কিছুদিন আগে একটা ছোট্ট পোস্ট দিয়েছিলাম আমার ফেসবুক পাতার টাইমলাইনে। পরে মনে হলো, এটা অতিবিশ্লেষণাত্মক না হলেও পূর্বাপর আর একটু সম্প্রসারণের দাবি রাখে। কারণ, হঠাৎ শুরু, এবং প্রায় বিনা নোটিশে শেষ, কারো কারো ভাবনাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আমি শুরুর অংশটি প্রায় তেমন রেখেই তার পূর্ব প্রেক্ষাপটসহ কিছু কিছু বিষয়ে আর একটু খোলাসা করতে চাই।
মেঘ জমা হয় আকাশের উচ্চতায়। তারপর সেখানে শীতল বাতাসের সংস্পর্শে এলে সেই মেঘ, বা তার অংশবিশেষ পরিণত হয় বৃষ্টি আকারে। নেমে আসে পৃথিবীর দিকে। কিন্তু আকাশের সেই বৃষ্টি যদি মাটি পর্যন্ত পৌঁছাবার আগেই শুকিয়ে যায়, বা আবার বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, তাহলে মাটির হিসেবে, সে বৃষ্টি ব্যর্থ। সেভাবেই সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতার ভাব জমা হয় মস্তিষ্কের উচ্চতায়। সেই ভাব, নির্মাণ ভাবনার জাগরণের সংস্পর্শে এসে সৃষ্টি হয় কবিতার। কিন্তু সেই কবিতা যদি সাধারণের চেতনায় এসে অন্তত কড়া নাড়তেও না পারে, তাহলে সেই সৃষ্টিও ব্যর্থ। [এই স্তবকে আমি যা বললাম, তা একটি রবীন্দ্র-উক্তির সঙ্গে আমার অনুভবের সংযোজন মাত্র।]
বাংলা সাহিত্যের জন্ম হয়েছে বাংলা কবিতার উদর থেকেই। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়, বাংলা গান কবিতার মধ্য দিয়ে। তাহলে, প্রথম যে কথাটা বলা সঙ্গত, তা হলো, বাংলা সাহিত্যের জন্মদাতা কবিবৃন্দই। এবং তার মধ্যেও বিশেষ ভাবে গানের কবি। এই কবিবৃন্দ আবার সুরে পারদর্শী ছিলেন বলেই, সেই সব খণ্ড কবিতার ওপরে রাগ ও তালের নাম পাওয়া যায়। আর একটি বিষয় হচ্ছে, সেই কবিদের সবাই প্রচলিত লোকধর্মের গভীরে অন্য বিশেষ মর্মার্থের অনুসন্ধান করতেন। ধর্মের প্রধান লক্ষ্যই হলো মানুষকে কিছু অনুশাসনের মধ্যে বেঁধে ফেলা। সেই অনুশাসনের অন্যথা যেমন শাস্ত্রকারেরা তেমনই তাদের দ্বারা শাসিত মানুষেরা কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। কিন্তু যিনি ভাবুক, এবং ভাবনা যাকে আরও গভীর কিছুর সন্ধান দেয়, তাঁরা তো, ওই অনুশাসনের গণ্ডিতেই নিজেকে আবদ্ধ রাখতে পারেন না। আবার তাঁদের কথা সরলভাবে উপস্থাপন করাও বিপজ্জনক। তাতে শাস্ত্র ও শাস্ত্রশাসিতদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে। তাই তাঁরা তাঁর সাধনলব্ধ বাণী উপমা-রূপকের রেখে ঢেকে প্রকাশ করতেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কবিতা, বিশেষ করে খণ্ডকবিতা, তার জন্মলগ্ন থেকেই অনেকটা শব্দাড়াল সৃষ্টিকারী। যাকে সাধারণ মানুষ হেঁয়ালি হিসেবেই ধরে নিতেন।
খণ্ডকবিতার আর একটি রূপ আমরা পেলাম বৈষ্ণব পদরত্নাবলিতে। সেই সব পদের সকল কিছুই রাধা-কৃষ্ণকে ঘিরেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সেই কবিতার রাধা-কৃষ্ণ যেন দেবদেবী নন। তাদের প্রেম-কাম-মান-অভিমান-বিরহ সবই বড় বেশি মানবিক। অলৌকিকতা বা অতিলৌকিকতা কবিদের সৃষ্টিতে পরিণত হলো, মানুষের আবেগ-উপলব্ধিতে। তবে সেই কাব্য ভাষাও অসংখ্য উপমা-রূপকে মধুর। যেমন—‘নাহিয়া উঠিতে নিতম্ব তটীতে পড়েছে চিকুর রাশি/ কালিয়া আঁধার কনকচাঁদার শরণ লইলো আসি।।’ রাধা স্নান করে উঠতেই তাঁর ভেজা কালো চুলের গুচ্ছ, তাঁর সোনালি নিতম্বে এসে পড়েছে। যেন, কালো অন্ধকার সোনালি চাঁদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। গহিন অর্থে, কৃষ্ণ রাধার শরন নিয়েছে। অর্থালংকারের কী অপূর্ব নিদর্শন ফুটে উঠেছে, দ্বিতীয় পঙক্তিতে।
কবিতার এই বিদ্যুৎঝলক অনেকাংশে হারিয়ে যায়, কাহিনিকাব্যে এসে। দীর্ঘ উপাখ্যান গ্রন্থনে বিবরণধর্মিতা প্রধান হয়ে উঠেছে। তাই তারও শরীরে থেকে থেকেই বিদ্যুৎ ঝলকে উঠেছে। তবু এই সমস্ত কাহিনিকাব্য বা পুথিসাহিত্যের সুরসহযোগে পাঠে একটি শৃঙ্খল যেন বেড়ি হয়ে বসেছিল কবিতার পায়ে। প্রথম পঙক্তিতে এক দাঁড়ি, দ্বিতীয় পঙক্তি শেষে দুই দাঁড়ি নিয়ে চলছিল পয়ার ছন্দ। প্রথম পঙক্তিতে বাক্য শেষ, দ্বিতীয় পঙক্তির মধ্যেই প্রসঙ্গ শেষ করতেই হতো। এই কারণে, এতে কোনও প্রবহমানতা ছিল না। এই শৃঙ্খল ভাঙলেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
মধুসূদন অনেক খণ্ডকবিতা রচনা করলেন, যা পঙক্তির প্রান্তমিলসহ অথবা বর্জিত, যেমনই হোক, তিনি বাক্যকে প্রবাহিত করলেন, পঙক্তির গণ্ডি অগ্রাহ্য করে। শুধু খণ্ডকবিতা নয়, কাব্য এবং মহাকাব্যও রচিত হলো একই ধারায়। মধুসূদনের বিদ্রোহ শুধু পয়ারকে সচল করায় নয়, বা প্রান্তমিল বর্জন করায় নয়। তিনি বিদ্রোহ আনলেন কাব্যচিন্তাতেও। তাই মেঘ্নাদবধ মহাকাব্যের নায়ক হলেন, রাবণ, রাম নন। মধুসূদন বহু আলোচিত। তা ছাড়াও, আমার এই নিবন্ধ সাহিত্য আলোচনা বা সমালোচনা নয়। বাংলা কবিতার বিশেষ বিশেষ বাঁক পরিবর্তন এবং তার একটি ধারাবাহিকতার ইঙ্গিত দেওয়া। তাই এরপর শুরু করবো, মূলত রবীন্দ্রনাথ দিয়ে।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট