X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির মহাসচিব হিসেবে কে ভালো?

স্বদেশ রায়
০৩ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:৩১আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:৩৮

স্বদেশ রায় খালেদা জিয়া দুই মাসের বেশি হলো কারাগারে। অন্য কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা না ঘটলে বেগম জিয়াকে কমপক্ষে পাঁচ বছর কারাগারে থাকতেই হবে। হয়তো সেটা আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। বেগম খালেদা জিয়ার এই দুঃসময়ে তাঁর দল কোনও আন্দোলন, প্রতিবাদ এমনকি বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছেও যেতে পারেনি। তাদেরকে কোনও এক কর্নার থেকে অহিংস আন্দোলনের ট্যাবলেট খাইয়ে দেওয়া হয়েছে– তারা সেটা নিয়েই আছে; আর অহিংস আন্দোলনের নামে তারা ‘গৃহপালিত’ দলের মতো আন্দোলন করছে। অহিংস আন্দোলনে সহিংস আন্দোলনের থেকে আরও বেশি জনসম্পৃক্ততা ঘটাতে হয়। অহিংস আন্দোলন একটি দল বা একজন নেতা তখনই করতে পারেন যখন তার ডাকে রাজপথে জনতার ঢল নামে এবং সে ঢল নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলে বা চালানোর মতো ক্ষমতা আন্দোলনের নেতাদের থাকে। গান্ধী প্রথম সফলভাবে যা এ উপমহাদেশে করেন। আর সর্বোচ্চ সফলভাবে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এছাড়া সাম্প্রতিককালের  দুটো অহিংস আন্দোলনের উদাহরণ হলো- এক: বাংলাদেশে গণজাগরণ মঞ্চ। দুই: ভারতে আন্না হাজারের আন্দোলন।
যা হোক, বেগম জিয়া যে সময়ে তার রাজনৈতিক জীবনে সব থেকে বড় দুর্বিপাকে পড়েছেন এবং খুব শীঘ্রই তার এর থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, অন্যদিকে তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার কোনও পথ নেই–এ সময়ে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেন বিএনপির মহাসচিব। তার ওপরেই নির্ভর করছে এই দুর্বিপাকের সময় বিএনপি কোন পথে, কীভাবে এগোবে- না এখন যেমনটি ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের মতো আন্দোলন করছে এমনিভাবে দায়সারা গোছের আন্দোলন করতে থাকবে। দৃশ্যত বিএনপি মহাসচিবই এখন বিএনপির জন্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাস্তবতা তা নয়। বাস্তবতা হলো কে বিএনপির মহাসচিব থাকলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী দল চলবে। আন্দোলন চলবে।

বেগম খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার আগে বিএনপিকে মূলত একটি কন্ট্রাডিকশনের মধ্যে ফেলে দিয়ে গেছেন। তিনি বিএনপির নেতৃত্ব সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সিনিয়রদের দিয়ে, অন্যদিকে মূল নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন তারেক রহমানের ওপর। এই দুই একসঙ্গে চলা বেশ দুরূহ। বিএনপির সিনিয়রদের সকলেরই এখন অনেক বয়স হয়েছে। তাদের শরীরে এখন জেল জুলুম এমনকি রাজপথের ঝুঁকি নেওয়াও কষ্টের। যে কারণে তারা সব সময়ই চাইবেন তাদের রাজনীতি, তাদের আন্দোলন এমনভাবে এগিয়ে যাক, যাতে নেতৃত্ব তাদের হাতে থাকে আবার তাদের শরীরও সে ধকল সহ্য করতে পারে। এভাবে এগুতে হলে তাদেরকে অবশ্যই সরকারের সঙ্গে একটা যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হবে। রাজনীতিতে এটা খুব দোষের কিছু নয়। এ ধরনের একটা যোগাযোগ সরকারের সঙ্গে সব বিরোধী দলের থাকে– একে ঠিক আঁতাত বা আপস বলা যেতে পারে না। তবে হ্যাঁ, এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দলের থেকে সরকার সুবিধাটা বেশি ভোগ করে। তবে বিরোধী দল যদি যোগ্য হয়, তাদের নেতৃত্ব যদি যোগ্য হয় তাহলে সময়মত তারাও স্রোতটি তাদের অনুকূলে টেনে নিতে পারে।

বিএনপিতে এখন এই সিনিয়রদের মহাসচিব হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেমন বিএনপির সিনিয়রদের পছন্দের, তেমনি সরকারও চায় তাদের একটি প্রতিপক্ষের প্রতিনিধি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো লোকই থাকুক- তাহলে তাদের কথা বলতে সুবিধা হবে। তাছাড়া মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যদি সরকারের সঙ্গে কথা নাও বলেন তাহলে তিনি অন্তত বিএনপির সিনিয়রদের মতো অনুযায়ী চলবেন বা তাদের সঙ্গে মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন। বাস্তবে বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণে আব্দুল আওয়াল মিন্টু,মওদুদ আহমদ, খোন্দকার মোশাররফ ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরদের মতো লোকেরা থাকলে সরকার একটু বেশিই নিশ্চিন্তে থাকে। তারা ধরে নিতে পারে এরা নেতৃত্বে থাকলে আর যাই হোক দলটি কোনও বড় ধরনের জ্বালাও পোড়াওতে যাবে না। কেউ কেউ বলতে পারেন বিএনপির এখন সে সক্ষমতা নেই। তবে এ ধরনের কাজে যেতে না পারুক, যাওয়ার চেষ্টা তো করতে পারে। আর তাতেও সরকার খানিকটা ঝামেলায় পড়ে।

তবে এখানে সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে বিএনপির তরুণ কর্মীদের। ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল মিলে বিএনপির একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তরুণকর্মী আছে। তারা বিএনপির এই সিনিয়র নেতাদের গরুর গাড়ির গতি মেনে নিতে পারছে না। তারা মুখে না বললেও তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলে, বেগম জিয়ার জন্যে বিএনপি যে আন্দোলনটি করবে তার গতি সুপারসনিক না হোক অন্তত রেলগাড়ির গতি হোক। অন্যদিকে লন্ডনস্থ বিএনপির আন্দোলনের গতি ও সে সব আন্দোলনে তারেক রহমানের দেওয়া ভাষণ প্রমাণ করে তারেক রহমানও বিএনপির এই গরুর গাড়ির গতির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারছেন না। আবার এখানে আরও একটি বিষয় আছে,বিএনপির ওই যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণকর্মী, বিএনপির তরুণ থিঙ্কট্যাঙ্ক জি- নাইন, এরা সকলেই তারেক রহমানের অনুসারী। তারা তারেক রহমানের নির্দেশেই সবকিছু করতে চায়। অথচ তাদের সামনে তারেক রহমানের কোনও প্রতিনিধি নেই। তাদেরকে কাজ করতে হচ্ছে সিনিয়র নেতাদের মত অনুযায়ী। যে কারণে তাদের এক একজন কর্মী যে আবেগ বা গতি নিয়ে একটি কর্মসূচিতে যাচ্ছে– ঠিক ওই পরিমাপেই তারা হতাশ হয়ে ফিরে আসছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ ছয় মাসের মধ্যে বিএনপির তরুণকর্মীরা হতাশাগ্রস্ত তরুণে পরিণত হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, মির্জা ফখরুল কি তারেক রহমানের শতভাগ নির্দেশ মানতে পারবেন বা সে অনুযায়ী কাজ করতে পারবেন? দুই কারণে মির্জা ফখরুলের পক্ষে তারেক রহমানের শতভাগ নির্দেশ মানা সম্ভব নয়। এক, তারেক রহমান দীর্ঘদিন দেশের বাইরে, তাছাড়া তার সঙ্গে যারা দেখা করেন তাদের অধিকাংশই তাকে সঠিক তথ্য দেন না বরং তাকে খুশি করার চেষ্টা করেন। এর ফলে তারেক রহমান যে নির্দেশ দেয় তার শতভাগ বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে এক নয়, মির্জা ফখরুলের পক্ষেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এছাড়া নিজের বয়স ও অন্য সিনিয়র নেতাদের কথা ও তাদের নেতৃত্ব ধরে রাখার বিষয়টি মির্জা ফখরুলকে ভাবতে হয়। অন্যদিকে মির্জা ফখরুলের এই পথে এগুনোর ফলে বিএনপির তরুণকর্মীরা তার সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারছে না। তাদের এই অসন্তোষ তারেক রহমানের কানেও যাচ্ছে– যার প্রেক্ষিতে মির্জা ফখরুলের ওপর তারেক রহমানের অবিশ্বাস আরো বাড়ছে। এমনিতে ১/১১-এর সংস্কারবাদী এই নেতা নানান কারণে কখনই তারেক রহমানের পছন্দের নয়।

এখন মির্জা ফখরুলের বিকল্প হিসেবে বিএনপিতে আছেন রহুল কবির রিজভী। বিএনপির তরুণ কর্মীদের সঙ্গে মির্জা ফখরুলের থেকে রহুল কবীর রিজভীর সম্পর্ক অনেক বেশি। তাছাড়া সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে কমিউনিস্ট কর্মীদের মতো সার্বক্ষণিক পার্টি অফিসে থাকার ফলে বিএনপির তরুণদের ভেতর রিজভীর একটি ভিন্ন ভাবমূর্তি আছে। অন্যদিকে বিএনপির তরুণ থিঙ্কট্যাঙ্ক জি-নাইনের সঙ্গেও রিজভীর সম্পর্ক ভালো, তারা মির্জা ফখরুলের থেকে রিজভীকে অন্যরকম মনে করে। রিজভী তাদের চোখে অনেকটা বিপ্লবী। এছাড়া যতদূর জানা যায়, বেগম জিয়ার পছন্দ যাই থাকুক না কেন, তারেক রহমান রিজভীকে পছন্দ করে। তাই তরুণদের চাহিদা অনুযায়ী বেগম জিয়াকে ঘিরে আন্দোলনের গতি আনতে হলে বিএনপি বা তারেক রহমান কি তাদের সামনের ভাগে রুহুল কবির রিজভীকে এনে দাঁড় করাবেন? রহুল কবির রিজভী ইতোমধ্যে অনেক ক্ষেত্রে তেমন কাজ করেনও। যেমন এখন আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারির বক্তব্যের কাউন্টার বেশিক্ষেত্রে রিজভীই করেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও বিশেষ করে বিএনপির রাজনীতিতে এখন এ বিষয়টি ক্রমেই নানান পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে সামনে চলে আসছে। বেগম জিয়া ও তারেক রহমান তাদের নিজ নিজ অবস্থান আপাতত কী তা বুঝতে পেরেছেন। তাই তাদের দলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তারা এখন কী সিদ্ধান্ত নেবেন? তারা কি দলের তরুণদের পক্ষে যাবেন, না সিনিয়ররা যেভাবে সময়কে পার করে দিয়ে যাচ্ছেন অতি সাবধানে সেই পথে থাকবেন? এই দুটির যেকোনও একটি পথ বিএনপিকে এখন বেছে নিতে হবে। আর সেটা বেছে নিতে গেলে তাদেরকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও রুহুল কবির রিজভীর ভেতর থেকে একজনকেই বেছে নিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত   

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘আমি কোনও ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারি না’
‘আমি কোনও ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারি না’
তাপদাহে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের গাউন পরিধানে শিথিলতা
তাপদাহে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের গাউন পরিধানে শিথিলতা
সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা
সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা
উপজেলা নির্বাচন: জেলা-উপজেলায় আ.লীগের সম্মেলন বন্ধ
উপজেলা নির্বাচন: জেলা-উপজেলায় আ.লীগের সম্মেলন বন্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ