X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

মন্ত্রীকে ধাক্কা

মাসুদ কামাল
১২ আগস্ট ২০১৮, ১৭:১০আপডেট : ১২ আগস্ট ২০১৮, ১৭:৪৩

মাসুদ কামাল শুক্রবার (১০ আগস্ট) রাতে উন্মত্ত বাসটি যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলো, ঠিক কেমন ছিল তখন তার মানসিক অবস্থা? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন গাড়ির মধ্যে ছিলেন, তাই ধাক্কাটি তার দেহে-মনেও লেগেছে। ভয় পাওয়ারই কথা। কিন্তু কতটা ভয়? সে রাতে কি ঘুম হয়েছিল অন্য রাতগুলোর মতো?
আমি জীবনে কোনোদিন বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনায় পড়িনি, হয়তো সে কারণেই কখনও আমার পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না ধাক্কা খাওয়া ছোট গাড়ির যাত্রীদের মনের অবস্থা। তবে পরদিন ঢাকার বাইরে একটি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, তা থেকে কিছুটা ধারণা করা যায়। গিয়েছিলেন তিনি কুমিল্লার বুড়িরচংয়ে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের একটি নতুন ভবন উদ্বোধন করেন। ওই সময় তিনি বলেন, ‘জনগণ কিডনি রোগ কিংবা ক্যানসারের চেয়েও বেশি আতঙ্কে থাকে এখন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে।’ কথা সত্য। আসলেই এমন নির্মম সত্য আমরা অনেকদিন শুনিনি।
বাসের ধাক্কা খাওয়ার আগে তিনি গিয়েছিলেন হাসপাতালে, একজন রোগীকে দেখতে। রোগী দেখেই ফিরছিলেন। তিনি যে রোগীটিকে দেখতে গিয়েছিলেন, তিনি কি ক্যানসার কিংবা কিডনির রোগে আক্রান্ত ছিলেন? আমি ঠিক জানি না। হয়তো জটিল কোনও রোগ নয়, অতি সাধারণ কিছু। কিন্তু আমার মনে ওই দু’টি ভয়ঙ্কর রোগের নামই এলো কেন? মন্ত্রীর ওই তুলনা শুনে? তা হতে পারে। না হলে, এই দু’টি রোগের সঙ্গেই বা সড়ক দুর্ঘটনার তুলনা তিনি করলেন কেন? তিনি হয়তো হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসে জটিল রোগগুলোর ভোগান্তি বা পরিণতি নিয়ে চিন্তা করছিলেন। মানুষের অনিবার্য পরিণতি নিয়ে অসহায় বোধ করছিলেন। এরইমধ্যে নিউভিশন পরিবহনের বাসটি যখন হুমড়ি খেয়ে পড়লো তার গাড়ির ওপর, তিনি হয়তো তৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করলেন, দুরারোগ্য ব্যধি দু’টির চেয়েও আচমকা নেমে আসা এই গজব আরও বেশি ভয়ঙ্কর।
কারণ যেটিই হোক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন কিন্তু একেবারে ঠিক কথা। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে। তারপরও ক্যানসার বা কিডনি রোগ এখনও ভয়ঙ্কর। টাকা থাকলেই সবক্ষেত্রে এর নিরাময় সম্ভব নয়। হুনমায়ূন আহমেদ অর্থ কম ব্যয় করেননি। রক্ষা পাননি ক্যানসারের হাত থেকে। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের কারও কিডনি রোগ হলে, রোগী তো মরেন-ই, পুরো পরিবারটিকে পর্যন্ত মেরে রেখে যান। ব্যয়বহুল এই রোগটির চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে বাড়ি-ঘর সহায়-সম্পদ সব বিক্রি করতে হয়। এভাবে বেচতে বেচতে যখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, তখনই মারা যান পরিবারের ওই কিডনি রোগীটি। পুরো পরিবারকে নামিয়ে দিয়ে যান রাস্তায়। এরপরও এমন ভয়ানক দু’টি রোগের চেয়েও মানুষের আতঙ্ক বেশি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে। ক্যানসার বা কিডনি রোগ হলে মানুষ তাও পরিকল্পনার একটা সুযোগ পায়, নিশ্চিত পরাজয় জেনেও এতটুকু অন্তত চিন্তা করতে পারে–কিভাবে বাকি জীবনটা অতিবাহিত করবে তারা। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা মানুষকে সেই প্রস্তুতি পর্যন্ত নিতে দেয় না। আচমকাই সব শেষ হয়ে যায়। সকালে সুস্থ তরতাজা লোকটি বাসা থেকে বের হয়, ফিরে রক্তাক্ত লাশ হয়ে। জীবনের জন্য, পরিবারের জন্য এই এক মর্মান্তিক পরিণতি।
ক’দিন ধরে মহানগরীতে চলছে ট্রাফিক সপ্তাহ। কেউ কেউ বলে থাকেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শেষপর্যায়ে ট্রাফিক সপ্তাহের ঘোষণাই করা হয়েছিল প্রকারান্তরে ছাত্রছাত্রীদের ঘরে ফিরিয়ে নিতে। রাজপথে পুলিশের যে কাজগুলো করার কথা, সেগুলোই আসলে করছিল শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের ওই দিনগুলোতে। তারা দেখিয়ে দিয়েছিল, যে অনিয়মগুলো চলতে চলতে অনেকটা নিয়মের মতো দেখাচ্ছিল, সেগুলো আসলে অনিয়মই। মন্ত্রী, ভিআইপি এমনকী পুলিশ পর্যন্ত যে নিয়মগুলো লঙ্ঘন করাকে নিজেদের কৃতিত্ব বলে মনে করতেন এতদিন, সেগুলোর জন্য আসলে তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত ছিল। এমনকী কোনও কোনও ক্ষেত্রে শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল। আমার কাছে এমনও মনে হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা যেন বলতে চাচ্ছে, আইন যা-ই থাকুক না কেন, তার যথাযথ প্রয়োগ হলে সড়ক নিরাপত্তা বাড়তে বাধ্য। তাই ট্রাফিক সপ্তাহের ঘোষণা যখন এলো, ভাবলাম, আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে পুলিশ বুঝি এবার দেখিয়ে দেবে, কেবল বাচ্চারাই না, আমরাও পারি। কিছুটা নষ্ট না হয় হয়েছি, কিন্তু একেবারে পচে যাইনি।
একথা ঠিক, আগের যেকোনও ট্রাফিক সপ্তাহের তুলনায় এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন ছিল। ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা বেশি লক্ষ করা গেছে। প্রতিদিনই বিপুল-সংখ্যক মামলা হয়েছে যানবাহন ও এর চালকদের বিরুদ্ধে। জরিমানা করা হয়েছে। ফলে সরকারের আয়ও বেড়েছে। কিন্তু সড়ক ব্যবস্থাপনায় কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন কি হয়েছে? রাস্তা বন্ধ করে অবৈধ পার্কিং কি বন্ধ হয়েছে? আমার বাসা কাঁঠাল বাগান এলাকায়। ফলে প্রায়ই আমাকে বাংলামোটর কিংবা ইস্টার্ন প্লাজার দিকে যেতে হয়। মোটর ডেকোরেশন এবং টাইলসের দোকানের কারণে এই দুই এলাকাতেই প্রচুর গাড়িকে দেখি প্রধান সড়কের ওপর আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে। এদের দাপটে তিন লেনের রাস্তা পরিণত হয়ে যায় এক লেনে। ট্রাফিক সপ্তাহের কোনও দিনই কিন্তু এই দুই রাস্তায় কোনও পরিবর্তন চোখে পড়েনি।
অথচ সমস্যা যে চিহ্নিত হয়নি, তা তো নয়। বলা হচ্ছিল, গাড়ি চালকদের অনেকেরই লাইসেন্স নেই। অর্থাৎ যার গাড়ি চালানোর যোগ্যতা নেই, তাকেই দেওয়া হচ্ছে রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানোর ক্ষমতা। সে সমস্যার কি সমাধান হয়েছে? মালিকরা কি লাইসেন্সধারী চালক ছাড়া অন্য কারও হাতে গাড়ি দিচ্ছেন না? তাহলে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধাক্কা খেতে হলো কেন? নিউভিশনের যে বাসটি ধাক্কা মেরেছিল, সেটি কিন্তু তখন একজন লাইসেন্সধারী ড্রাইভার চালাচ্ছিলেন না, স্টিয়ারিংয়ে ছিলেন একজন লাইসেন্সবিহীন কন্ডাকটর। এর অর্থটা কী দাঁড়ালো? রাস্তার যে নিয়ম মেনে চলার জন্য ট্রাফিক পুলিশ সপ্তাহব্যাপী বাড়তি শ্রম বিনিয়োগ করলো, তা যে এই গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে কোনও অর্থই বহন করে না, সেটা তারা নির্মম রসিকতার মাধ্যমেই বোধকরি বুঝিয়ে দিলো। ট্রাফিক পুলিশেরা যে মন্ত্রণালয়ের অধীনে, সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর গাড়িতে ধাক্কা দিলো কন্ডাকটরচালিত বাস!  
শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলনের সময়, এমনকী তার আগে ও পরে, বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রীদের মুখেও একটা কথা শোনা গেছে। যখনই কোনও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, কিংবা সেই প্রসঙ্গ এসেছে, তারা বলেছেন মানুষের সচেতনতার কথা। বলেছেন, রাস্তায় চলতে জনগণকে সচেতন হতে হবে। কেবল চালককে একতরফা দোষ দিলেই হবে না। এ কথাগুলো একেবারে ভুল, তা হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু শুক্রবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা তার গাড়িচালক কি অসচেতন ছিলেন? পেছন দিয়ে কেউ মেরে দিলে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীর ওপর বাস তুলে দিলে, দায়টা কেন চালকের পাশাপাশি ভুক্তভোগীকেও নিতে হবে?
আবার যদি বিষয়টিকে ভিন্ন দিক থেকে দেখি—লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তির হাতে মালিকরা গাড়ি ছেড়ে দেন কোন ভরসায়? ওই যে জাবালে নূর পরিবহনের মালিককে গ্রেফতার করা হলো, তিনি কি গাড়িটিকে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর তুলে দিতে বলেছিলেন? অথবা ওই চালকের আসনে বসে থাকা কন্ডাকটর, তারই কি ওই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনও ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল? হয়তো ছিল না। তারপরও তো ঘটলো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এর দায় কে নেবে? এর পেছনে কাজ করছে, প্রচলিত আইন আর নিয়মকে পদদলিত করার মানসিকতা। আর তারও পেছনে রয়েছে আইন না মানার সংস্কৃতি। মালিক দেখেছেন, লাইসেন্স না থাকলেও কিছু লোক গাড়ি তো চালাতে পারে। তাকে নিলে টাকা কম দিয়ে পারা যাবে, মুনাফা বেশি হবে। তারপরও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কিছু টাকা পয়সা খরচ করে পার পাওয়ার সংস্কৃতি তো রয়েছেই। আর টুকটাক চালানো শিখেই যারা যাত্রীবাহী বাসের স্টিয়ারিংয়ে বসে যাচ্ছেন, তাদের সাহসের পেছনে কাজ করছে হাসির জন্য বিশেষ খ্যাতিপ্রাপ্ত সেই মন্ত্রীর প্রশ্রয়। তিনি তো বলেই দিয়েছেন, ড্রাইভার হওয়ার জন্য বিশেষ কোনও শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের দরকার নেই, মানুষ আর গরু ছাগল চিনতে পারলেই হয়।
ট্রাফিক সপ্তাহ এখনও চলছে। সপ্তাহ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এর মেয়াদ আরও তিন দিন বাড়ানো হয়েছে। ফলে সপ্তাহ হয়েছে এখন দশদিন মেয়াদি। তবে মেয়াদ যতই বাড়ানো হোক, আমি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মোটেই আশাবাদী নই। এই পুলিশ কিছুই করতে পারবে না। নাবালক সেই শিক্ষার্থীদের মতো সৎ সাহস আমাদের এই সাবালক কোনও পুলিশের মধ্যেই নেই। আসলে থাকা সম্ভবও নয়। চালকের লাইসেন্স না থাকায় ছাত্ররা মন্ত্রীর গাড়ি আটকে দিয়েছিল, মন্ত্রী গাড়ি রেখে হেঁটে চলে গেছেন। ঢাকা শহরের কোনও পুলিশের পক্ষে সেটা সম্ভব? সাহস করে কোনও পুলিশ সেটা করে ফেললেও তার পরিণাম কী হবে? বদলি তো অবধারিত,  চাকরিও চলে যেতে পারে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সম্ভবত সেই চাকরি রক্ষার গ্যারান্টি দিতে পারবেন না। তাহলে, গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?
আসলে পরিবর্তনটা ওপরের দিক থেকে আসতে হবে। মন্ত্রী, ভিআইপি, এমপি, নেতা, পাতি নেতাদের হিপোক্র্যাসি বন্ধ করতে হবে। নিজেরা নির্লজ্জের মতো আইন ভাঙবেন, আর জনগণকে আইন মানতে বলবেন,  এটা হয় না। মাদকাসক্ত পিতা যেমন তার স্কুলপড়ুয়া পুত্রের হাতে সিগারেট দেখার পরও শাসনের নৈতিক অধিকার রাখেন না, এটিও তেমন। আগে নিজে ঠিক হোন, দেখবেন আপনাকে আর কষ্ট করে উপদেশ দিতে হবে না, সমাজ আপনা আপনি ঠিক হয়ে যাবে। নয়তো সড়কে অরাজকতা, মানুষের গালাগালি, চালকের দাপাদাপি, কোনও কোনও মন্ত্রীর হাসাহাসি চলতেই থাকবে। তার হঠাৎ একদিন ক্ষুব্ধ শিশু কিশোররা রাস্তায় নামবে, অস্ত্র হাতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে হেলমেটধারীরা। সবকিছু থামিয়ে দিতে পারার তৃপ্তিতে মন্ত্রী যখন আয়েশে চোখ মুদে হেলান দেবেন তার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে, পেছন থেকে ধাক্কা দেবে তাদেরই সৃষ্ট লাইসেন্সবিহীন স্টিয়ারিং।
আর আমরা জনগণ অপেক্ষায় থাকবো, কবে এই ধাক্কা গিয়ে লাগবে শাজাহান খানের, অন্য মন্ত্রী-এমনকি পুরো সরকারেরও গায়ে।

লেখক: সিনিয়র নিউজ এডিটর, বাংলাভিশন

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সোনার দাম কমলো
সোনার দাম কমলো
মামুনুল হকের বিরুদ্ধে তৃতীয় দফায় সাক্ষ্য দিলেন তদন্ত কর্মকর্তা
মামুনুল হকের বিরুদ্ধে তৃতীয় দফায় সাক্ষ্য দিলেন তদন্ত কর্মকর্তা
পর্যটনে সহযোগিতা করতে আগ্রহী আরব আমিরাত
পর্যটনে সহযোগিতা করতে আগ্রহী আরব আমিরাত
আবারও আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ স্থগিত করেছে অস্ট্রেলিয়া 
আবারও আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ স্থগিত করেছে অস্ট্রেলিয়া 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ