X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ও ডাক্তার…

হারুন উর রশীদ
১০ জুলাই ২০১৮, ১৭:৩৩আপডেট : ১০ জুলাই ২০১৮, ১৭:৪০

হারুন উর রশীদ শৈশবের আমজাদ চাচাকে আমার এখনও মনে আছে। ডা. আমজাদ হোসেন, এমবিবিএস। বাবার হাত ধরে তার প্রাইভেট চেম্বারে যেতাম। যত রোগই হোক না কেন, আমজাদ চাচাকে দেখলেই যেন ভালো হয়ে যেত। তিনি ওষুধের পরিবর্তে গল্পই বেশি করতেন। ওষুধ যে দিতেন না তা নয়। তবে সেটার চেয়ে তিনি মানসিকভাবে আমাকে চাঙ্গা করে দিতেন বেশি। ওষুধটা হতো উপলক্ষ মাত্র। সেই আমজাদ চাচা একসময় বদলি হয়ে স্বরূপকাঠি চলে যান। বানারীপাড়ার অনেককেই দেখেছি লাইন ধরে তাকে দেখানোর জন্য স্বরূপকাঠি যেতে।
আমার বাবা আলসারের রোগী ছিলেন। একবার গভীর রাতে এমন ব্যথা উঠল, আমাদের মনে হলো বাবা হয়তো মরেই যাবেন। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। রাত তিনটার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখি ডাক্তার নেই। পাশেই তাদের আবাসিক ভবনে গিয়ে একজন ডাক্তারকে রীতিমত চিৎকার চেঁচামেচি করে ঘুম থেকে তুলি। তিনি কোনও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ব্যাগ নিয়ে হেঁটেই আমাদের বাসায় গেলেন। পথে তার হাত থেকে ব্যাগটি আমার হাতে নিই। তিনি মুচকি হাসেন। এরপর বাবাকে দেখে আমাদের অভয় দিয়ে বাসায় ফেরেন। আমি তাকে পৌঁছে দিই। বাসার সামনে গিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আমিও সরি বলি।

আমার বাবা বেঁচে নেই। বাবা যখন মারা যান তখন আমি ঢাকায়। রাত ১২টার পর বাসা থেকে মা ফোন করেন। কান্না আর কষ্ট মিলিয়ে শুধু বললেন, ‘তোর বাবা স্ট্রোক করেছে।’ তারপর তাঁকে মঠবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। ডাক্তার নেই। আছেন নার্স। আমি ফোনে এই কথা শুনে অসহায় বোধ করি। ফোন করি লিটু ভাইকে (ডা. মনিলাল আইচ লিটু)। তিনি আমাকে তুই বলেই ডাকেন। বললেন, ভয় পাসনে। নার্সকে আমাকে ফোনে ধরিয়ে দিতে বল। লিটু ভাইকে ফোনে ধরিয়ে দেওয়া হলো। তিনি তার সাধ্যমত চেষ্টা করলেন নার্সকে নানা পরামর্শ দিয়ে। আমার বাবাকে বাঁচানো যায়নি। কিন্তু একজন চিকিৎসক হিসেবে সাধ্যের সবটুকু করেছেন লিটু ভাই। লিটু ভাই আমার মায়ের কানের চিকিৎসাও করেন। মা একবার কানের অপারেশন করাতে কোনোভাবেই রাজি নন। কিন্তু লিটু ভাই কী এক জাদুমন্ত্রে আমাদের অবাক করে দিয়ে মাকে অপারেশনে রাজি করিয়ে ফেললেন।

ঢাকায় সাংবাদিকতা পেশা শুরুর পর অনেক চিকিৎসকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে টুটুল ভাই’র ( ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার) সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া আমাদের পরিবারের কেউ অন্য ডাক্তারের কাছে যায় না। টুটুল ভাই আমার ডাক্তার, আমার বউয়ের ডাক্তার, আমার ছেলেমেয়েদের ডাক্তার। আমাদের কারো কোনও অসুখ হলে আমার বউ প্রথমেই বলবেন,‘ আগে টুটুল ভাইকে ফোন করো’।

অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলামের কাছে আমার কোনও রোগের চিকিৎসা করাতে হয়নি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের এই চিকিৎসকের কাছ থেকে অনেক শিখেছি। তিনি মনোরোগের ব্যাখ্যা দেন সাবলীলভাবে। অনেক জটিল বিষয় সহজ করে বলেন। আমার সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। আর অনেক রোগীকে পাঠিয়েছি তার কাছে। কেউ অতৃপ্ত হননি।

ডা. জাকারিয়া স্বপন স্যারের কথা মনে পড়ে। তিনি এখন বেঁচে নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ছিলেন। নিজেই ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস করতেন। তাই শেষ সময়ে আর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারতেন না। কিন্তু পুরনো রোগীদের ফেরাতেন না। তার অফিসেই দেখতেন। আমি পুরনো রোগী হিসেবে তার অফিসে যতবার গিয়েছি, একবারও ভিজিট নেননি। তার কথা, ‘হাসপাতালে বসে আমি তো ভিজিট নিতে পারি না। ’

তাহলে কথা কেন?

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় চিকিৎসকরা এমনই।  আর এই অভিজ্ঞতার উদাহরণ আরও বাড়াতে পারি। কিন্তু সবার অভিজ্ঞতা আমার মতো নয় বলেই মনে হয়। যদি তাই হতো তাহলে এত কথা আর এত অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ শুনতে হতো না।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে আমার সাংবাদিকতা জীবনে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে অনেক প্রতিবেদন করেছি। সেখানে আমার উপলব্ধি শুধু দোষারোপের নয়। প্রতিকার পাওয়ার, ব্যবস্থা নেওয়ার অভিজ্ঞতাও অনেক। এমনকি এইচএসসিতে আমার সহপাঠী, যিনি পরে চিকিৎসক হয়েছেন, তিনিও আমার প্রতিবেদনের কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার শিকার হয়েছেন। আর ওই সব প্রতিবেদনে সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী আমার কোনও কথা ছিল না। সেখানে চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ, ভুক্তভোগী, ডকুমেন্ট কথা বলেছে।

চট্টগ্রামে শিশু রাইফার মৃত্যু নিয়ে এখন সারা দেশেই আলোচনা। দুটি কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। আর এই তদন্তে চিকিৎসায় অবহেলার কথা বলা হয়েছে।  বলা হয়েছে তিনজন চিকিৎসকের কথা।  যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। আমার মনে হয়েছে চট্টগ্রামে সাংবাদিকরা শিশু রাইফার মৃত্যু নিয়ে গোড়া থেকেই সঠিক পথে এগিয়েছে। তারা প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু প্রতিবাদের প্রক্রিয়ায় কোনও আইন লঙ্ঘনের পথে যাননি। মাঠে নেমেছেন, কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। আর তারা তদন্তে আস্থা রেখেছেন। এখন সেই তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন চাচ্ছেন।  রাইফা সাংবাদিক রুবেল খানের কন্যা বলেই হয়তো সাংবাদিকরা মাঠে নেমে প্রতিবাদ করেছেন।  এই কমিউনিটি ফিলিংয়ের মধ্যে কোনও দোষ আমি দেখি না। আমি দেখি বন্ধুর বিপদে বন্ধুর পাশে দাঁড়ানোকে।

যে দুটি তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছেন তাতে কিন্তু চিকিৎসকরা ছিলেন। তার মানে হলো গ্রহণযোগ্য তদন্ত প্রতিবেদন কিন্তু আমরা চিকিৎসদের কাছ থেকেই পেয়েছি। তাহলে ভরসা রাখা যায়। আস্থার জায়গা শেষ হয়ে যায়নি। আমার অভিজ্ঞাতার চিকিৎসকরা শুধু আমার কাছেই ধরা দেননি। আরও অনেক চিকিৎসক আছেন, যাদের কাছ থেকে হয়তো অনেকেই ইতিবাচক অভিজ্ঞতা পেয়েছেন।

এক তরুণ চিকিৎসকের ফেসবুক পোস্ট:

একজন তরুণ চিকিৎসক তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘একজন চিকিৎসক সজ্ঞানে  কোনও রোগীকে মেরে ফেলতে পারেন না। একথা আকাশের সূর্যের মতোই সত্য ও অকাট্য।’  আমার মনে হয় আলোচনার বিষয় এটা নয়। মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায় চিকিৎসা সেবা নিতে। তারা যদি রোগীকে সজ্ঞানে  মেরেই ফেলতেন তাহলে তো তাদের কাছে কেউ বাঁচার জন্য যেতেন না। হাইকোর্ট খুব সঠিকভাবে বলেছেন, ‘মানুষ বিপদে পড়লে তিন পেশার লোকের কাছে যায়- পুলিশ, আইনজীবী এবং ডাক্তার। তিনটি পেশা যদি কিছু কিছু দুর্বৃত্তের কারণে ধ্বংস হয়, তবে মানুষ বিপদে পড়বে। মেয়েটাকে (চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রাফিদা খান রাইফার মৃত্যু) তো ফিরিয়ে আনা যাবে না। ডাক্তাররা দেবতা নন। আমাদের (মানুষের) ভুল হবে বলে আমাদের একটা উচ্চ আদালত রয়েছে। ভুলটা অন্যায় নয়। কিন্তু ভুলটা জাস্টিফাই (যথাযথ) করার জন্য যদি হরতাল (ধর্মঘট) ডাকা হয়, তবে তা অন্যায়। কতিপয় দুর্বৃত্তের কর্মকাণ্ডের কারণে চিকিৎসাসেবার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। ভুল চিকিৎসার ভয়ে রোগীরা পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাচ্ছে।’

আদালতের এই অবজারভেশনের বিপরীতে এখনও কোনও চিকিৎসককে বলতে শুনিনি, ‘বিচারক কীভাবে ভুল চিকিৎসার কথা বললেন, তিনি কি ডাক্তার? তিনি কীভাবে বুঝলেন?’ কিন্তু চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠলেও সাধারণভাবে কিছু চিকিৎসক এই প্রশ্নটি তোলেন। তারা বলেন, চিকিৎসার মতো একটি টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষ কী বুঝবে? তারা কীভাবে বুঝবে অবহেলা বা ভুল চিকিৎসা। আর তাদের এই কথা মেনে নিলে তো কোনও অভিযোগই করা যাবে না। আমলে নেওয়া তো আরও পরের কথা।

আমার মনে হয় সমস্যা এখান থেকেই শুরু। চিকিৎসা একটি সেবা। আর এই সেবা পেতে মানুষ চিকিৎসকের কাছে যান। হাসপাতাল, ক্লিনিকে যান। সেবা বিষয়টি কখনও একপাক্ষিক সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর করে না। তাই, যদি সেবাপ্রার্থী অসন্তুষ্ট হন তাকে অভিযোগ করার সুযোগ দিতে হবে। সুযোগ দিতে হবে প্রশ্ন তোলার। আর সেটার একটা স্বীকৃত নীতি থাকা প্রয়োজন। সেটার জন্য আইন থাকা প্রয়োজন, একটি জায়গা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে(বিএমডিসি) অভিযোগ করার সুযোগ আছে। কিন্তু ক’জন মানুষ তা জানেন। আর এ পর্যন্ত যত অভিযোগ পড়েছে তার কতটি নিষ্পত্তি হয়েছে? বিএমডিসি নাকি এ পর্যন্ত একটি ঘটনায়ও চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার প্রমাণ পায়নি। তারা ভুয়া চিকিৎসকদের ব্যাপারে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। তাই আমার প্রস্তাব একটি স্বাধীন সংস্থা বা কমিশন গঠন করা। যেখানে চিকিৎসকদের সঙ্গে অন্য পেশা বা শ্রেণির মানুষও থাকবেন।  নিরপেক্ষ তদন্তের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। চিকিৎসাসেবা নিয়ে বিক্ষুব্ধ কেউ স্বাধীনভাবে যেন সেখানে অভিযোগ করতে পারেন। দ্রুত প্রতিকার পেতে পারেন। অভিযোগকে নিরুৎসাহিত বা বন্ধ করে দেওয়া কোনও যৌক্তিক কাজ হতে পারে না।

ভুলও প্রমাণ করতে হয়:

পেশাজীবীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সরল বিশ্বাসে ভুল হতেই পারে।  কিন্তু সেটা যে ভুল তা তো প্রমাণ করতে হবে। আর সেজন্যই প্রয়োজন ভুল প্রমাণের আইনি প্রক্রিয়া। একজন ভুল করলেও সেটা আরেকজন ভুল হিসেবে মানতে রাজি নাও হতে পারেন। এসব নিয়ে আইন ও যথাযথ তদন্ত ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতি দিনের পর দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। একপক্ষ ভাঙচুর করছে, চিকিৎসকের ওপর হামলা করছে। আর আরেকপক্ষ ধর্মঘট করছে, চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দিচ্ছে। দুটোই অন্যায়, বেআইনি।

কারও বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। আর আইনে যদি থাকে তাহলে গ্রেফতার করা যাবে না- এটা কোনও দাবি হতে পারে না। এই দাবি আদায়ের জন্য রোগীদের জিম্মি করা যদি অন্যায় না হয় তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কোনও চালককে আটক করা হলে তারা যে সারা দেশে যানবাহন বন্ধ করে দেন, তাও  অন্যায় হবে না। কিন্তু আমরা তো তাদের সমালোচনা করি। বলি, পরিবহন শ্রমিকরা যাত্রীদের জিম্মি করছে। পরিবহন শ্রমিক, সুনির্দিষ্টভাবে বললে পরিবহন চালকরাও কিন্তু দাবি করেন তারা ইচ্ছা করে কোনও দুর্ঘটনা ঘটান না। যাত্রীদের নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য। তাহলে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে চালককে কেন মামলার শিকার হতে হবে? আর আমার একটি প্রশ্ন- আমরা যে দুর্ঘটনা ঘটলে চালককে শুরুতেই দায়ী করে ফেলি, আমরা মোটর ভেহিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার? চিকিৎসক না হলে যদি চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ না করা যায়, তাহলে মোটর ভেহিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার না হলে তো চালকের অবহেলা বা অদক্ষতা নিয়ে অভিযোগ করা যাবে না।

বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিনই প্রতিবেদন হয়। আর এসব প্রতিবেদন নিয়েও কথা ওঠে। সাংবাদিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়, এমন প্রতিবেদন অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। আর সাংবাদিকের কাজ কখনো কোনও পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া নয়। কোনও কোনও চিকিৎসক মনে করেন, ‘অপসাংবাদিকতা চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে দূরত্ব বাড়াচ্ছে। তারা এখন বিচারকদেরও ভুল বোঝাচ্ছেন।’ এটা যদি হয়ে থাকে তাহলে তা খুবই দুঃখজনক। তবে পাবলিক পারসেপশন বলে একটা কথা আছে। এটা খুবই জরুরি। আর এই পারসেপশন একদিনে হয় না। বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা নিয়ে পাবলিক পারসেপশন সম্পর্কে চিকিৎসকরা সচেতন হলে ভালো হয়। বিষয়টি সাংবাদিকদের জন্যও প্রযোজ্য।

চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা:

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানের ওপর সর্বশেষ র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম। সার্কভুক্ত দেশগুলোর ভেতরে বাংলাদেশের ওপরে কেবল রয়েছে শ্রীলঙ্কা। তাদের অবস্থান ৭৬তম।  ভারত ১১২ এবং পাকিস্তান রয়েছে ১২২তম অবস্থানে। ভুটান ১২৪, মালদ্বীপ ১৪৭, নেপাল ১৫০ এবং সবচেয়ে পিছনে রয়েছে আফগানিস্তান, ১৭৩তম অবস্থানে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভারতের চেয়ে যে ভালো তা র‌্যাংকিংয়ে স্পষ্ট।  তারপরও মানুষ চিকিৎসার জন্য কেন ভারত যায়? এই প্রশ্নে অনেক ধরনের কারণ বলা যাবে। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে বড় কারণ মনে হয়েছে আস্থার সংকট। আমি চিকিৎসক নই, একজন রোগী হিসেবেই বলছি- শুধু ওষুধে রোগ সারে না। রোগ সারায় ডাক্তার। রোগ সারায় আমার শৈশবের প্রিয় আমজাদ চাচা (ডা. আমজাদ হোসেন, এমবিবিএস)।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ডেন্টাল সার্জন বাদে মোট নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৭৭৬ জন। আর হাসপাতালে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে বেডের সংখ্যা ৯২ হাজার ৮০৪ টি। প্রতি ২ দুই হাজার ৮৯৪ জনের জন্য রেজিস্টার্ড চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন। মোট হাসপাতালের সংখ্যা সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৩ হাজার ৫৭৫টি। এরমধ্যে সরকারি হাসপাতাল মাত্র ৫৯২টি। সরকারি হাসপাতালের মধ্যে উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে আছে ৪৬৭টি। আর ১২৫টি হাসপাতাল বিশেষায়িত এবং জেলা পর্যায়ে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ১ হাজার ৬৯৮ জনের জন্য আছে মাত্র একটি বেড।

আর এতে স্পষ্ট যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার চেয়ে বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো বেশি। এবং বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়বহুল ও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। বেসরকারি খাতে ৫ হাজার ২২০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। এর একাংশ আবার অনুমোদন ছাড়াই হাসপাতালের কার্যক্রমও পরিচালনা করে। আর তাদের সেবার মান নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা সেখানে ঠিকমত সেবা না দিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বেশি আগ্রহী।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র বুঝতে এই পরিসংখ্যান জরুরি। কারণ, আমরা চিকিৎসাসেবা বলতে সাধারণভাবে প্রথমেই চিকিৎসকদের প্রসঙ্গ টেনে আনি। এটা সত্য যে চিকিৎসকই হলেন চিকিৎসা সেবার প্রাণ। কিন্তু অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকলে একা চিকিৎসক আর কতটুকু করতে পারবেন। আর ওইসব সংকট চিকিৎসককে যদি প্রভাবিত করে তাহলে তা তো স্বাভাবিক ধরে নেওয়াই যায়।

এক ভয়াবহ চিত্র:

স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতির চিত্র নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি ২০১৪ সালে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিতে হয়। অ্যাডহক চিকিৎসক নিয়োগে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বলে জানায় টিআইবি।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগনির্ণয় কেন্দ্র ও দালালদের কমিশন ভাগাভাগির সম্পর্ক রয়েছে। চিকিৎসকদের সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশনভিত্তিক চুক্তি থাকে। এ কমিশনের হার নির্ভর করে কোন ডাক্তার কতসংখ্যক রোগী পাঠায় তার ওপর। এ কমিশনের হার ৩০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত হয়। একইভাবে দালালদের কমিশন ১০ থেকে ৩০ ভাগ পর্যন্ত হয়ে থাকে।

টিআইবি’র এই প্রতিবেদন যদি সঠিক ধরে নিই তাহলে এসব তথ্য বাংলাদেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরেকটি ভয়াবহ দিক তুলে ধরে। সেবার চেয়ে এখানে বাণিজ্য প্রধান্য বিস্তার করে। রোগীর সেবার চেয়ে তার কাছ থেকে কত অর্থ আদায় করা যায় তা মুখ্য হয়ে ওঠে। আর এর একটি সামগ্রিক প্রভাব আছে। যার নেতিবাচক প্রভাব চিকিৎসকের ওপর পড়ছে না তা আমরা কীভাবে হলফ করে বলতে পারি।

ও ডাক্তার…

সব পেশারই মানবিক দিক থাকে। মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন কোনও বিষয় নিয়ে কোনও পেশা থাকতে পারে না। তবে সরাসরি মানুষের সঙ্গে কাজ নাও করতে হতে পারে। চিকিৎসকের পেশা পুরোপুরিই মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কের। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতি ও মানবিকতা প্রাধান্য পায় না। এটা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে বড় ধরনের বিচ্যুতি। তাই যন্ত্রের পেছনের মানুষটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  মানুষ যদি মানবিক হয় তাহলে ভালো চিকিৎসক, ভালো প্রকৌশলী, ভালো প্রশাসক বা ভালো সাংবাদিক পাওয়া যাবে। আর এই মানবিকতাও চর্চার বিষয়। আমার প্রিয় ডাক্তার আমজাদ চাচার মধ্যে শৈশবে যা দেখেছি। তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়েও রোগীদের কথা বলতে দেখেছি। তাকে সময় নিয়ে রোগীর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। তার কাছে রোগীরা গিয়ে নির্ভয়ে বলতে পারতেন- ‘ও ডাক্তার’।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ