X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশের সুশীল সমাজের সাতকাহন

আবদুল মান্নান
২৭ জুলাই ২০১৮, ১৫:০২আপডেট : ২৮ জুলাই ২০১৮, ১৭:২৫

আবদুল মান্নান দেশের কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ‘কোটা সংস্কার চাই’ নামে একটি ‘আন্দোলন’ চলছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মাঝে এই বিষয়ে শুরুর দিকে কিছু আগ্রহ থাকলেও এখন আর তেমন একটা নেই। আন্দোলন করতে হলে একটা ব্যানার লাগে। সেটিও আন্দোলনকারীদের আছে। তার নাম ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’। তাদের এই কর্মকাণ্ড বেশ কয়েক মাস ধরেই চলছে। শুরুর দিকে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনেও অগ্নিসংযোগ করেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন মিডিয়ায় বেশ তর্কবিতর্ক হচ্ছে। দু’টি জাতীয় দৈনিক তাদের এই কর্মসূচিতে বেশ জোরালো সমর্থন জোগাচ্ছে। যেহেতু এটি নির্বাচনের বছর সেহেতু সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এই ধরনের অনেক বিষয় নিয়ে আন্দোলনের নামে দেশকে অস্থিতিশীল করার কর্মসূচি হাতে নেবে বিভিন্ন সংগঠন, নামে বা ছদ্মনামে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অনেক সময় নন ইস্যুকে ইস্যু করা হবে। পুরনো ইস্যুকে নতুন লেবাস পরানো হবে। মৃত ইস্যুকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে। চলতি বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংসদে তার দেওয়া বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫ টাকার সিট ভাড়া আর ত্রিশ টাকার খাবার খেয়ে রাস্তায় আন্দোলনের নামে এমন নৈরাজ্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে করেন? সেই কথার সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এক বালিকা বলে, ‘আমরা কারও বাপের টাকায় হলে থাকিও না বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িও না’। সেই বালিকা আবার প্রধানমন্ত্রীকে দেশছাড়া করার হুমকিও দিয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কিছু অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয় ঘটনাও ঘটেছে। কিছু ছাত্র কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে অত্যন্ত অশোভন আচরণও করেছে। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত কয়েকজন ছাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলনবিরোধীদের হাতে লাঞ্ছিতও হয়েছে। এসব কাজের সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আবার মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই ঘটনাগুলো আবারও মনে করিয়ে দিলো, ড. মুনতাসীর মামুনের বিখ্যাত উক্তি—‘বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীন করেছিলেন।’
আজ আমি কোটা বিষয়ে কোনও কিছু লিখতে বসিনি। সেটি নিয়ে হয়তো অন্য আর একসময় লিখবো। কোটা বিষয় নিয়ে কয়েকটি ক্যাম্পাসে কিছু শিক্ষক ও তথাকথিত সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও দু-এক জায়গায় শিক্ষকদের সঙ্গে অশোভন আচরণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলেন, এখন ক্যাম্পাসে যা হচ্ছে, তা আইয়ুব খানের আমলেও হয়নি। তারা কথাটা সত্য বলেননি। সমস্যা হচ্ছে আমাদের সুশীল সমাজের সুধীজনেরা প্রায় নির্বাচিত অথবা খণ্ডিত বিষয় নিয়ে কথা বলেন এবং এই কথাটি বেশি সত্য, যখন তারা আওয়ামী লীগ বা তাদের অঙ্গসংগঠনের কোনও বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেন বা সমালোচনা করেন। অন্য দলের বা তাদের অঙ্গসংগঠনের বিষয় নিয়ে কখনও এই সুশীল নামধারীদের কোনও কথা বলতে তেমন একটা শোনা যায় না। আইয়ুব খানের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ)-এর দখলে। খোকা, পাসপাত্তুর, কেন্তু, আলতাফ, বজলা, জামাল, কামালদের ভয়ে ছাত্ররা নির্ভয়ে ঘুমাতে পারতো না। এরা অন্য আর একজন শিক্ষকের প্ররোচনায় অর্থনীতির খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. আবু মাহমুদকে আক্রমণ করে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠায়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুই-একটি ঘটনাও এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। সিলেটে মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র শিবির ক্যাডাররা দিনের বেলায় মোটরসাইকেলযোগে এসে শহরে একটি জনবহুল এলাকায় তাণ্ডব চালালো। রাজশাহীতে বিএনপি’র জেলা পর্যায়ের এক নেতা শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য নিজেদের মিছিলে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটালো। এই বিষয়ে কোনও সুশীল বা সুজনকে কোনও কথা বলতে শোনা গেলো না।
একটু পেছনে ফিরে যাই। ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত একজন জনপ্রিয় উপাচার্যকে স্বাধীনতাবিরোধী একটি ছাত্রসংগঠন তার বাসভবনে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানি বন্ধ করে, বাসভবনকে সাব-জেল ঘোষণা করে সেখানে তাকে সপরিবারে বন্দি করে রেখেছিল। এরই মধ্যে নির্বাচনে বিজয় লাভ করে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেছেন। খালেদা জিয়ার আমলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি কর্তৃক নির্বাচিত কোনও উপাচার্য স্বপদে বহাল থাকবেন, তা মেনে নেওয়া যায় না। একটিই দাবি, তাকে পদত্যাগ করতে হবে। তিনি কোনও অবস্থাতেই তাদের এমন অন্যায় দাবির প্রতি মাথা নোয়াবেন না। তখন খালেদা জিয়ার শিক্ষামন্ত্রী ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন।  ছাত্র সংগঠনটি তাকে ফুলেল সংবর্ধনা দিলো। তিনি উপাচার্যের বাসভবনে ঢুকে তাকে বললেন, তিনি যেন ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করেন। উপাচার্য তার সিদ্ধান্তে অনড়। সেদিন সংসদে একমাত্র বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ওয়াক আউট করেছিল ঘটনার প্রতিবাদে। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এখন গণতন্ত্র ফেরি করেন। উপাচার্যকে বন্দি করে এই ছাত্রসংগঠনটি বিশ্ববিদ্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখে প্রায় একবছর। ক্লাস অফিস সব বন্ধ। শিক্ষকরা ঠিক করলেন তারা তালা ভেঙে ক্লাসে ফিরে যাবেন। ১৯৯১ সালের ২০ ডিসেম্বর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে ক্লাস নিতে শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে পৌঁছালে অবরোধকারী ছাত্রসংগঠনটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৫০ জন শিক্ষকসহ প্রায় দুইশত শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে আহত হয়। রেলের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর একমাত্র সন্তান ফারুকুজ্জামানকে ইট দিয়ে মাথা থেতলে নির্মমভাবে হত্যা করে এই তস্কররা । কোনও সুশীল আর সুজনকে তখন এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।
১৯৯৪ সাল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক কাজী সালেহউদ্দিনকে সরকার দ্বিতীয়বার উপাচার্যের দায়িত্ব দিলে তার প্রতিপক্ষরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলকে ব্যবহার করে। এই ছাত্রদলের ক্যাডাররাই উপাচার্যপন্থী শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়ে প্রায় কুড়িজন শিক্ষককে আহত করে। ঘটনার প্রতিবাদ করতে পাওয়া গেলো না কোনও সুশীলকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতে ইসলামের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির নিয়মিত বিরতি দিয়ে ছাত্র শিক্ষকের ওপর এই সেদিন পর্যন্ত হামলা করতো। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাটা তারা করে ১৯৯২ সালে। এবার তাদের টার্গেট ছাত্রদল। এই সময় তারা বিভিন্ন ছাত্রাবাস আর ক্যাম্পাসে হামলা চালিয়ে কয়েকশত শিক্ষার্থীকে গুরুতর আহত করে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, তখন খালেদা জিয়া সরকারে। তিনি বা তার মন্ত্রিসভার কোনও সদস্য এই আহত ছাত্রদের দেখতে একবারও হাসপাতালে যাননি। গিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই এই মৌলবাদী ছাত্রসংগঠনটির হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর মোহাম্মাদ ইউনুস, প্রফেসর রেজাউল করিম ও প্রফেসর আবু তাহের। তখন কোনও পেশাদার সুশীল ব্যক্তি বা নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকের প্রতিবাদী কণ্ঠ শোনা যায়নি। অথচ যারা আহত হয়েছেন তারা সবাই তাদের ছাত্র আর যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা তাদের সহকর্মী। তখন সরকারে যদি আওয়ামী লীগ থাকতো, তাহলে এসব সুশীল আর নিপীড়নবিরোধীরা একাট্টা হয়ে রাস্তায় নেমে পড়তো। দিনের পর দিন ক্লাস বর্জনের উৎসব চলতো। ক্ষতি হতো শিক্ষার্থীদের। ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য যে গ্রেনেড হামলা হলো, ২৩ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নিহত হলেন, শেখ হাসিনাসহ অসংখ্য নেতাকর্মী মারাত্মকভাবে আহত হলেন, তখন তো কোনও সুজন-সখী পার্টির নেতাকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। ২৪ আগস্টের ঘটনার পর আওয়ামী লীগ দেশ অচল করে দিতে পারতো। খালেদা জিয়া সরকারের পতনটা তখন অনেকটা অনিবার্য হয়ে যেতো। সেই ক্ষমতা আওয়ামী লীগের আছে বলে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। তখন কেউ কোনও জোরালো প্রতিবাদও করেনি। দুর্ভাগ্যবশত কোনও সুশীলকে তখন এই ঘটনার প্রতিবাদে কোনও কর্মসূচি দিতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশে সুশীল শব্দটা এখন একটা গালিতে পরিণত হয়েছে। সুশীল হতে হলে প্রথমেই তাকে অওয়ামী লীগবিরোধী হতে হবে। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগবিরোধী দু-চারটি কথা বলে মাঠে নামতে হবে। এরা শুরুতেই ঘোষণা দেবে তাদের মতো দলনিরপেক্ষ মানুষ ত্রিভুবনে নেই। তাদের কাজ হচ্ছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। এদের অনেকেরই কোনও বৈধ আয়ের উৎস না থাকলেও তাদের পকেটে আছে বেশ কয়েকটি এনজিও’র লাইসেন্স। বিদেশে এদের এখন বিক্রি করার মূল পণ্য হচ্ছে সুশাসন। কিন্তু নিজেদের সব কাজকর্মই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। একটি দেশে সত্যিকার অর্থে একটি দেশপ্রেমিক সিভিল সোসাইটির প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে তেমন সিভিল সোসাইটি গড়ে ওঠেনি। সুশীল নামে যা গড়ে উঠেছে, তা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না আর তাদের টার্গেট হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দল ও গোষ্ঠী। আর দেশে যখন সরকারবিরোধী (অবশ্যই আওয়ামী লীগবিরোধী) কোনও ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে ওঠে, তখনই তারা বেশ সক্রিয় হয়। এক-এগারো ও তার পূর্ববর্তী সময়ে তাদের কর্মকাণ্ড এখনও সাক্ষী হয়ে আছে। এক-এগারোর আগে গুলশানের একটি অভিজাত কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত ‘যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন’-এর কথা মানুষ এখনও ভুলে যায়নি।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

/এমওএফ/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ