X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচনের বছরে সাবধানী অর্থমন্ত্রীর বিদায়ী বাজেট

প্রভাষ আমিন
০৭ জুন ২০১৮, ২০:১৭আপডেট : ০৭ জুন ২০১৮, ২০:২০

প্রভাষ আমিন বাজেট নিয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষক সাখাওয়াত আলী খানের একটি গল্প আছে। সাখাওয়াত আলী খান একবার রিকশায় যেতে যেতে বাজেট নিয়ে কথা বলছিলেন। রিকশাচালক বললেন, এটুকু বুঝি বাজেট দিলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। তার কৌতূহল ছিল, যে জিনিস দিলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, সে জিনিস না দিলে কী হয়? তবে এবার বাজেট প্রস্তাবনা পেশের আগেই জিনিসপত্রের দাম বাড়া নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি দাবি করেছেন, গত ৯ বছরে বাজেটের পর জিনিসপত্রের দাম বাড়েনি, এবারও বাড়বে না। অর্থমন্ত্রী খুব একটা ভুল বলেননি। আগে যেমন বাজেট দিলেই ঢালাওভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতো, এখন সেটা অনেক কমেছে।
আবুল মাল আবদুল মুহিতের আকাঙ্ক্ষা ঠিক থাকলে এটি তার জীবনের শেষ বাজেট। শুধু শেষ বলে নয়, এই বাজেট পেশ করেছেন তিনি অনেক রেকর্ড নিয়ে। টানা দশম বাজেট উপস্থাপনা, সব মিলিয়ে ১২টি বাজেট পেশ করলেন আবুল মাল আব্দুল মুহিত। এই রেকর্ড ভাঙা নিকট ভবিষ্যতে যে কারো জন্য কঠিন হবে। তবে একটি রেকর্ড প্রতিবছরই হয়, প্রতিবছরই ভাঙে; সেটি হলো বাজেটের আকার। ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৫ ভাগ এবং মূল বাজেটের চেয়ে ১৬ ভাগ বড়। বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন যে গতি, তাতে নিশ্চিতভাবেই আগামী বছরই এই রেকর্ড ভেঙে যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দারুণ গতিশীল। তবে রাজনীতি ততটা নয়। একসময় অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের রাজনীতিও গতিশীল ছিল। বাজেট পেশ শেষ হওয়ার আগেই ‘এই বাজেট গণবিরোধী, এই বাজেট মানি না’ ব্যানার নিয়ে মিছিল বেরিয়ে যেতো। এখন আর ঢালাও প্রতিবাদের সেই সংস্কৃতি নেই, সেই সুযোগও নেই। রাজপথ থেকে প্রতিবাদ এখন ভার্চুয়াল জগতে চলে এসেছে। মূল প্রতিবাদটা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। এরপর তার ঢেউ লাগে গণমাধ্যমে। তবে নিজের শেষ এবং নির্বাচনের বছরের বাজেট হওয়ায় অর্থমন্ত্রী এবার খুব সতর্ক ছিলেন। কোনও ঝুঁকি নেননি, হেঁটেছেন গতানুগতিক পথে। তাই তাৎক্ষণিকভাবে ঢালাও সমালোচনার সুযোগ কম। গত অর্থবছরের বাজেট পেশ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আবগারি শুল্ক আর ভ্যাট নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। অর্থমন্ত্রীকে শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে হয়েছিল। এবার সাবধানী অর্থমন্ত্রী তেমন কোনও পচা শামুক রাখেননি।

স্বীকার করছি, বাজেট ব্যাপারটা আমি একদমই বুঝি না। অন্য সবার মতো কোন জিনিসের দাম বাড়লো আর কোনটার কমলো; এটা মনোযোগ দিয়ে দেখি। আয়কর কাঠামোতে কোনও পরিবর্তন আসলো কিনা দেখি। তবে এটুকু বুঝি, একটা সংসারের যেমন সারা বছরের একটা পরিকল্পনা থাকে, আয়-ব্যয়ের একটা হিসাব থাকে, অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে, বেড়ানোর পরিকল্পনা থাকে, চিকিৎসার জন্য খরচ বরাদ্দ থাকে; দেশেরও তেমনি। বাজেট মানে দেশের সারা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব। এখানে সরকারের প্রায়োরিটি ঠিক করা থাকে। পরিবারের আয়-ব্যয়ের হিসাব করার সময়ও আমরা প্রায়োরিটি ঠিক করি। পারিবারিক হিসাবের সময় আমরা অনেক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা করি, যেমন বেড়ানোর পরিকল্পনা থাকে হয়তো মরিশাস, শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয় কক্সবাজার। তেমনি দেশের বাজেটেও অনেক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা থাকে, যা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় না। বাজেট প্রস্তাবনার সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নের অনেক ব্যবধান থাকে। সরকার যত দক্ষ, ব্যবধান তত কম। এখানেই মুন্সিয়ানা। এখন আমাদের আয় বেড়েছে, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বেড়েছে। আরো অনেক মেগা প্রকল্পও আমাদের সামর্থ্যের উদাহরণ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে খালি আয় বাড়ালেই হবে না। ঠিকমত ব্যয় করতে পারাটাও একটা দক্ষতা। এ ব্যাপারে আমাদের দক্ষতায় এখনও অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। শেষ মুহূর্তে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের তাড়াহুড়ো দেখেই বোঝা যায় ব্যয় করাটা আমরা এখনও ভালো করে শিখে উঠতে পারিনি।

আগেই বলেছি নির্বাচনি বছর বলে এবার অর্থমন্ত্রী খুব সাবধানী ছিলেন। কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাননি। নতুন করের বোঝা চাপাননি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমেছে। করপোরেট কর হার কমেছে। ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর আলোচনা থাকলেও তা হয়নি। আয়কর হারে স্তর একটু পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। তবে বড় পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে ভ্যাট হারে। আয়কর খাতে খুব বেশি পরিবর্তন না এলেও লক্ষ্যমাত্রা যথারীতি উচ্চাভিলাষী। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা, এরমধ্যে  রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে আদায় করার লক্ষ্য ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। তবে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। বড় রকমের ঘাটতি থেকেই যাবে। অথচ কর হার না বাড়িয়েও কর জাল বিস্তৃত করা গেলে এর চেয়ে অনেক বেশি কর আদায় সম্ভব। রাজস্ব বোর্ড বিভিন্ন চাকরিজীবী বা প্রাতিষ্ঠানিক আয়করদাতা, যারা করজালে আটকা পড়েছেন, তাদের কাছ থেকেই নানা কায়দায় কর আদায় করেন। কিন্তু এই জালের বাইরেও ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক রাঘববোয়াল। তাদের ধরার চেষ্টাও নেই, ইচ্ছাও দেখা যাচ্ছে না। বছরে আড়াই লাখ টাকা আয় করেন, এমন লোকের সংখ্যা এখন বাংলাদেশে কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। অথচ নিম্ন মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশের পথে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশে টিআইএন আছে মাত্র ৩৩ লাখ মানুষের। তাও এই সবাই কর দেয়ার মতো নন। জালে আটকা পড়েছেন বলেই বাধ্য হয়ে টিআইএন করতে হয়েছে। আয়কর দেওয়া ভোগান্তির নয়, কর দেওয়া দেশপ্রেমের অংশ; এই প্রচারণা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে পারলে আরো অনেক বড় বাজেট দেওয়া সম্ভব। সম্ভব আরো অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নেরও।

আগেই বলেছি বাজেট প্রস্তাবনার সঙ্গে বাস্তবায়নের ফারাক যত কম; সরকার তত দক্ষ। তবে এটা নিশ্চিত করে বলে যায়, নির্বাচনের বছরে প্রস্তাবনার সঙ্গে বাস্তবায়নের ফারাক আরও বাড়বে। প্রস্তাবিত বাজেটে আয় ও ব্যয়ের সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ থেকে এই ঘাটতি মেটানোর পরিকল্পনার কথা বলেছেন। তবে আমি সত্যি বিশ্বাস করি, বছরে আড়াই লাখ টাকা আয় করেন, এমন সবাই আয়কর দিলে; এই ঘাটতি অনেক কমে আসবে। হয়তো একদিন থাকবেই না।

ব্যক্তির ওপর কর বোঝা না চাপালেও আয় বাড়াতে অর্থমন্ত্রী নানান দিকে হাত দিয়েছেন। অনলাইনে-ফেসবুকে কেনাবেচার জন্য এখন কর দিতে হবে। ফেসবুক, ইউটিউব, গুগলকেও করের আওতায় আনার পরিকল্পনা আছে অর্থমন্ত্রীর। কর বসছে উবার, পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ার উদ্যোগে। এভাবে বিন্দু বিন্দু জল দিয়েই সিন্দু গড়তে চান ৮৫ বছর বয়সী অর্থমন্ত্রী।

এক বোকা রিকশাওয়ালার গল্প দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম। শেষ করছি বোকা সাংবাদিকের প্রশ্ন দিয়ে। নির্বাচনের বছরে যদি এমন জনতুষ্টির বাজেট দেয়া যায়, অন্য বছরগুলোতে যায় না কেন? অর্থমন্ত্রী প্রতিটি বছরকেই নির্বাচনি বছর ভাবলেই তো হয়। নির্বাচনের বছর যাদের তুষ্ট করতে চান, সেই জনগণ তো এই দেশেরই, অন্য বছরগুলোতেও তাদের মন তুষ্ট রাখলে তো ক্ষতি নেই।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ