X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবেশীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই ভারতের

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১০ মে ২০১৮, ১৩:১১আপডেট : ১০ মে ২০১৮, ১৩:১৩

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দল তাদের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সম্প্রতি একটি নতুন দলিল প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা বর্তমান বিজেপি সরকারের সঙ্গে প্রতিবেশীদের সম্পর্ক নিয়ে কিছু কথা বলেছে। ‘বাংলা ট্রিবিউন’-এর সৌজন্যে তা আমাদের দৃষ্টিগোচর হযেছে। কংগ্রেসের পররাষ্ট্র বিষয়ক দলিলের বিষয়বস্তু নিয়ে আজকের এ লেখা।
ইশতেহারটার বয়ান প্রস্তুত করেছেন কংগ্রেসের এমপি এবং লোকসভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রধান শশী থারুর। পরবর্তী সময়ে দলীয় প্রধানের সম্মতিতে তা প্রকাশ করা হয়েছে। লোকসভার পররাষ্ট্র বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি পররাষ্ট্র বিষয় নিয়ে কথা বলার একটা শক্তিশালী ইউনিট ও শশী থারুর তার প্রধান। সুতরাং তার উপলব্ধি গুরুত্বহীন নয়।
নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর বলেছিলেন ‘নেইবার হুড ফাস্ট’ প্রথমে প্রতিবেশী আর সেই নীতিকে কটাক্ষ করে কংগ্রেস তার ইশতেহারের বলেছে ‘নেইবার হুড লস্ট’।

ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী হচ্ছে বাংলাদেশ, চীন, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মানদ্বীপ। চীন বিরাট দেশ। অর্থবিত্তে এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি। সুতরাং তার সঙ্গে কোনও বাড়াবাড়িতে জড়িত হওয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষ করে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের পর চীনকে ভারত সমীহ করে চলে।

দ্বিতীয় শক্তিশালী প্রতিবেশী হচ্ছে পাকিস্তান। ভারত থেকে ইংরেজরা চলে যাওয়ার সময় ভারতকে যখন বিভক্ত করে দিয়ে যায়, তখন পাকিস্তানের সৃষ্টি। ভারতের তুলনায় পাকিস্তান অনেক ছোট দেশ হলেও গত ৭০ বছরের মাঝে পাকিস্তানকে কাবু করা ভারতের পক্ষে কখনও সম্ভব হয়নি। সর্বোপরি উভয় রাষ্ট্র আনবিক শক্তির অধিকারী।

পাকিস্তানের আনবিক শক্তির জনক ডা. কাদেরকে যখন জিজ্ঞেস করা হযেছিলো, ‘আপনারা ছোট ছোট বোমা বানালেন কেন?’ তখন তিনি বলেছিলেন, আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সৈন্যসংখ্যা বেশি আর অস্ত্রশস্ত্রও বেশি। তারা যদি কোনও সময় বিপুল সৈন্য নিয়ে পাকিস্তান আক্রমণ করে তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য আমরা ছোট ছোট আনবিক বোমাগুলো ব্যবহার করবো। সুতরাং পাকিস্তানের শক্তির কথা চিন্তা করে ভারত কখনও পাকিস্তানের কোনও বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করেনি।

ভারতের বড়ত্বের সব অহমিকা দেখানোর ক্ষেত্র হলো বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে তো ভারতের ভালো প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক নেই; মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পর্ক খুব ভালো নয়। কারণ ভারত কারণে-অকারণে এ ছোট দেশ চারটার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায়। সম্ভবত এ কারণেই কংগ্রেস তার ইশতেহারে বলেছে যে, ‘মোদি সরকারের নীতির ফলে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।’

কিছুদিন আগে নেপাল তার শাসনতন্ত্র রচনা করার সময় প্রদেশগুলোকে পুনর্বিন্যাস করেছিল, তখন ভারত বলেছিল, বিহার ও উত্তর প্রদেশ সংলগ্ন নেপালের সমতল ভূমিটাকে নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করার জন্য। কিন্তু নেপাল তাতে রাজি হয়নি। কারণ ওই সমতল ভূমিতে ভারতীয় অরিজিনের লোকরাই বেশি বসবাস করে। পৃথক প্রদেশ গঠন করলে তারা স্বাধীনতা চাইতে পারে।

সুতরাং নেপাল মাদিসি অঞ্চলটাকে চার ভাগে বিভক্ত করে চার প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। এরফলে ভারতীয় বংশদ্ভূত জনগোষ্ঠী চার প্রদেশে সংখ্যালঘু হয়ে যায়। তাতে ভারত ক্ষুব্ধ হয়ে চার মাস নেপালকে অবরোধ করে রাখে। নেপাল স্থলভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত দেশ। সুতরাং নেপালে নিত্য প্রয়োজনীয় মালামালের হাহাকার পড়ে যায়। বাইরে থেকে কোনও কিছু নেপালে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি।

নেপালের উত্তরদিকে চীন আর চীন তখন তার রাস্তা খুলে দেয় এবং চীন থেকে মালামাল সরবরাহ করে। বাংলাদেশও নেপালকে বাংলাদেশের সৈয়দপুর বিমান বন্দর ব্যবহার করে বিমানে মালামাল নেওয়ার জন্য অনুমতি দেয়। সৈয়দপুর বিমান বন্দর দিয়ে জ্বালানি তেল বিমানে পরিবহন করে নেপাল তার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা কোনোরকমে চালু রেখেছিল। এ ঘটনায় নেপাল যে কষ্ট পেয়েছে শুধু তা নয়, অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও তো ভারতের আচরণ সম্পর্কে সচেতন হয়েছে।

নেপালের গত সাধারণ নির্বাচনে কমিউনিস্টরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে এখন সরকার গঠন করেছে আর ভারতপন্থী কৈরালাদের কংগ্রেস দলের ভরাডুবি হয়েছে। তারা পেয়েছে মাত্র ৩৩ সিট। চীনের সঙ্গে এখন নেপালের সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। চীন শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোতা বন্দরের ৭০ শতাংশ মালিকানা ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়ে একটা অত্যাধুনিক বন্দর স্থাপন করছে। ভারত এখন শ্রীলঙ্কার কাছে ত্রিনকোমালি বন্দর চেয়ে বসেছে। অথচ ত্রিণকোমালী সিংহলের একটা নিয়মিত বন্দর। এ বন্দর সিংহলের নিজেরই প্রয়োজন।

মালদ্বীপের সঙ্গে একই আচরণ করেছে ভারত। শেষ পর্যন্ত চীন তার অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াইনি। এখন চীন মালদ্বীপ নৌঘাঁটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চীনের অর্থনীতি ভারতের অর্থনীতির চেয়ে ৫ গুণ বড়। ভারতের রিজার্ভ ৩৫ হাজার বিলিয়ন ডলার আর চীনের রিজার্ভ হচ্ছে তিন ট্রিলিয়ন ডলার। সুতরাং চীনের থেকে প্রতিবেশীরা যে আর্থিক সাহায্য পেয়ে থাকে ভারত থেকে তা পাওয়া সম্ভব নয়। এখন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সব রাষ্ট্রই চীনমুখী। কারণ চীন কারও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।

ভারতের নেতা-আমলারা যখনই বাংলাদেশের কথা ওঠে, তখন বলে থাকেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের খুবই মধুর সম্পর্ক বিরাজমান। অথচ কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। চীনে যখন ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড নিয়ে সম্মেলন হয় তখন বিশ্বের বহুদেশের সরকার প্রধান তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন অথচ বাংলাদেশের সরকার প্রধান সেখানে উপস্থিত হতে পারেননি। আমরা মনে করি তাতে বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রেসার ছিল। না হয় আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনুরূপ কোনও সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার লোক নন।

নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদির পরে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরের সময় ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি হয়েছে। চীন থেকে বাংলাদেশের ঋণ নেওয়ার বিষয়টা ভারত পছন্দ করে না। ভারতের প্রেসার রয়েছে চীন থেকে ঋণ না নেওয়ার বিষয়ে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুখ খুলে বলেছেন চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভারতের সম্পর্কের ওপর কোনও প্রভাব ফেলবে না।

উত্তরবঙ্গে পানির অভাবে চাষবাদ বিঘ্নিত হচ্ছে তারপরও তিস্তাচুক্তি ভারত সম্পাদন করছে না সাংবিধানিক মারপ্যাচের কথা তুলে, পশ্চিম বাংলার সম্মতির কথা বলে। অথচ কোনও আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন চুক্তির বিষয় কখনও প্রাদেশিক সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় হতে পারে না। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখার পানি রেখে উদ্বৃত্ত পানি উভয় রাষ্ট্র সমানভাবে ভাগ করে নেবে, এটাই নিয়ম। দীর্ঘ সময়ব্যাপী বাংলাদেশকে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কষ্টই দিচ্ছে; কোনও সমাধানে আসছে না ভারত।

ভারতে আমলতান্ত্রিক জটিলতা খুবই কঠিন। এ পর্যন্ত ভারত দফায় দফায় ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ চুক্তি করেছে বাংলাদেশের সঙ্গে। ২০১১ সালে ১০০ কোটি ডলার, তার মাঝে ২০ কোটি ডলার অনুদান। চার বছর পর নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় ২০০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ৫০০ কোটি ডলারের সমঝোতা হয়, তার মাঝে ৫০ কোটি ডলার নির্ধারিত ছিল অস্ত্র খাতে। গত সাত বছরের ঋণ চুক্তির ৮০০ কোটি ডলার ঋণের মাঝে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত পেয়েছে মাত্র ৩৮ কোটি ডলার। অনুরূপ হাস্যস্পদ ঋণ চুক্তি কেন করা হয় কোনও সুষ্ঠু মস্তিস্ক লোকের বুঝে আসে না।

কংগ্রেসের এই ইশতিহার প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাড়াতাড়ি ঋণ দিয়ে বাংলাদেশের প্রকল্পগুলো শেষ করতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুরূপ তাগিদার পর আর কয় বছর সময়ক্ষেপণ হয় কে জানে!

আসামে ‘বাঙাল খেদাও’ আন্দোলনের সময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, ১৯৭১ সারের ২৫ মার্চের আগে থেকে যারা আসামে বসবাস করে আসছে, তারা আসামের লোক বলে গণ্য হবে। এ সিদ্ধান্তের পরও আসামের বিজেপি সরকার অহেতুক আসামে অবৈধ নাগরিক চিহ্নিতকরণের এক প্রক্রিয়া শুধু করেছেন এবং তাদের বাংলাদেশ ঠেলে দেওয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী শিলচর কেন্দ্রের এমপি এবং কংগ্রেসের মুখপাত্র সুস্মিতা দেব এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বিদেশি নাগরিক চিহ্নিত করে তাড়াতে চাইবেন খুব ভালো কথা কিন্তু এ লোকগুলোকে কোথায় ঠেলে পাঠাবেন সেটা কি ঠিক করেছেন? বাংলাদেশ তাদেরকে নিতে রাজি কিনা, তা নিয়ে তাদের সঙ্গে কোনও কথাবার্তা হয়েছে? এ ধরনের সমঝোতা ছাড়া পুরো প্রক্রিয়াটাই তো অর্থহীন।

সুস্মিতাকে ধন্যবাদ যে তিনি আসাম থেকে পুনরায় বাঙালি মুসলমান তাড়াবার যে পাঁয়তারা চলছে তা নিয়ে মুখ খুলেছেন। আসাম সরকার অবৈধ আখ্যায়িত করে বাঙালি মুসলমান তাড়ানোর যে কাজ করছে তাও তো দুদেশের সম্পর্কের মাঝে বিরাট ফাটল সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেস যথাসময়ে ইশতেহারটা প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশের ইশতেহারে যে সহানুভূতি প্রকাশ করেছে তার জন্য বাংলাদেশের মানুষ কংগ্রেসের প্রতি কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের মানুষ আশা করে যে কংগ্রেস ভারত সরকারকে আরো বাস্তবধর্মী হতে পরামর্শ দেবে। ভারত অন্যায় করার পর বাংলাদেশ তা তো নীরবে সহ্য করতে পারে না। সুতরাং সম্পর্কে ফাটল চিহ্নিত হওয়ার পর কংগ্রেস ইশতেহার প্রকাশ করে উত্তম কাজ করেছেন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অবৈধ অটোরিকশা-ইজিবাইককে লাইসেন্সের আওতায় আনার দাবি
অবৈধ অটোরিকশা-ইজিবাইককে লাইসেন্সের আওতায় আনার দাবি
বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে ৫টি চুক্তি এবং ৫টি সমঝোতা স্মারক সই
বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে ৫টি চুক্তি এবং ৫টি সমঝোতা স্মারক সই
যুক্তরাষ্ট্র থেকে পার্সেলে তরুণদের কাছে আসছে কোটি টাকার মাদক
যুক্তরাষ্ট্র থেকে পার্সেলে তরুণদের কাছে আসছে কোটি টাকার মাদক
গাজার হাসপাতালে গণকবর, আতঙ্কিত জাতিসংঘ অধিকার প্রধান   
গাজার হাসপাতালে গণকবর, আতঙ্কিত জাতিসংঘ অধিকার প্রধান  
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ