X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়!

প্রভাষ আমিন
৩০ আগস্ট ২০১৮, ১৫:৪২আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০১৮, ১৮:৪০

প্রভাষ আমিন অনেক দিন ধরেই দেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ-বিএনপি—এই দুই ধারায় বিভক্ত। আবার এই দুই দলের বাইরে একটি তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার চেষ্টাও পুরনো। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোটের পাশাপাশি বামদের ৫ দলীয় জোটও মাঠে ছিল। কিন্তু এরশাদ পতনের পরের বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে-সঙ্গে বাংলাদেশেও বামরা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে তৃতীয় শক্তি হওয়ার সক্ষমতা হারায়। এই সুযোগে তৃতীয় শক্তি হওয়ার চেষ্টায় মাঠে নেমেছেন কিছু দলছুট নেতা। বামরা দুর্বল হলেও তাদের আদর্শে তারা অবিচল। কিন্তু এই দলছুট নেতাদের আদর্শ বিভ্রান্তিকর, দোদুল্যমান, দ্বিধাগ্রস্ত। তারচেয়ে বড় কথা হলো, কথায় এরা অনেক শক্তিশালী হলেও মাঠে এরা দুর্বল, সম্ভবত বামদের চেয়েও।
যুক্তফ্রন্ট বললেই আমার মনে ’৫৪ সালের নির্বাচনের কথা মনে হয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতার মাত্র ৭ বছরের মাথায় আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট নাড়িয়ে দিয়েছিল মুসলিম লীগের ভিত। আমার মতো গুগলও বোকা। যুক্তফ্রন্ট লিখে সার্চ দিলে বেশিরভাগই ’৫৪ সালের কাহিনি আসে। ‘রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার’ বাসনায় বাংলাদেশে যে আরেকটি ‘শক্তিশালী’ যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে, সে খবর তাদের কাছে প্রায় নেই। গুগল খুব খারাপ। ট্রাম্পের মতো যুক্তফ্রন্ট নেতারাও গুগলের নিন্দা জানাতে পারেন এবং হুঁশিয়ার করে দিতে পারেন। তবে যুক্তফ্রন্ট এত বেশি ড্রয়িংরুমনির্ভর যে গুগলের পক্ষেও তাদের ফলো করা কষ্টকর।

নির্বাচন এলেই রাজনীতিতে শুরু হয় ভাঙাগড়ার খেলা। দল ভাঙে, নতুন দল গড়ে, জোট ভাঙে, জোট গড়ে। কোনও জোট আন্দোলনের, কোনও জোট নির্বাচনের, কোনও জোট আদর্শিক, কোনও জোট কৌশলগত। এখন বাংলাদেশে অনেক জোট আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট, ১৪ দলীয় জোট ও জাতীয় পার্টি মিলে মহাজোট, বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট, জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ৫৯ দলের সম্মিলিত জাতীয় জোট, সিপিবি-বাসদ মিলে বাম জোট ছাড়াও নানান খুচরা জোট আছে। তবে নির্বাচনের আগে আগে যেসব জোট গঠিত হয়, সেগুলোতে আদর্শ খুঁজতে যাবেন না। এগুলো নিছকই দর-কষাকষির জন্য। যুক্তফ্রন্টও তেমনই জোট। ৫টি দলছুট দল মিলে শুরু করা হলেও শেষপর্যন্ত তিনটি দল টিকেছে–বি চৌধুরীর বিকল্পধারা, আ স ম আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য। গত মঙ্গলবার (২৮ আগস্ট) রাতে ড. কামাল হোসেনের বাসায় গিয়ে বৈঠক করেছেন তারা। ‘দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে’ তারা একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন। গণফোরামকে বাইরে রেখে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হওয়ায় তাতে যোগ দেয়নি কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। কিন্তু এখন কাদের সিদ্দিকীকে ছাড়াই যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে ঐক্য করছেন ড. কামাল। অভিমানী কাদের সিদ্দিকী গাল ফোলালে কেউ মাইন্ড করবেন না যেন। যারা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের স্বপ্ন দেখেন, তারা ৫ দল মিলে যুক্ত হতে পারলেন না; এটা বড় বেদনাদায়ক।

গত বছরের ১৩ জুলাই আ স ম আব্দুর রবের উত্তরার বাসায় যুক্তফ্রন্ট স্বপ্নের যাত্রা শুরু। পুলিশের বাধায় শেষ হতে না পারা সে বৈঠকে ছিল বিকল্পধারা, গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বাসদ (খালেকুজ্জামান), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘সুজন’। ২ আগস্ট বি চৌধুরীর বাসায় পরের বৈঠকে প্রথম ৫টি দল অংশ নেয়। বাসদ বা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি আর যায়নি সে প্রক্রিয়ায়। ৫ দলের নানা টানাপড়েন শেষে ৩ দল মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে পেরেছে। ড. কামাল কেন যুক্তফ্রন্টে থাকতে পারেননি, জানেন? কারণ, তখন তিনি দেশে ছিলেন না। ড. কামাল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী। তিনি দেশের বাইরেই বেশি থাকেন। মাঝেমধ্যে দেশে এসে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে আবার চলে যান।

দলের চেয়ে বড় হয়ে ওঠা যুক্তফ্রন্টের নেতারা আমার খুব পছন্দের। প্রত্যেকের বর্ণাঢ্য অতীত তাদের অমরত্ব দিয়েছে আগেই। তারা যে এই দুঃসময়েও সাহস করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন, সেজন্যও তাদের স্যালুট। তাদের কথাবার্তাও চমৎকার। তারা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চান, নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কার চান, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন চান, ভালো প্রার্থী চান। তারা বলছেন, কোনও দলকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বা কোনও দলকে ক্ষমতায় আনা তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের চাওয়া আমারও চাওয়া। তারা যদি জাতির বিবেক হয়ে, সবার ভুল ধরিয়ে দিতেন, শুধরে দিতেন; তাহলে তারা সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেতেন। কিন্তু তারা যখন নির্বাচনের আগে আগে সক্রিয় হন, তখন সন্দেহ হয়, এগুলো আসলে ‘বাত কি বাত’। তারা আসলে দর-কষাকষি করতে চান। দর বাড়াতেই নিজেরা জোট বাঁধছেন। ইতোমধ্যে বিএনপির সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। তবে তারা শেষপর্যন্ত বিএনপির সঙ্গেই যাবেন, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। যে ভালো দর দেবে, তাদের সঙ্গেই যাবেন। এখানে ‘আদর্শ-ফাদর্শ’ বলে কিছু নেই। যুক্তফ্রন্টের সব আছে–বড় বড় নেতা আছেন, বড় বড় কথা আছে। কিন্তু জনসমর্থন নেই। রাজনীতি করতে হলে জনগণের সমর্থন দরকার। কিন্তু ড্রয়িংরুমে বসে জনগণের পালস বোঝা কঠিন।

শুরুতে যুক্তফ্রন্টের দলগুলোকে দলছুট বলেছি বলে মনে কিছু করবেন না। দেখুন, আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গঠিত হয়েছে গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আর নাগরিক ঐক্য। আর বি চৌধুরী বিকল্পধারা গড়েছেন বঙ্গভবন থেকে বের হওয়ার পর। আর আ স ম আব্দুর রবও অনেক ঘাটের জল খাওয়া। এখনও জেএসডি নামে সংগঠন করলেও জাসদের আদর্শের সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক নেই জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আ স ম আব্দুর রবের।

জিয়াউর রহমান ক্যান্টনমেন্টে বসে রাজনীতি শুরুর পর একটি স্লোগান খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল—ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ। যুক্তফ্রন্ট দেখে আমার স্লোগানটি একটু উল্টে দিতে মন চায়–দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়। আসলেই যুক্তফ্রন্টে যারা আছেন, তারা সবাই বিশাল নেতা। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস লিখতে গেলে সবার নামেই আলাদা অধ্যায় রাখতে হবে। কিন্তু সবাই এখন রাজনীতির অতীতকাল। তারা যদি থিংকট্যাংক হিসেবে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতেন, সবার ভুল ধরিয়ে দিতেন; অনেক ভালো হতো। তারা সরাসরি রাজনীতি করতে চান, জনগণের ভোট চান; কিন্তু জনগণের সঙ্গে তাদের কোনও যোগাযোগ নেই।

দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় নেতাদের কথা শুনুন। প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী আ স ম আব্দুর রবের অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা রেকর্ড আছে। ৮৮ সালের নির্বাচনে ৭২ দল মিলে সম্মিলিত বিরোধী দল করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বিরোধীদলীয় নেতাও হয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম 'গৃহপালিত' বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন রব। আওয়ামী লীগের বিরোধিতার জন্য গঠিত জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আ স ম রব পরে আওয়ামী লীগের ঐকমত্যের সরকারেরও মন্ত্রী হয়েছিলেন।

যুক্তফ্রন্টের দলগুলোর আদর্শিক অবস্থান কখনোই পরিষ্কার নয়। তাদের দল ভাঙাগড়া আদর্শিক কারণে হয়নি। হয়েছে ব্যক্তিগত পদ-পদবি, পছন্দ-অপছন্দের কারণে। বিএনপি বের করে না দিলে তো বি চৌধুরী বঙ্গভবনেই থাকতেন। প্রথম কিছুদিন কট্টর বিএনপিবিরোধিতা করলেও পরে আবার বিএনপির কাছাকাছি যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ড. কামাল কীভাবে পাকিস্তান গেলেন, সেটা রহস্যাবৃত। তবে বঙ্গবন্ধু সস্নেহে তাকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরেন। তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছেন, বঙ্গবন্ধুর আইনমন্ত্রী ছিলেন। ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি থেকে রাষ্ট্রপতি সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, কিন্তু কোনও নির্বাচনেই পাস করতে পারেননি।

ডাকসুর দুবারের ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ-বাসদ হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি কট্টর আওয়ামী সমালোচক। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ায় নিজেই নিজেকে ‘বেকুব’ বলেছেন।

কাদের সিদ্দিকী এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তফ্রন্টে যোগ দেননি। তবে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে যেহেতু গণফোরামের ঐক্য হচ্ছে, সেহেতু তিনিও এই ফ্রন্টে আসবেন আগে আর পরে। কাদের সিদ্দিকী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধাদের একজন। তার ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ কাঁপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের। বঙ্গবন্ধুর স্নেহ পেয়েছেন। বাকশালের কনিষ্ঠ জেলা গভর্নর কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। দীর্ঘদিন পালিয়ে ছিলেন ভারতে। এরশাদের পতনের পর দেশে ফিরে আওয়ামী লীগে সক্রিয় হন। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠন করেন। এখন আওয়ামী বিরোধীদের সাথেই তার ওঠাবসা। তার সমস্যা হলো, তিনি এখনও একাত্তরে বাস করেন। নিজেকে মনে করেন একাত্তরের কাদের সিদ্দিকী।

সারাজীবন আওয়ামী লীগ করা কামাল হোসেন আর সারাজীবন বিএনপি করা বি চৌধুরী কোন আদর্শের সূত্রে এক হয়েছেন, জানি না। জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধা বিএনপির সঙ্গে তাদের ঐক্যের সূত্রটা কী হবে, জানি না। তবে যুক্তফ্রন্ট বিএনপির সঙ্গেই যাবে, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। এরশাদ গত বছর বি চৌধুরীকে মিত্রশক্তি বলে অভিহিত করেছিলেন। ভালো দর পেলে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও যেতে পারেন। তবে আমার খুব ইচ্ছা যুক্তফ্রন্ট একবার কারও সঙ্গে না গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিক। সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে দলের চেয়ে বড় হয়ে ওঠা নেতাদের কয়জনের জামানত থাকবে, তা নিয়ে আমি বাজি ধরতে রাজি আছি।

আগেই বলেছি ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট কাঁপিয়ে দিয়েছিল মুসলিম লীগের ভিত, আওয়ামী মুসলিম লীগের কোটায় যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন বি চৌধুরীর বাবা কফিলউদ্দিন চৌধুরী। বি চৌধুরী কী পারবেন বাবার সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করতে?

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ