X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা ট্রিবিউন: এটা খায় না পরে?

প্রভাষ আমিন
১৩ মে ২০১৮, ০০:১২আপডেট : ১৩ মে ২০১৮, ১৬:৪৭


প্রভাষ আমিন : আপনি সাংবাদিক?




: জি।
: কোন পত্রিকা?
: বাংলা ট্রিবিউন।
: ও, বাংলাভিশন।
: না না, বাংলাভিশন নয়, বাংলা ট্রিবিউন।
: বাংলা ট্রিবিউন! এটা কী খায় না পরে? এটা পত্রিকা না টিভি? পত্রিকার কোনও স্টলে তো চোখে পড়েনি, টিভিতেও তো কখনও দেখিনি।
: এটা পত্রিকাও নয়, টিভিও নয়; অনলাইন।
: ও, অ-ন-লা-ই-ন। আগে বলবেন না? তা আপনাদের ডটকম নাই দেখে বুঝতে পারিনি। ভাব দেখে তো মনে হচ্ছিল, বিশাল সাংবাদিক। অনলাইনের কথা তো আগে বলেননি।
এটা কাল্পনিক সংলাপ।  আশা করি বাংলা ট্রিবিউনের কারও এ ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি।  তবে হলেও প্রশ্নকর্তাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না। জাতীয় প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ যেখানে অনলাইন সাংবাদিকদের সদস্য করার যোগ্য মনে করে না, সেখানে সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়ে কী লাভ? নিজেদের দোষেই বাংলাদেশে অনলাইন অবহেলিত, উপেক্ষিত।  
গণমাধ্যমের তথ্য প্রচারের যে  ক’টি মাধ্যম, তার মধ্যে সর্বশেষ ও সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অনলাইন। ছাপা পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন হয়ে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ এখন অনলাইনে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই এই প্রবণতা এখন বাস্তবতা। নিকট ভবিষ্যতে ছাপা পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবে, এমন আশঙ্কা করতে আমার মন সায় দিচ্ছে না। তবে সংবাদ সংগ্রহের জন্য মানুষের নির্ভরতা ক্রমশ অনলাইনমুখী হচ্ছে। সব ছাপা পত্রিকারই অনলাইন ভার্সন আছে, অধিকাংশ টিভিরও আছে। এখনই আমি অনেক মানুষকে চিনি যারা ছাপা পত্রিকা পড়েন না, এমনকি টিভিও দেখেন না। তাদের সব সংবাদ উৎস অনলাইন।  অনলাইনের তাৎক্ষণিকতার কাছে বারবার মার খেয়ে যাচ্ছে ছাপা পত্রিকা। গত শুক্রবার বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া আরেকবার গোটা জাতিকে লজ্জায় ফেলেছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে মহাকাশে উড়ে যাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। শেষ মুহূর্তে এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ স্থগিত হয়ে যায়।  আগ্রহী মানুষেরা রাত জেগে লাইভ দেখেছেন বা অনলাইনে আপডেট নিয়েছেন। কিন্তু সকালে ঘুম ভেঙেই সবাই বিস্ময়ে হতভম্ব। অনেক পত্রিকায় স্যাটেলাইট উড়ে গেছে ধরে নিয়ে ‘স্যাটেলাইট যুগে বাংলাদেশ’ ধরনের শিরোনাম করেছে।  আবহাওয়া বা কারিগরি ত্রুটির কারণে যে শেষ মুহূর্তে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বাতিল হতে পারে, এই আশঙ্কাটুকু কেউ আমলেই নেয়নি। সবাই নিশ্চিত ধরে নিয়ে শিরোনাম করেছেন।  প্রিন্ট মিডিয়ার প্রায় সবাই একযোগে এমন একটি ব্লান্ডার করতে পারে, তা অবিশ্বাস্য। বোঝাই যায়, অনলাইনের তাড়া খেয়েই প্রিন্ট মিডিয়ার এই তাড়াহুড়ো।
শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত; কানে শুনতে পেলেই যে কেউ বেতারের শ্রোতা হতে পারেন।  টেলিভিশনের দর্শক হতে হলে, কানের সঙ্গে দৃষ্টিশক্তিও থাকতে হবে।  কিন্তু পত্রিকার পাঠক হতে হলে আপনাকে অন্তত বানান করে পড়ার মতো শিক্ষিত হবে। আর অনলাইনের পাঠক হতে হলে শুধু শিক্ষিত হলেই চলবে না, কিছুটা প্রযুক্তি শিক্ষাও থাকতে হবে।  সঙ্গে থাকতে হবে ইন্টারনেট কেনার মতো আর্থিক সক্ষমতাও। তার মানে অনলাইনের পাঠক হচ্ছে, সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ। আশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়, সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশের মাধ্যমটিতে সাংবাদিকতাও উৎকর্ষের চূড়া স্পর্শ করবে। কিন্তু ঘটনা ঘটছে উল্টো। সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর পাঠকদের মাধ্যম অনলাইনেই হচ্ছে সবচেয়ে অনগ্রসর সাংবাদিকতার চর্চা। শুরুতে যে কাল্পনিক সংলাপ তুলে ধরা হয়েছে, তার দায়ও এই অনগ্রসর সাংবাদিকতার।
আপনি বাংলাদেশের কয়টি অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিউজ বিশ্বাস করেন? আচ্ছা প্রশ্নটা আরও সহজ করে দেই।  আপনি বাংলাদেশের ক’টি অনলাইন নিউজ পোর্টালের নাম জানেন? ৫টা, বড় জোর ১০টা। আমি কিন্তু ১০টার বেশি পারবো না।  কিন্তু বাংলাদেশে অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে কয়টি? এক হাজার, ৫ হাজার, ১০ হাজার। আমার ধারণা, কেউ বাংলাদেশের অনলাইনের সঠিক সংখ্যা জানেন না।  জাতীয় প্রেসক্লাবের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাংলাদেশের সব অনলাইনের সাংবাদিকদের কোনও একটি সংগঠনের সদস্য করতে হলে, সেই সংগঠনের কার্যালয় করতে হবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে।
গণমাধ্যমের কাজ হলো মানুষকে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহ করা। কিন্তু সাংবাদিকতার পাশেই শুয়ে থাকে অপসাংবাদিকতা।  পত্রিকায় নিউজ ছাপিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় অনেক পুরনো অভিযোগ। চাঁদা না পেলে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে নিউজ ছাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগও কম নেই। সাংবাদিকতার নামে সেই চাঁদাবাজিটা করতে আগে অনেক কষ্ট করতে হতো। অন্তত পত্রিকা ছাপতে তো হতোই।  অনলাইন আসার পর এখন সবকিছু জলবৎ তরলং। কারও বিরুদ্ধে যেকোনও একটা ডটকম-এ একটা নিউজ প্রকাশ করতে হবে।  তারপর সেই নিউজের লিংক ফেসবুকে শেয়ার দিতে হবে, বন্ধুবান্ধবদের দিয়ে শেয়ার দেওয়াতে হবে। আরও বেশি প্রচার চাইলে অল্প কিছু টাকা দিয়ে বুস্ট করাতে হবে। ব্যস, আপনি যাকে ঘায়েল করতে চাইছেন, তিনি শেষ হয়ে যাবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন শত শত লিংক ঘুরে বেড়ায়।
পত্রিকার সার্কুলেশন নির্ধারিত হয় বিক্রির ভিত্তিতে, টেলিভিশনের টিআরপি নির্ধারিত হয় দর্শক সংখ্যার ভিত্তিতে।  আর অনলাইনের জনপ্রিয়তা মাপা হয় ক্লিক-এর ভিত্তিতে।  যত পাঠক ওই লিংকে ক্লিক করবে অনলাইন তত হিট।  এই হিটের জন্য পাগলপারা সব অনলাইন।  আর ক্লিক পেতে মরিয়া অনলাইনগুলো যা করে, তার সঙ্গে সাংবাদিকতার দূরতম কোনও সম্পর্কও নেই।  শিরোনামের সঙ্গে কনটেন্টের কোনও মিল নেই। কনটেন্ট যা থাকে, তা করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নিয়ম-কানুন মানা হয় না। ইন্টারনেটের বিশাল জগতে ঘুরে বেড়ানো শত শত, হাজার হাজার লিংকের কোনটা নিউজ, কোনটা ফেক, তা যাচাই করতে পাঠককে রীতিমতো গোয়েন্দা হতে হয়। গোটা দশেক বাদ দিলে বাংলাদেশের অধিকাংশ অনলাইন নিউজ পোর্টালের  কোনও মা-বাপ নেই।  মা-বাপ নেই বলাটা বোধহয় ঠিক হলো না।  আদরের সন্তানের নামের শেষে ২৪ডটকম জুড়ে দিলেই হয়ে গেলো একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। মা প্রকাশক, বাবা সম্পাদক। ব্যস সাংবাদিক পরিবার।  গাড়ির সামনে ‘সংবাদপত্র’ লাগিয়ে ঘুরবেন, চাঁদাবাজি করবেন, মাস্তানি করবেন। সব জায়েজ।  শত শত, হাজার হাজার অনলাইনের ভিড়ে সত্যিকারের সাংবাদিকতা করা গোটা দশেক অনলাইনের মান-সম্মান নিয়ে টিকে থাকাই মুশকিল।
বাংলাদেশে অনলাইনের ইতিহাস যুগ পেরিয়েছে। তবে অনলাইনের বুমটা শুরু হয়েছে বছর পাঁচেক হয়। এই বুমের স্রোতে ভেসেই এসেছে বাংলা ট্রিবিউন। কিন্তু স্রোতে গা ভাসায়নি।  বরং এই ভিড় থেকে নিজেদের আলগোছে আলাদা করে ফেলেছে। অনলাইনে গা ভাসানো আর হিটের পেছনে ছোটাটাই সবচেয়ে সহজ। কিন্তু বাংলা ট্রিবিউন সহজ পথে পা দেয়নি। বরং অনলাইনের বিভ্রান্তির কাদা গা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজেদের আরও বিশ্বস্ত করে তুলেছে। বাংলাদেশের হাজারো অনলাইনের ভিড়ে যাদের ওপর আস্থা রাখা যায়, বাংলা ট্রিবিউন তাদের প্রথম সারিতে। কলাম লেখার সুবাদে যেটুকু যোগাযোগ, তাতে জানি, এই অনলাইন পোর্টালটি কখনোই হিটের পেছনে ছোটেনি, বস্তুনিষ্ঠ হতে চেয়েছে। অনলাইনেও ভালো সাংবাদিকতা করা যায়, বারবার তার প্রমাণ রেখেছে।
চার বছরে বাংলা ট্রিবিউন তাদের লক্ষ্যটা ঠিক করতে পেরেছে। এখন দায়িত্ব হলো, সতর্ক থেকে সেই লক্ষ্যের দিকে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যাওয়া।
লেখাটি শেষ করছি ছেলেবেলায় বাবার কাছে শোনা একটি গল্প দিয়ে। কুমিল্লার দিকে একটি বিড়ির কোম্পানি ছিল। তারা বছরে একবার ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করতো। একবার যে বক্তাকে আনা হলো, তিনি পুরো ওয়াজে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিশদ বর্ণনা করলেন। আয়োজকদের তো মাথায় হাত। ওই বক্তা তার বক্তব্যের শেষে বললেন, ধূমপান অনেক ক্ষতিকর। কিন্তু তারপরও তো আপনারা আমার কথা শুনবেন না। ক্ষতিকর জেনেও যদি ধূমপান করবেনই, তাহলে আয়োজকদের এই বিড়িই খাইয়েন। আমিও সেই বক্তার মতো বাংলা ট্রিবিউনের জন্মদিনে অনলাইনের বদনাম করলাম। এরপরও তো আপনারা ডেস্কটপে হোক, ল্যাপটপে হোক, ট্যাবে হোক, মোবাইলে হোক; অনলাইনের নিউজ লিংকেই ক্লিক করবেন। আপনারা নিশ্চিন্তে বাংলা ট্রিবিউনের লিংকে ক্লিক করতে পারেন। কথা দিচ্ছি, ঠকবেন না, বিভ্রান্ত হবেন না।  

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমএনএইচ/চেক-এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ