X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘রেখো মা দাসেরে মনে’

রুমীন ফারহানা
০৩ জুন ২০১৮, ১৪:৪৪আপডেট : ০৩ জুন ২০১৮, ১৪:৪৮

রুমীন ফারহানা সুস্থ বিনোদন নাকি স্বাস্থ্যকর। মন, শরীরের স্বাস্থ্য ভালো রাখার পাশাপাশি আয়ু বাড়াতেও ভূমিকা রাখে। দুর্ভাগ্য আমাদের, যারা বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বাস করি; আমাদের নির্মল, স্বাস্থ্যকর বিনোদনের বড় অভাব। তবে মাঝে মাঝেই আমাদের এই অভাব খানিকটা পূরণ হয় টেলিভিশনের পর্দা থেকে। বিশেষ করে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন থাকে। উনি রসিক মানুষ। নানা বিষয়ে ওনার রসালো মন্তব্য কিছুটা হলেও আমাদের প্রাত্যহিক একঘেয়ে ক্লান্তিকর জীবনে বৈচিত্র্য আনে। তবে ওনার মন্তব্যের চেয়েও অনেক বেশি কৌতুহলোদ্দীপক থাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে থাকা সাংবাদিকদের নানাবিধ প্রশ্ন এবং প্রশ্নের চেয়ে বেশি তাদের দেওয়া বক্তব্য বা মন্তব্যগুলো।
চ্যালেনগুলো লাইভ দেখায়। অন্যদের কথা জানি না আমি, ব্যক্তিগতভাবে এত আগ্রহ নিয়ে কম অনুষ্ঠানই দেখি। সুপরিচিত সম্পাদক থেকে তরুণ রিপোর্টার সবারই অবাধ বিচরণ, চাপা প্রতিযোগিতা। কার প্রশ্ন বা মন্তব্য প্রধানমন্ত্রীকে কত বেশি ‘তুষ্ট’ করতে পারবে সেটাই এখানে মুখ্য বিষয়। অনেকটা ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ স্টাইল। আমাদের মতো আমজনতার একটাই লাভ, নির্দোষ কিছু বিনোদন মুফতে পাওয়া। এই প্রশ্ন প্রশ্ন খেলায় একেকবার একেকজন বাজিমাত করেন। যেমন এইবার প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে দর্শক মন জয় করেছেন নামকরা দৈনিকের একজন প্রবীণ সাংবাদিক। তেলের তাল সামলাতে না পেরে উনি নোবেলের এমন মোক্ষম ফর্মুলা বাতলেছেন যে ওই লাইনে হেঁটে যেকোনও বিত্তবানই নোবেল বাগাতে পারেন।

যাই হোক, এবারের সংবাদ সম্মেলনটি ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে। বউ বদলানো যায়, কিন্তু প্রতিবেশী নয়, আফসোস। আর তাই প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া বাঁধানো কোনও কাজের কথা নয়। ডিপ্লোমেসি তেমন বুঝি না তবে এটা বুঝি দু’দেশের ডিপ্লোমেসিতে নেগোসিয়েশন একটি বড় ভূমিকা পালন করে। আর নেগোসিয়েশন অনেকটা বাধ্য হয়েই বুঝি এ কারণে যে ব্যারিস্টারি পাস করতে আমাকে এই বিষয়ের ওপর ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। নেগোসিয়েশনের মূল মন্ত্রই হলো ‘কিছু দেওয়া, কিছু পাওয়া’। সব দেওয়া বা সব পাওয়ার চেষ্টা করলেই ফেল। আমি এই বিষয়ের পরীক্ষায় সব পাওয়ার চেষ্টা করে প্রায় ফেল করে ফেলেছিলাম। যাই হোক কাজের কথায় ফিরি।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে আগে এই সফর উপলক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আগ্রহ দেখালে পশ্চিমবঙ্গের এই সফরে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের বাইরে গত ২২ এপ্রিল বিজেপির আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের ১৯ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দেশটি সফর করে। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার স্পিকার, বিজেপির সাধারণ সম্পাদকসহ রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক হয়। এছাড়া ভারতের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর বাসভবনে নৈশভোজে রাজনীতিক, সাবেক কূটনীতিক ও ভারতের চিন্তকেরা উপস্থিত ছিলেন। ঢাকায় ফিরে সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের অবশ্য স্পষ্ট বলেন ‘নির্বাচন নিয়ে মোদি একটি কথাও বলেননি’। প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, এরও আগে গত ১৬ মার্চ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল কংগ্রেসের আমন্ত্রণে দেশটি সফর করে। সেখানে রাহুল গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী এবং মনমোহন সিংহসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়। মাত্র ছয় মাসে তিন তিনবার আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতাদের ভারত সফর, বিশেষ করে বছরটি যখন নির্বাচনি বছর এবং দুষ্টুলোকের কথামতো সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে, তখন তো একটু প্রশ্ন জাগতেই পারে মনে। তার ওপর যখন ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের অস্থিরতা, সুজাতার দৌড়ঝাঁপ অনেকেরই স্পষ্ট মনে আছে।

প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর পর দেশীয় মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো ‘স্পিকটি নট’ থাকলেও ভারতের বিখ্যাত আনন্দবাজার পত্রিকা ২৬ তারিখেই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘দিল্লির পাশে থেকেছে ঢাকা, মোদির কাছে ‘প্রতিদান’ চান হাসিনা’। প্রতিবেদনটি অনেকেরই নজরে এসেছে, বেশ কিছু অনলাইন মাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে খবরটি। সেখানে বেশ স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধনকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একান্ত বৈঠকে ভারতকে দেওয়া ট্রানজিট, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক মঞ্চে বারবার ভারতের পাশে থাকার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। বিনিময়ে চেয়েছেন নির্বাচনে ভারতের সহযোগিতা। সঙ্গে এও মনে করিয়ে দিয়েছেন মোদিকে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে পূর্বে আর পশ্চিমে পাকিস্তান নিয়ে ঘর করতে হবে ভারতকে। তাই ভারতের উচিত বর্তমান সরকারই যাতে ক্ষমতায় আসে সে বিষয়ে সহযোগিতা করা। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নির্বাচনে ভিন্ন একটি রাষ্ট্র কী করে সহযোগিতা করতে পারে যাতে একটি বিশেষ দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে এবং এই ধরনের সাহায্য প্রার্থনা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি কিনা সেটা ভিন্ন আলোচনা।

তবে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি স্পষ্ট বলেন, তিনি কোনও প্রতিদান চান না। তিনি নিতে নয় বরং দিতে বেশি পছন্দ করেন। তিনি আরও বলেন, তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন তা তারা সারা জীবন মনে রাখবে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মুখ্য উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন দৃশ্যত এটি ছিল শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশের ২৫ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন অনুষ্ঠান। বাড়তি পাওনা ছিল সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি, ঠিক যেমন আগেরবার ছিল বঙ্গবন্ধুর নামে ভবন, রাস্তা কিন্তু তিস্তা নয়। যেমন নয় সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ, ১৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তি, বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনা, শুল্ক অশুল্ক বাধা দূর, ভারত থেকে ভেসে আসা ফেনসিডিল বন্ধ করা (মাদকে কিন্তু জিরো টলারেন্স, চলছে গুলি, মরছে মানুষ) ইত্যাদি ইত্যাদি। তিস্তা আর রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের ভাব বোঝা গেছে, এখন আসাম থেকে বাঙালি নাম দিয়ে মুসলমানদের ঢল বাংলাদেশে না পাঠালেই আমরা কৃতার্থ থাকবো। যাক আগেই বলেছি সফল নেগোসিয়েশন মানে কিছু দেওয়া, কিছু পাওয়া। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন, ট্রানজিট, বিশ্বদরবারে অকুণ্ঠ সমর্থন, রিলায়েন্স বা আদভানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তি, রামপাল দিয়ে সুন্দরবন ধ্বংস, ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বা রেমিট্যান্স পাঠানো দেশগুলোর তালিকার প্রায় শীর্ষে বাংলাদেশের স্থান, পদ্মার সুস্বাদু ইলিশ, জামদানি শাড়ি সবকিছুর মূল্যই কি শোধ হয়ে গেছে ২০১৪ সালের নির্বাচনে? তাহলে আর হাতে রইলো কি রাস্তা আর ভবন ছাড়া?

মানুষ আশায় বাঁচে। আমি আশা করি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে সব দলের জন্য, ভোটের মাঠে সমান সুযোগ পাবে সবাই, প্রচারণা চলবে উৎসবমুখর পরিবেশে, ভোটাররা ভোট দেবেন তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বিনা বাধায়, নিঃশঙ্কচিত্তে, শিশু বা মৃত ব্যক্তির কোনও ভোট হবে না, প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাপে থাকবে না, ভোট গণনা এবং ফলাফল প্রকাশ সুষ্ঠু ও সঠিক হবে। আমি জানি পড়ার এই পর্যায়ে হাসছেন আপনি। বাংলাদেশে এমন ভোট দেখেছে কে কবে? সেই ৭৩ থেকে শুরু। তবে মনে রাখবেন, পরিবর্তন কিন্তু হঠাৎ করে হয় না, পরিবর্তন শুরু করতে হয়। আর এই শুরুর কিছুটা দায় কিন্তু আপনারও। কথায় বলে না ‘রাজা কেমন, প্রজা যেমন। প্রজা কেমন, রাজা যেমন’। এর অর্থ বুঝলে ভালো, না বুঝলে অনর্থ চলবে সামনে, আগেও যেমন চলেছে।  

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ