X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্দয় নিষ্ঠুর বাস্তবতা

রেজানুর রহমান
২৯ আগস্ট ২০১৮, ১৭:১৭আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০১৮, ১৭:২০

রেজানুর রহমান কথায় আছে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। তেমনি রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলেও সহজে ছিন্ন করা যায় না। একটা সত্য ঘটনা বলি। স্কুলের শিক্ষাকার্যক্রমের অংশ হিসেবে একদল ছাত্রীকে একটা বৃদ্ধাশ্রমে নেওয়া হলো। সেখানেই ঘটে হৃদয়স্পর্শী এক মানবিক ঘটনা। যা পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানামুখী স্পর্শকাতর প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে। বৃদ্ধাশ্রমে ঢোকার পর শিক্ষার্থীরা যে যার মতো সেখানের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়। হঠাৎ দেখা যায় একজন বৃদ্ধা এবং একজন ছাত্রী পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। সবার কৌতূহলী চোখ পড়ে তাদের ওপর। ঘটনা কী? তারা এভাবে কাঁদছে কেন? মুহূর্তেই মানবিক সম্পর্কের এক নির্দয় ও নিষ্ঠুরতম ঘটনা উন্মোচিত হয় সবার সামনে। ওই বৃদ্ধা মেয়েটির আপন দাদি। মেয়েটি তার পরিবারকে অর্থাৎ বাবা-মাকে প্রায়ই দাদির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতো। বাবা-মা প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন, অথবা বলতেন তোমার দাদিমা আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছেন। ছাত্রীটি হয়তো সরল মনে বাবা-মায়ের কথা বিশ্বাস করেছে। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে এসে এরকম একটা নিষ্ঠুর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াবে তা তো কল্পনাও করেনি সে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হৃদয়স্পর্শী এই মানবিক ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন পড়ে শুধু অবাক নয়, নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। যেমন ভাবছি অসহায় সেই বৃদ্ধা মায়ের কথা, তেমনি ভাবছি অসহায় ওই ছাত্রীর কথা। তাদের এই মানবিক গল্প তো সিনেমার কাহিনিকেও হার মানিয়েছে। কল্পনা করুন তো দৃশ্যটা...।

মেয়েটি জানতো তার দাদিমা আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছে। অথচ তাকে কিনা পাওয়া গেলো বৃদ্ধাশ্রমে। প্রিয় দাদিমাকে বৃদ্ধাশ্রমে দেখে ছাত্রীটির মাঝে মানসিক নিপীড়নের মাত্রা কতটা ছড়িয়েছিল, একথা ভেবেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আহারে! বাস্তবতা এত নিষ্ঠুর হয়। এজন্য দায়ী কে? ছাত্রীটির বাবা-মা নিশ্চয়ই। তারা কীভাবে পারলো এরকম একটা নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে নিজের মাকে ফেলে দিতে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল কামাল বায়েজীদ লিখেছেন, ‘ভেরি স্যাড’। অভিনেতা আদিত্য আলম লিখেছেন ‘এজন্য বউ দায়ী’। রফিকুল আলম লিখেছেন, ‘যত নষ্ট মহিলারা। বললেই তো ভাই অশান্তি...’। আনামুল হক লিখেছেন, বউ শাশুড়ি সবাইকে সহনশীল হতে হবে। যোশেফ খান লিখেছেন, ‘যেমন বীজ রোপণ করবেন তেমনই ফল পাবেন।’ দেলোয়ার হোসেন লিখেছেন, ‘দুঃখজনক ঘটনা। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না।’

বিষয়টি নিয়ে আমার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেলাম। সকলেই ঘটনাটি জানার পর মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছে। তবে ঘটনাটি বাংলাদেশের নয় ভেবে কয়েকজন গুরুত্ব দিতে চাইলো না। তাদের বক্তব্য- বন্ধু, চিন্তা করো না। আমাদের দেশের মানুষ পারিবারিক ও মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখনও সরল, সঠিক পথেই আছে। গল্পের ঘটনার মতো এতটা নিষ্ঠুর নির্দয় পরিস্থিতি আমাদের দেশে এখনও সৃষ্টি হয়নি। পাঠক, কী বলেন? ঘটনাটি পাশের দেশে ঘটেছে বলে কি আমরা নির্ভার হয়ে বসে থাকবো? আমি তো মনে করি পাশের দেশের এই ঘটনার চেয়েও অমানবিক, নির্দয়, নিষ্ঠুর ঘটনা আমাদের দেশে অহরহ ঘটে চলেছে। ঢাকার কল্যাণপুরে দুজন তরুণ একটি বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনা করে। সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী আন্তর্জাতিক সংগঠন ইনার হুইল ঢাকা নর্থ ওয়েস্ট থেকে ওই বৃদ্ধাশ্রমে সহায়তা করতে গিয়েছিল একটি প্রতিনিধি দল। তাদের মুখেই শুনলাম ওই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া একজন অসহায় বৃদ্ধার মানবিক যন্ত্রণার কথা। একদিন তার মেয়ে তাকে ওই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যান। কথা ছিল মাঝে মাঝে এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে মাকে রেখে যাওয়ার পর আর তিনি আসেননি। বৃদ্ধাশ্রমের নথিপত্রে ওই মেয়ের যে মোবাইল নম্বরটি লিপিবদ্ধ করা আছে তা এখন আর অ্যাকটিভ নয়। বৃদ্ধা মা প্রতিদিন মেয়ের জন্য অপেক্ষা করেন। মেয়ে তো আর আসে না। এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে। যা পাশের দেশের ওই ঘটনার চেয়েও ভয়াবহ। নিষ্ঠুর তো বটেই।

ঈদ এলেই আমরা প্রায় সকলেই অনেক পারিবারিক হয়ে যাই। বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে , আকাশ পথে যে যার মতো করে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাই। পত্রপত্রিকায় শিরোনাম হয়- নাড়ির টানে ঘরে ফিরছে মানুষ। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আদৌ কি নাড়ির টানে আমরা সকলেই ঘরে ফিরি? একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। পাঁচ সদস্যের পরিবার। স্বামী, স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে। সঙ্গে একজন পরিচারিকা। নাড়ির টানে ঘরে ফিরেছে। গ্রামের ঘরবাড়ি। বিদ্যুৎ আছে কিন্তু ঘরে এসি নাই। শহর থেকে আসা পরিবারের কর্ত্রী শুরু করলেন যন্ত্রণা। ‘এই গরমে থাকবো কি করে?’ বাড়ির বড় ঘরটিই তাদের জন্য বরাদ্দ করা হলো। বউমা খাটে শুয়ে ঘুমান। শাশুড়ি মা তাকে তালপাতার পাখায় বাতাস করেন আর বলেন, তুমি ঘুমাও মা, আমি বাতাস করতেছি...। প্রিয় পাঠক, নাড়ির টানে এ কেমন ঘরে ফেরা? ঘটনা আরও আছে। নাড়ির টানে শহর থেকে ঘরে ফিরেছে একটি পরিবার। কোথায় বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের সাথে মন খুলে কথা বলবেন, আড্ডা দেবেন। কিন্তু তা না করে পরিবারের প্রতিটি সদস্যই ব্যস্ত হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আর সেলফি তোলায়। কাছেই আছি কিন্তু পাশে নেই এমন অবস্থা। এ কেমন নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা?

অনেকে হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, বৃদ্ধাশ্রমের অসহায় গল্প শুরু করে আমি হঠাৎ ঈদে বাড়ি ফেরার প্রসঙ্গে চলে এলাম কেন? এর পেছনেও ব্যাখ্যা আছে। বৃদ্ধাশ্রমের গল্পটি দৃশ্যমান। কিন্তু এ ধরনের আরও অনেক গল্প আমাদের চারপাশে অদৃশ্যমান অবস্থায় হাহাকার ছড়াচ্ছে। আমরা অনেকেই তা অনুভব করি। কিন্তু গুরুত্ব দেই না। বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠিয়েও আমরা কি বাবা-মায়ের প্রতি অবিচার, অন্যায় আচরণ করছি না? একটি পরিবারের কথা জানি। অনেক স্বপ্ন নিয়ে একমাত্র ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুললেন বাবা-মা। ছেলের বিয়ে হলো। বাবা-মা ভেবেছিলেন ছেলে ও ছেলের বউয়ের আদরে এবার অপার সুখ-শান্তির মাঝে বসবাস করবেন। ওমা, কোথায় সেই সুখ? ছেলে বিয়ে করে ওই যে গ্রাম থেকে শহরে গেলো আর তো ফেরে না। খোকা একদিন ফিরবে... এই আশায় গ্রামে অসহায় বাবা-মা শুধু অপেক্ষায় থাকেন, কিন্তু খোকা তো ফিরলো না।

একথা সত্য, সময় পাল্টেছে। আর তাই ‘এসো গলাগলি করে একসঙ্গে থাকি’ অর্থাৎ যৌথ পরিবারের সেই অন্তর ছোঁয়া আবহে সংসার জীবনকে উপভোগ করা সবার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। তাই বলে আমরা দিনে দিনে কি বিচ্ছিন্ন হতেই থাকব? প্রতিবারের মতো এবারের ঈদেও দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে শত শত নাটক, টেলিফিল্ম প্রচার হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের টিভি নাটকের পরিবারেও বাবা-মা অর্থাৎ বয়োজ্যেষ্ঠরা চরমভাবে উপেক্ষিত। ‘তুমি, আমি এবং সে’- এই তিন চারজন চরিত্র মিলেই নাটকের কাহিনি। আমাদের টিভি নাটক, টেলিফিল্মে সাধারণত বাবা-মা, খালা-খালু, ফুফা-ফুফু, দাদি, নানি অর্থাৎ বয়োজ্যেষ্ঠ চরিত্র থাকে না বললেই চলে। ফলে তরুণ প্রজন্মের কাছে পরিবারের এই চরিত্রগুলো গুরুত্ব হারাচ্ছে। তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য মোটেই সুখকর নয়।

লেখাটি শেষ করার আগে প্রিয় পাঠক, আসুন তো একবার ওই অসহায় বৃদ্ধা আর তার অসহায় নাতনির কথা একবার ভাবি। বুকের ভেতরে কি হাহাকার হচ্ছে? বাবাকে, মাকে মনে পড়ছে কি? নাড়ির টান সত্যি সত্যি অনুভব করছেন তো?

ভালো থাকবেন। সবার জন্য রইল শুভ কামনা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, পরিচালক, সম্পাদক- আনন্দ আলো

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশু হাসপাতালে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না: ফায়ার সার্ভিস
শিশু হাসপাতালে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না: ফায়ার সার্ভিস
ভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
বায়ার্নের নজরে থাকা নাগেলসমানের সঙ্গে জার্মানির নতুন চুক্তি
বায়ার্নের নজরে থাকা নাগেলসমানের সঙ্গে জার্মানির নতুন চুক্তি
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ