X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের কাছে বিএনপির অসহায় আত্মসমর্পণ

স্বদেশ রায়
১০ জুন ২০১৮, ১৩:২০আপডেট : ১০ জুন ২০১৮, ১৩:২১

স্বদেশ রায় ফরাসি কূটনীতিক ফেব্রিসি ইটেনা রেঙ্গুন (বর্তমানের ইয়াঙ্গুন) ও কলকাতার তুলনা করে লিখতে গিয়ে লিখেছেন– দুটো শহর ব্রিটিশদের তৈরি হলেও রেঙ্গুন ব্রিটেনের সব ঐতিহ্য ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। অন্যদিকে, কলকাতা এখনও বড় অংশই ধারণ করে আছে। শুধু কলকাতা নয়, গোটা ভারতই এখন উনবিংশ শতকের একক সুপার পাওয়ার ব্রিটেনের অনেক রীতিনীতিই বহাল রেখেছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ, ১৯ শতকে ব্রিটেন শুধু অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে সুপার পাওয়ার ছিল না, প্রজ্ঞায়ও তারা সুপার পাওয়ার ছিল– যা এখনও অনেকখানি বর্তমান। তাই ব্রিটেনের অনেক আগে ছেড়ে আসা কলোনি, বিংশ শতাব্দীর সুপার পাওয়ার আমেরিকার প্রজ্ঞায়ও ব্রিটেনের প্রভাব বর্তমান। এ কারণে দেখা যায়, ব্রিটেন, আমেরিকা ও ভারতের মিডিয়া সম্পূর্ণ স্বাধীন হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার শতভাগ সাংবাদিকতা বজায় রেখেও সরকারকে সমর্থন করে যায়। যেমন বিবিসি এখনও পৃথিবীর সঠিক সাংবাদিকতার মডেল, তারপরেও বিবিসি সবসময়ই ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। ভারতও এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। ভারতের মিডিয়া স্বাধীন, তারা সরকারের সব ধরনের ভুলের সমালোচনা করে, তবে যেমন কখনোই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে না, তেমনি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে থাকে। ব্রিটেনের মতো ভারতও পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করে দেশের স্বার্থে, কোনও দলের স্বার্থে নয়। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে খুব একটা বিরোধ নেই। তাদের বিরোধ সবসময় লক্ষ্য করা যায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ডেমোগ্রাফি সংক্রান্ত কর্মসূচি নিয়ে। এ কারণে দেখা যায়, মাঝে মাঝে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থে খুবই চমৎকারভাবে সাংবাদিকতা বজায় রেখে বিবিসি বা ব্রিটেনের মিডিয়ার অন্যান্য অংশ কিছু নিউজ করে, ভারতের মিডিয়াও একই কাজ করে।

গত চার বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপির নেতারা খুব ঘন ঘন দিল্লি যাতায়াত করছেন। তাদের একটা ধারণা হয়েছে দিল্লি আওয়ামী লীগ বা চৌদ্দদলীয় জোটকে ক্ষমতায় এনেছে ও আবার আনবে। তারা একটা সত্য বুঝতে পারছে না শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কাছে তারা পরাজিত হচ্ছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে রেসে নামতে পারে এমন নেতৃত্ব বিএনপির নেই। এর বদলে তারা মনে করছে ভারতই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখছে। তাই তাদের অনেক নেতাই মাঝে মাঝে অসুস্থ হন– না হয় আজমীর পরিদর্শনের জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন; আর সে কারণে দিল্লি যান। গত চার বছরে দিল্লি গিয়েছি খুবই কম। তবে যে ক’বার গেছি, গিয়ে কারও না কারও সঙ্গে দেখা হলে শুনতে হয়েছে, এই তো গতকাল বা গত পরশু বিএনপির পক্ষ হয়ে অমুক আমার কাছে এসেছিলেন। বারবার বললেন, আমাদের একটাবার চান্স দেন না? দেখুন না আমরা হাসিনার থেকে আপনাদের কত বেশি দিতে পারি। তারপরে একটু মুচকি হেসেছেন। দিল্লির মিডিয়া সেন্টারে আড্ডা দিতে দিতেও শুনেছি এই মুহূর্তে বিএনপির পক্ষ হয়ে অমুক অমুক দিল্লিতে আছেন। কোনও না কোনও প্রতিষ্ঠানে কথা বলতে গিয়ে শুনেছি, অমুক সম্পাদক এসেছিলেন, তিনি তো বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপির অপরিহার্যতা তুলে ধরলেন। তিনি যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে কথা বলেছেন। অর্থাৎ দিল্লির রাজনীতিক, সাংবাদিক থেকে নীতিনির্ধারকের কাছে বিএনপি নেতাদের এবং তাদের পক্ষ হয়ে অন্যদের এই যাতায়াতটা সেখানে ওপেন সিক্রেট। অথচ এ নিয়ে দিল্লির কোনও সাংবাদিককে নিউজ করার ব্যাপারে আগ্রহী মনে হয়নি কখনও। তাদের এই আগ্রহী না হওয়ার বিষয়টি জানি বা কিছুটা হলেও বুঝি বলে কখনও তাদের কাছে কোনও প্রশ্ন করেনি। কারণ, যতক্ষণ না ভারতের ফরেন মিনিস্ট্রি বা তাদের নীতিনির্ধারকরা মনে করবেন এটা নিউজ হওয়া প্রয়োজন, তার আগে কখনই তারা এ বিষয়ে কোনও নিউজ করবেন না। তারা তাদের ফরেন পলিসির স্বার্থকেই আগে গুরুত্ব দেবেন।

ভারতের দ্য হিন্দু আমার অন্যতম প্রিয় পত্রিকা। আমার কাছে পত্রিকাটিকে ভারতের গার্ডিয়ান বলেই মনে হয়। নীতির দিক থেকে গার্ডিয়ানের সঙ্গে দ্য হিন্দুর অনেক মিল। যাহোক, ৯ জুন দ্য হিন্দুতে আব্দুল আউয়াল মিন্টু, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও হুমায়ুন কবিরের ছবিসহ একটি নিউজ দেখলাম। যার শিরোনামের বাংলা এমনই, ‘বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে ভারতের সাহায্য চায় বিএনপি’। ভারতের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস এই সংবাদপত্রটিতে এ নিউজটি দেখেই বুঝলাম, ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখন মনে করছেন, বিএনপির দিল্লিতে দৌড়ঝাঁপটি পাবলিক করে দেওয়া দরকার। তাই কাজটি ঘটলো।  ছোট নিউজ। চোখ বুলিয়েই দেখলাম, নিউজটি ওয়েল ব্রিফড। সংক্ষিপ্ত নিউজের তিনটি ভাগ। প্রথম ভাগের বক্তব্য, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বক্তব্য কোট করে। ওই অংশে তার বক্তব্য’র মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে, বিএনপি কোনোরূপ শর্ত ছাড়া ভারতের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে চাচ্ছে। বলতে চাচ্ছে, তারা ভারতকে অনেক কিছু দিতে পারবে। ভারত যেন বাংলাদেশের নির্বাচনে ভূমিকা রাখে। এখানে একটুখানি উল্লেখ করা দরকার, এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, আমি ভারতকে যা দিয়েছি, তা ভারতকে মনে রাখতে হবে। তার বদলে আমি কিছুই চাই না। ভারতকে শেখ হাসিনা কী দিয়েছেন, তাও এই সংক্ষিপ্ত নিউজের দ্বিতীয় ভাগে আছে। সেখানে বলা হয়েছে ১৯৯১- ৯৬ ও ২০০১ - ২০০৬ অবধি বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন বাংলাদেশ যে জঙ্গির অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছিল এবং ভারতের বিচ্ছিন্নবাদীরা এখানে অবাধে তাদের কাজ চালাতো, তা নির্মূল করেছেন শেখ হাসিনা। তাদের অনেক বড় বড় চাঁইকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন। আর শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত। যার শুরু ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা তার স্বামী জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই বাংলাদেশ মৌলবাদের ধারায় চলে যায় এবং প্রো-পাকিস্তানিরা এখানে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে।

নিউজের তৃতীয় বা শেষ ভাগে এসে তারা চমৎকারভাবে তারেক রহমানের উপদেষ্টা হুমায়ুন কবিরের বক্তব্য কোট করেছেন, যার মূল অর্থ এমন, বিএনপির জোটকে নিয়ে ইনক্লুসিভ ইলেকশনে না গেলে বাংলাদেশে আন্ডার গ্রাউন্ড জঙ্গি গ্রুপ গড়ে উঠবে। যার ভেতর দিয়ে প্রকাশ হয়, জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে মৌলবাদ শুরু হয়, খালেদার হাত দিয়ে যারা জঙ্গিতে পরিণত হয়, তারা এখন তারেকের নিয়ন্ত্রণে। কারণ, বিএনপি জোটকে নিয়ে নির্বাচনে না গেলে তারা যে জঙ্গি কার্যক্রম করবে সেটা বলছেন তারেকের উপদেষ্টা। রিপোর্টার কিন্তু রিপোর্টের মধ্যভাগে বলেছেন, শেখ হাসিনা জঙ্গিদের কার্যক্রম শেষ করে দিয়েছেন। অথচ তারেক রহমানের উপদেষ্টা বলছেন, তারা নির্বাচনে না গেলে জঙ্গি শক্তিগুলোকে ফুয়েল দেওয়া হবে। এর ভেতর দিয়ে তারেক ও জঙ্গির ফুয়েল যে এক সূত্রে গাঁথা তা লাইন বিটউন কারো বুঝতে অসুবিধার নয়।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ডিসেম্বর মাসে। নির্বাচনের পাঁচ মাস আগেই ভারতের নীতিনির্ধারকরা মনে করেছেন, এখন বিএনপির এই দৌড়ঝাঁপটি ফাঁস করে দেওয়া উচিত। এর ভেতর দিয়ে দুটো লাভ হবে– এক. আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি তাদের চিরাচরিত ভারতবিরোধিতা করা নিয়ে একটি বড় প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে? দুই. ওয়েল ব্রিফড এই নিউজটির মাধ্যমে বলে দেওয়া হলো, তারেক রহমান বাংলাদেশের জঙ্গি নিয়ন্ত্রক। অর্থাৎ তিনিই ভারতের জন্যে সবচেয়ে বড় হুমকি। মনে হয় এটাই বিএনপি’র জন্যে যথেষ্ট উত্তর। অন্যদিকে নিউজে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা জঙ্গি জামানার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। আর ভারত চায় তাদের ইন্টারনাল সিকিউরিটি। এটাই তাদের বড় ইন্টারেস্ট। এজন্য তাদের দরকার সৎ প্রতিবেশী। পাশাপাশি নিউজটির লাইন বিটিউন অনেক জায়গার অর্থ করলে দেখা যাবে বিএনপির অসহায় আত্মসমর্পণ। কারণ, আমির খসরু মাহমুদ বলছেন, ভারত ভূমিকা রাখতে পারে বাংলাদেশের নির্বাচনে। অন্য একটি দেশ কীভাবে এসে ভূমিকা রাখবে? এটা কোন ধরনের আমন্ত্রণ, না বাস্তবে এটা অসহায় আত্মসমর্পণ?

লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত   

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
ঝুঁকি নিয়ে পজিশন বদলে সব আলো কেড়ে নিলেন রাফায়েল
ঝুঁকি নিয়ে পজিশন বদলে সব আলো কেড়ে নিলেন রাফায়েল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ