X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘মি টু’ হ্যাশট্যাগ: বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়বে

জোবাইদা নাসরীন
১৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:৫১আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:৫২

জোবাইদা নাসরীন ‘আমিও যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছি’– বাংলায় বাক্যটি কিছুটা দীর্ঘ হলেও ইংরেজিতে ‘মি টু’ শব্দটা দিয়ে নারীরা নীরবতা ভেঙে বেরিয়ে আসছেন বিভিন্ন পরিসর থেকে। কৃষ্ণাঙ্গ নারী তারানা বুর্কে ২০০৬ সালে প্রথম যৌন নির্যাতনবিরোধী ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন।
এরপর থেকেই টুকটাক জারি ছিল এই প্রচারণা। ২০১৭ সালেই এই আন্দোলনে প্রথম কাঁপুনি ওঠে হলিউডে। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে হলিউডের প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের যৌন কেলেঙ্কারির খবর ফাঁসের সূত্র ধরে মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো ‘মি টু’ হ্যাশট্যাগের এই প্রচারণা শুরু করেন আবারও। যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির ঘটনা প্রকাশ করতে নারীদের উৎসাহিত করতে এ প্রচারণা দ্রুত জনপ্রিয় হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।
নারীরা নিজেদের ভেতরকার সাহসকে সম্বল করে একে একে বলতে শুরু করেন পুরুষতান্ত্রিক দুনিয়ায় তাদের নিপীড়নের অভিজ্ঞতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যৌন নিপীড়নবিরোধী এই প্রচারণায় নারীদের পাশাপাশি যোগ দেন পুরুষেরাও। সামাজিক মাধ্যমে জানান দেন তাদের এতদিনের অপ্রকাশিত দমিয়ে রাখা যৌন হয়রানির কথাও।

যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গত বছরই প্রথমবারের মতো রঙিন দুনিয়া খ্যাত জায়গা যুক্তরাষ্ট্রের হলিউডে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। সেই মিছিল শুধু হলিউডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, হলিউডে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীদের সমর্থনে কয়েকশ’ ব্যক্তি মিছিল করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যৌন হয়রানিবিরোধী হ্যাশট্যাগ মি টু ক্যাম্পেইন ব্যাপক প্রচার পাওয়ার পর অনেকে নির্যাতন ও হয়রানির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

হলিউডের বেশ কয়েকজন অভিনেত্রী অভিযোগ করেছেন, অস্কার জয়ী প্রযোজক হার্ভি ওয়েনস্টেইনের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন তারা। এই প্রথমবারের মতো বের হয়ে এলো কিছু নাম। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হ্যাশট্যাগ মি টু প্রচারণায় অনেক নারী-পুরুষ জানিয়েছেন কীভাবে তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। হলিউড ব্যুলভার্ড থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি সিএনএনের সদর দফতর পর্যন্ত গিয়েছিল সে সময়। এতে অনেক নারী যৌন হয়রানি ও নির্যাতনবিরোধী প্ল্যাকার্ড বহন করেন। দীর্ঘদিন পুষে রাখা ক্ষোভ প্রচার পায় সেদিনের মিছিলে, তাই অনেকে তাদের হয়রানির শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতাও লিখে আনেন প্ল্যাকার্ডে। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে তারা বলছে অনেক পুরুষই এই কাজটি করছেন। এই আন্দোলন সংক্রান্ত ফেসবুক ইভেন্টে লেখা হয়েছে, ‘এটি হার্ভি ওয়েনস্টেইনদের জন্য। এ ধরনের আরও শত শত পুরুষ আছে, যারা একই কাজই করছে।’

হলিউড থেকে সাম্প্রতিক সময়ে এই আন্দোলন খুব দ্রুত মেজাজে আস্তানা গেঁড়েছে ভারতে। হয়তো অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাংলাদেশেও শুরু হবে। অভিযুক্তের তালিকায় এবার এসেছেন দেশটির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর, যিনি একজন সাংবাদিক এবং লেখক। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি একাধিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আকবরের বিরুদ্ধে কয়েকজন নারী সাংবাদিক যৌন অসদাচরণের অভিযোগ এনেছেন। তিনি হোটেল কক্ষে তরুণ নারীদের ‘বৈঠকের’ আমন্ত্রণ জানাতেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

তবে ভারতে ‘মি টু’ আন্দোলনটি বর্তমান সময়ে আবারও আলোচিত হয় নানা পাটেকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের মাধ্যমে। যদিও অভিযোগটি ১০ বছর আগের। কিন্তু তখনো তিনি বিচার পাননি। তবে সম্প্রতি তনুশ্রী দত্ত নানা পাটেকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আবারও সামনে আনলে ‘মি-টু’ আন্দোলন বলিউডে ছড়িয়ে যায়। বর্তমানে বলিউডের অনেক তারকাই এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন।

হলিউড-বলিউড যখন এই আন্দোলন নিয়ে সরব বা নারীরা নীরবতা ভেঙে যৌন নিপীড়ন নিয়ে কথা বলছেন, তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারক নিয়োগেও উঠে এসেছে এই ‘মি টু’ আন্দোলন।

অধ্যাপক ক্রিস্টিন ব্লেসি ফোর্ড অভিযোগ করেন, ১৯৮২ সালে হাইস্কুলে পড়ার সময় এক পার্টিতে কাভানা মাতাল অবস্থায় তাকে যৌন হয়রানি করেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি আতঙ্কিত। আমি আজ এখানে এসেছি, কারণ আমি মনে করি, এটা আমার নাগরিক দায়িত্ব যে হাইস্কুলে পড়ার সময় কাভানা আমার সঙ্গে কী করেছিল, তা লোকজনকে জানানো।… ‘আমার ওপর ব্রেটের হামলা জীবনকে ব্যাপক আকারে পাল্টে দিয়েছে। বহুদিন আমি এই ঘটনা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে ভীত ছিলাম।’ কিন্তু সবকিছুর পরও রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে আজীবনের জন্য নিয়োগ পান কাভানা।

কেন ক্রিস্টিনের এই অভিযোগ ‘মি টু’র অংশ। কারণ, সিনেট কমিটির এই শুনানির সঙ্গে প্রায় সাতাশ বছর আগে আরেক সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছে সবাইকে। ১৯৯১ সালে অভিযোগকারী ছিলেন  আরেকজন আইনের অধ্যাপক অনিতা হিল। ১৯৮১ সালে ফেডারেল চাকরি কমিশনের প্রধান ক্লারেন্স টমাসের সহকারী হিসেবে কর্মরত অবস্থায় যৌন হয়রানির শিকার হন। ১০ বছর পর ১৯৯১ সালে অনিতা হিল এই অভিযোগ উত্থাপন করলে সিনেটের বিচার বিভাগীয় কমিটির এক শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় অবশ্য সিনেটের নিয়ন্ত্রণ ডেমোক্র্যাটদের হাতে ছিল। এই কমিটির প্রধান হিসেবে সিনেটর জো বাইডেন পুরুষ সদস্যরা অনিতা হিলকে অত্যন্ত বাজেভাবে ও পুরুষ পক্ষপাতমূলক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ সত্ত্বেও উভয় দলের সমর্থনে ক্লারেন্স টমাস  বিচারপতি হিসেবে আজীবন নিয়োগ লাভ করেন।

দেরিতে হলেও নীরবতা ভাঙছে নারীরা। এই নীরবতা ভাঙতে কারো লাগছে হয়তো ১০ বছর, কারো ২০ বছর কিংবা আরও অনেক বছর। অনেকেই হয়তো বলতেই পারেনি। নিজেই সেই জগত ছেড়ে চলে গেছেন। বাংলাদেশেও এই আন্দোলন খুব শিগগিরই ছড়িয়ে পড়বে, হয়তো খসে পড়বে অনেকেরই মুখোশ। বাংলাদেশ সানন্দে বুকে পেতে নেবে জীবনের নিদারুণ অভিজ্ঞতায় পার করা সেই নারীদের, যারা জীবনের সপক্ষেই কথা বলবে। কারণ, আমি জানি, নিশ্চিতভাবেই জানি, আমরা সবাই কম বেশি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছি।

লেখক: শিক্ষক,  নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ