব উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশ এখন অনেক সমৃদ্ধ দেশকেও টেক্কা দেওয়ার সক্ষমতা দেখাতে পারছে। নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ অনেকেই বাংলাদেশের অগ্রগতির, সাফল্যের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশ এখন আর না-খাওয়া মানুষের দেশ নয়। দুর্বল অর্থনীতির দেশও নয়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো মেগাপ্রজেক্ট বাস্তবায়নের সামর্থ্য বাংলাদেশ অর্জন করেছে। মানুষের গড় আয় বেড়েছে। আয়ু বেড়েছে। শিক্ষিতের হার বেড়েছে। এবার স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে। এসব অর্জনকে যারা দেখতে চান না, তারা একদেশদর্শী। তাদের সঙ্গে বিতর্ক করা অর্থহীন।
তবে এটাও ঠিক যে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। আরও অনেক সমস্যারই সমাধান করতে হবে। আমাদের দেশে এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষ আছেন। এখনও অনেক মানুষ আছেন যারা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বঞ্চিত। উচ্চশিক্ষা, কারগরি শিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। শিক্ষার মান নিয়ে আছে প্রশ্ন ও সমালোচনা।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সুশাসনের ক্ষেত্রে। আমরা কেন যেন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, গোষ্ঠী ও দলপ্রীতির বাইরে যেতে পারি না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, যারা ক্ষমতার রাজনীতি করে, তারা ক্ষমতার বাইরে থাকতে যেসব কথা বলে ক্ষমতায় গিয়ে তার উল্টোটা চর্চা করে। এটা বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেলায় যেমন সত্য, তেমনি অতীতে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির বেলায়ও সত্য। এক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রশ্ন হলো, এই পরিবর্তনটা আনবে কে? যারা খারাপটা চর্চা করছে, তারা ভালোটা আনবে মনে করে বসে থাকলে হবে না। এখন আওয়ামী লীগের শাসন অনেকের ভালো লাগছে না। ঠিক আছে, আওয়ামী লীগকে ভোটে পরাজিত করে তারচেয়ে ভালো একটি দলকে ক্ষমতায় আনার সুযোগ কি আমাদের দেশে আছে? আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি হতে পারে না। বিএনপি কেমন পারে সে প্রমাণ অতীতে তারা দিয়েছে। আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় জনকল্যাণের ব্রত নিয়ে একটি রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় জরুরি, বলা যায় এটা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সমাজের কোনও দিক থেকেই তেমন কোনও আয়োজন বা উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
এটা ঠিক, দেশের ঐতিহ্যবাহী পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা দেশে-বিদেশে প্রশংসিত এবং আস্থাভাজন। তিনি বিশ্বনেতার মর্যাদায় অভিষিক্ত। দেশ পরিচালনায় তিনি যে সাহস, বুদ্ধিমত্তা, সততা এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছেন তা সব মহলেই স্বীকৃত। তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গণহত্যায় প্রত্যক্ষ সহযোগী ও অংশগ্রহণকারী রাজাকার-আলবদরদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে যে সাহস এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রতি নিষ্ঠা দেখিয়েছেন, তার কোনও তুলনা নেই।
অনেকের মনেই তাই প্রশ্ন, যে নেত্রী দেশি-বিদেশি বাধা-ষড়যন্ত্র পায়ে দলে অসাধ্য সাধন করে এগিয়ে যাচ্ছেন, দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন, তিনি কেন জনগণের আরও বেশি আস্থা অর্জনের জন্য দলীয় দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছেন না? তিনি কেন সরকারের সাফল্যকে ম্লান করতে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে, ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করছে বা অন্যভাবে অর্থ-সম্পদ লোপাট করছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিচ্ছেন না?
আমাদের দেশের মানুষের সহজাত প্রবণতা হলো, সরকারের বিরুদ্ধে থাকা। আমাদের দেশে রাজনীতি মানেই বিরোধিতা ‘মানি না, মানবো না।’ এখানে ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারা বলবান করতে হলে সরকারকে ত্রুটিমুক্ত থাকতে হবে। সরকারের ইমেজ ক্লিন না হলে বিরোধিতার রাজনীতি দুর্বল হবে না। বাংলাদেশে ক্লিন ইমেজের সরকার গঠনে একমাত্র শেখ হাসিনাই পারেন যোগ্য নেতৃত্ব দিতে। কারণ, একমাত্র তাকেই কেনা যায় না এবং তারই ‘কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই'। তিনি রাজনীতি করেন, দেশের মানুষকে কিছু দেওয়ার জন্য।
আমার আর এক বন্ধু স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছেন: স্বাধীনতার মূল চেতনায় উজ্জীবিত হতে চাই। একটি ধর্মনিরপেক্ষ, ন্যায়ানুগ, সাম্যময় মুক্তদেশ চাই।
আমার এই বন্ধুর চাওয়ার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই। একাত্তরে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এক পাকিস্তান ভেঙে দুই পাকিস্তান বানানোর জন্য নয়। আজ  বাংলাদেশে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন তার মোকাবিলায় কেবল আওয়ামী লীগের কাছে চাওয়ার তালিকা না বাড়িয়ে আমরা আমাদের যার যার অবস্থানে থেকে কি কোনও ভূমিকা পালন করতে পারি না? হেফাজত যদি পশ্চাৎপদ ধারায় জনমত গঠন করতে পারে তাহলে আমরা কেন আধুনিক অগ্রসর ধারায় মানুষকে বোঝাতে পারি না?

/টিএন/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ