X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

কিশোর-তরুণদের সামনে ভয়ঙ্কর হাতছানি

লীনা পারভীন
০৪ জুলাই ২০১৮, ১৬:৫১আপডেট : ০৪ জুলাই ২০১৮, ১৬:৫৪

লীনা পারভীন ‘হিরোইজম দেখাতে গিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে চট্টগ্রামের কিশোররা’—এই শিরোনামের একটি সংবাদ দেখে দু’টি কিশোরের মা হিসেবে আমি আঁতকে উঠেছি। একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত এই সংবাদের বিস্তারিত পড়তে গিয়ে পেয়েছি আতঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্যও।
চট্টগ্রাম নগরীতে সম্প্রতি নিজ বাসায় খুন হয়েছেন এক ব্যাংক কর্মকর্তা। সেই হত্যাকাণ্ড তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায় খুন হওয়া সজল নন্দীর স্কুলপড়ুয়া ছেলের বন্ধুসহ তিন কিশোর এ ঘটনায় জড়িত। মূলত সাইকেল কেনাবেচার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে এই হত্যাকাণ্ড। গত কয়েক মাসে চট্টগ্রামে এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। যেগুলোর প্রায় প্রত্যেকটির সঙ্গে কিশোর অপরাধীরা জড়িত। পুলিশ কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকের সঙ্গে জড়িত কিশোরেরা মাদক সেবনের টাকা জোগাড় বা হিরোইজম দেখাতে গিয়েই এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
গত মাসে কর্ণফুলী নদীর ঘাট এলাকা থেকে স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় আসামিদের শনাক্ত করা না গেলেও দায়ের করা মামলায় আটক দুই জনও কিশোর। 

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর মোট ৬০ শতাংশ মানুষের বয়স ৪০ এর নিচে, যার মধ্যে প্রায় ৪ কোটি ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী। এটি যেমন আমাদের দেশের জন্য প্রচণ্ড এক সম্ভাবনাকে জানান দিচ্ছে, তেমনি জন্ম দিচ্ছে এক আতঙ্কিত ভবিষ্যতেরও। তরুণ সমাজ স্বাভাবিকভাবেই ফ্যান্টাসিতে আকৃষ্ট হয়।  চ্যালেঞ্জিং কাজের প্রতি সহজেই ঝুঁকে পড়ে। তাদের বয়সটাই এমন যে, স্থির বসে থেকে কোনও কাজে মনোযোগ স্থাপন করা একপ্রকার অস্বাভাবিক। এই বয়সটাকে যদি সঠিকভাবে গাইড করা না যায়, তাহলেই নেমে আসে এক বিপর্যয়।  চট্টগ্রামের ঘটনাগুলো আমাদের সেদিকেই আঙুল দেখাচ্ছে।

কিশোর বয়সে একজন মানুষ অনুকরণপ্রিয় হয়। তারা চায় অন্যকে অনুসরণ করতে। কিন্তু তাদের সামনে কি আছে তেমন কোনও অনুকরণীয় চরিত্র বা আদর্শ? নেই সমাজভিত্তিক কোনও সংগঠন, যেখানে ছেলেমেয়েরা শিখবে কেমন করে একজন আদর্শ ও অনুকরণীয় চরিত্র গড়ে তোলা যায়। এই শূন্যতা দখল করে নিচ্ছে একদল বখে যাওয়া তরুণ, যারা নিজের স্বার্থে জড়িয়ে পড়ছে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে। খুব সহজেই হাতিয়ার হয়ে পড়ছে আদর্শহীন রাজনীতির। নিজে জড়িয়ে পড়ছে এবং অন্য তরুণদেরও টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই মরণ রাস্তায়। ফ্যান্টাসির মজা নিতে চায় মাদকের রাস্তায়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এলাকা এমনিতেই মাদকের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র হিসেবে ইতিমধ্যেই পরিচিত। সম্প্রতি সরকারের মাদকবিরোধী অভিযানেও পাওয়া যাচ্ছে এর প্রমাণ। কক্সবাজার টেকনাফের বেশিরভাগ এলাকায় প্রধান ব্যবসা বলতে বোঝায় মাদকের ব্যবসাকে।  এ যেন এক প্রকার স্বীকৃত আয়ের উৎস হিসেবেই পরিচিত। একই পরিবারের বড় থেকে ছোট সবাই জড়িত এই মাদক ব্যবসায়।

৪ কোটি জনগোষ্ঠীর সামনে ভবিষ্যৎ কী? কেউ কি পরিষ্কার জানে? আদৌ কি তারা ভাবতে পারছে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে? পরিসংখ্যানে জানা যায়, ৪ কোটির প্রায় ৭০ শতাংশ পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে কিন্তু তাদের জন্য এই রাষ্ট্র বা সমাজ কোনও সঠিক রাস্তা গড়ে দিতে পারছে না। পড়াশোনা করেই বা কী হবে? তারা কী হতে চায় জীবনে? কারও সামনেই নেই কোনও সঠিক লক্ষ্য বা আদর্শ। জীবনের লক্ষ্য বা আদর্শহীন একজন নাগরিক কখনোই কোনও রাষ্টের জন্য সম্পদ হিসাবে গণ্য হতে পারে না। পড়াশোনার সুযোগের বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর তো আরও খারাপ অবস্থা।

বাংলাদেশ বর্তমানে মধ্য আয়ের দেশের রাস্তায় অবস্থান করছে। এমডিজি অর্জন করে এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জয়ের পেছনেও কাজ করেছে এই বিরাট তরুণ জনগোষ্ঠী। দেশে এখন কর্মসংস্থানের সংখ্যা আশঙ্কাজনক অবস্থায় কম। সরকারি চাকরি নিয়ে তরুণ সমাজের মধ্যে রয়েছে এক ধরনের মাদকতা। কিন্তু সেই সরকারি চাকরি কি চাইলেই সবাই পেতে পারে? বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগের অবস্থাও আশাব্যঞ্জক নয়। ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে রয়েছে মারাত্মক হতাশাজনক চিত্র।

ইতোমধ্যেই পাস হয়েছে বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসের দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় অবস্থানকারী সরকারের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট। আমরা সবাই জানি স্বাধীনতার পর বাজেটের পরিমাণ ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা মাত্র, আর এখন আমাদের বাজেটের আয়তন বেড়েছে কয়েকগুণ। বাজেটের একটা বড় অংশ থাকে আমাদের নিজস্ব আয়ের ওপর ভিত্তি করে যেখানে আগে সিংহভাগই হতো বিদেশি সাহায্যের হিসাব। আত্মনির্ভরশীল হয়ে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়াতে শেখা এই জাতির জন্য তাই এখনই সময় সমাজে একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ গড়ে তোলা। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি পরিকল্পিত বাজেট ঘোষণা করা। প্রয়োজন পরিকল্পিতভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, যেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ে এবং সরকারি চাকরির ওপর নির্ভরশীলতা কমতে থাকে। 

সরকার যেভাবে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সেই অভিযানকে সঠিক ও সঠিক পথে চালিয়ে যাওয়া। আমাদের তরুণ কিশোরদের মাদকের হাতছানি থেকে রক্ষার এটাই একমাত্র উপায়। মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য এর উৎসপথ বন্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। মাদকের মরণনেশা সম্পর্কে দেশের সর্বত্র চালাতে হবে সচেতনমূলক কর্মসূচি। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে কিশোর তরুণদের। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সবাইকে যুক্ত করতে হবে সচেতনভাবেই। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিকতাকেও জাগিয়ে তুলতে হবে।  মাদকের বিরুদ্ধে আইন কঠোর করে এর সঠিক ও কঠোর বাস্তবায়নের দিকে দিতে হবে আন্তরিক ও কঠোর নজর। আইন-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে সরকারকে অত্যন্ত সচেতনভাবে সেগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে, যেন করে সবকিছুই আইনের রাস্তাতেই হয়। প্রতিটা মানুষের যেমন ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে, তেমনি অন্যায়ভাবে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতেও রাষ্ট্রকেই ভূমিকা রাখতে হবে।

কিশোর-যুবকদের সামনে অনুকরণীয় চরিত্রগুলোকে আলোকিত করার দায় আমাদের সবার। পরিবার থেকেই শিক্ষা শুরু হতে হয়। আমাদের পারিবারিক পরিবেশগুলো এখন পুরো মাত্রায় এককেন্দ্রিক। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও নেই যোগাযোগ।  সন্তানেরা বড় হয়েই দেখছে বাবা-মা ছাড়া আর কেউ নেই তাদের চারপাশে। বাবা-মায়েরাও এই বিষয় নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা দেখান না। সন্তান গ্যাজেটে আসক্তি নিয়ে পড়ে থাকে এক রুমে আর বাবা-মা থাকেন আরেক রুমে। দিনের মধ্যে কয়টা কথা হয়, সেটাও গোনা যায় আজকাল।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দেশের মাঝে একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার প্রভাব। রাজনীতির কালো ছোবল আমাদের তরুণদের অনেকের প্রাণশক্তি খেয়ে ফেলছে। ‘বড় ভাই’ কালচারে আসক্তি একজন তরুণকে সাময়িক ক্ষমতার জালে বেঁধে ফেলছে। অস্ত্রের গরমে নিজেকে সে সিনেমার হিরো ভাবা শুরু করে দেয়। এই অস্ত্রেই একদিন তার নিজের বা আপন কারও জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এটি একটি চক্র। এই চক্র থেকে আমাদের তরুণদের রক্ষার জন্য পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র সবাইকেই সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ