X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

খাশোগিকে নিয়ে কি খাদে পড়েছে সৌদি আরব?

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৫১আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:০৫

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী জামাল খাশোগির নিখোঁজ রহস্য নিয়ে গত ১২/১৪ দিন ধরে উত্তাল পুরো বিশ্ব। জামাল খাশোগি (কারও কারও উচ্চারণে খাসোগজি) ওয়াশিংটন পোস্টের নিয়মিত কলামিস্ট। তিনি সৌদি যুবরাজ ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের একজন কঠোর সমালোচক। জামাল খাশোগির অন্তর্ধানের কথা উঠলেই সবার অঙ্গুলি মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রতি নির্দেশিকা হয়ে দেখা দিচ্ছে। তিনি তাকে হত্যা করাতে পারেন বলে সবার ধারণা এবং তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে বলেও অভিযোগ। ঘটনার কারণে বিশ্বে নিজেদের মুখ দেখানো কঠিন হয়েছে সৌদি আরবের। 
অবশ্য যতই দিন যাচ্ছে সৌদি আরব এই ঘটনায় বেকায়দায় আছে স্পষ্ট হচ্ছে। যদিও চূড়ান্ত বিচারে তারা এটিকে সামাল দিতে পারবে বলে মনে হয়। সুর বদল করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাকে নিয়ে নানা ট্রল চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যেমন, সৌদি বাহশাদকে বলছেন, ‘তোমরা যদি ৫০০ বিলিয়ন ডলার দাও তাহলে বলবো খাশোগি কনস্যুলারের বাইরে মারা গেছে, এক হাজার বিলিয়ন দিলে আমরা বলবো ইরান তাকে হত্যা করেছে। আর বাদশাহ বলছেন, আমরা দুই হাজার বিলিয়ন দিবো, তোমরা বলে দাও এর সঙ্গে হিজবুল্লাহ ও হুথিরাও ছিল’।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সর্বশেষ বলেছেন, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তাকে জানিয়েছেন সাংবাদিক জামাল খাশোগি নিখোঁজের বিষয়ে পূর্ণ তদন্ত চলছে এবং তার নিখোঁজের বিষয়েও কিছু জানেন না সৌদি প্রিন্স। খাশোগি নিখোঁজের পর  ট্রাম্প তখন এ ঘটনাকে ‘ভয়ঙ্কর ও বর্বর’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এখন বলছেন সৌদি সাংবাদিক নিখোঁজের বিষয়ে পুরোপুরি না জানা পর্যন্ত দেশটির নেতাদের এ নিয়ে দোষারোপ করা উচিত নয় বিশ্ববাসীর। বার্তা সংস্থা এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ‘কোনও কিছু প্রমাণ না হওয়ার আগে সৌদি আরবকে দোষারোপ করা হচ্ছে’।

তুরস্কের ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে নিয়োজিত কনসাল জেনারেল ও অন্য কর্মীদের দেওয়া দায়মুক্তির সুবিধা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট। তিনি মনে করেন, সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি নিখোঁজের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এ দায়মুক্তির সুবিধা প্রত্যাহার করা জরুরি। ১৯৬৩ সালে ভিয়েনা কনভেনশন অন কনস্যুলার রিলেশন্সের আওতায় দূতাবাসকর্মীদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে দায়মুক্তি সুবিধা রয়েছে। অবশ্য তার আগেই গত মঙ্গলবার তুরস্কের ইস্তানবুলে নিযুক্ত সৌদি আরবের কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ আল-ওতাইবি তুরস্ক ছেড়ে গেছেন।

তুরস্কের কর্মকর্তারা বলছেন, ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে অভিযান চালালে প্রমাণ পাওয়া যাবে  খাগোশিকে হত্যা করা হয়েছে। যদিও শুরু থেকেই সৌদি আরব তা অস্বীকার করে বলছে, এই অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।

যুদ্ধ রিপোর্ট করতে গেলে সাংবাদিকের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে থাকে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনুরূপ বহু ঘটনা ঘটেছে। আবার কোনও কোনও সময় কোনও একনায়কের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে বহু সাংবাদিক বহু বুদ্ধিজীবীর জীবনেরও অবসান ঘটেছে। হিটলার এক বিখ্যাত লেখকের সব পুস্তক আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। একনায়কের দেশে অনেক সময় সাংবাদিক/বুদ্ধিজীবীকে ফরমায়েশি হতে হয়। জামাল খাশোগি দুঃসাহস দেখিয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিয়ে লিখতে গিয়ে। তিনি ফরমায়েশি হতে পারেননি। তাই হয়তোবা রাষ্ট্রের কোপানলে পড়েছেন।

টটস্কি রাষ্ট্রের কোপানলে পড়ে মেক্সিকোতে গিয়েও বাঁচতে পারেননি। গত মার্চ মাসে রুশ এজেন্টরা সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার মেয়েকে হত্যার চেষ্টায় রসায়নিক ব্যবহার করেছিল। লন্ডনের সেলিশবারিতে এ ঘটনা ঘটে। লন্ডন পুলিশ বলছে, রাশিয়ার দুই নাগরিক, সম্ভবত যারা রাশিয়ার এজেন্ট, তারাই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। সের্গেই স্ক্রিপাল ছিলেন পক্ষত্যাগী রুশ এজেন্ট। এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব বিক্ষুব্ধ হয়েছে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অবশ্য রাশিয়া সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ আজন্ম ইয়াসির আরাফাতকে হত্যার ফিকিরে ছিল। আরাফাতকে হত্যা করতে মোসাদ নাকি বিকিরণ বিষক্রিয়ারও আশ্রয় নিয়েছিল।

সাংবাদিক জামাল খাশোগি গত ২ অক্টোবর থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। তিনি ওই দিন তুরস্কে পৌঁছেছিলেন এবং সঙ্গে তার বান্ধবী হাতিস চেঙ্গিসও ছিল। জামাল খাশোগি ২ অক্টোবরই তুরস্কের ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেট ভবনে গিয়েছিলেন। দূতাবাসের সিসিটিভি ফুটেজে তার প্রবেশের দৃশ্য খুবই স্পষ্ট। জামাল খাশোগি সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের সময় তার বান্ধবী হাতিম চেঙ্গিসকে কনস্যুলেট অফিসে নিয়ে যাননি। তিনি অফিসের বাইরে একটা জায়গায় বসেছিলেন। আর জামাল খাশোগি তার মোবাইল ফোনটি তার বান্ধবী চেঙ্গিসের হাতে রেখে কনস্যুলেট অফিসে প্রবেশ করেছিলেন। জামাল খাশোগির বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল কিছু দিন আগে। তিনি তুরস্কে এসেছিলেন নতুন বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিক করতে।

বান্ধবী হাতিম চেঙ্গিস ২ অক্টোবর খাশোগির কনস্যুলেটে প্রবেশের পর থেকে রাত গভীর হওয়া পর্যন্ত তার অপেক্ষায় অফিসের সামনে বসা ছিলেন এবং আবার রাত পোহানোর সঙ্গে সঙ্গে কনস্যুলেট অফিসের সামনে এসে পূর্বের জায়গায় অবস্থান নেয়। কোনও সময়েই হাতিম চেঙ্গিস খাশোগিকে সৌদি কনস্যুলেট অফিস থেকে বের হতে দেখেনি। সে থেকে জামাল খাশোগি নিরুদ্দেশ।

জামাল খাশোগি পূর্বে সৌদি সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন এবং যুবরাজ ও ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতেন। প্রিন্সের সঙ্গে তার মনোমানিল্য বেড়ে যাওয়ার পর ২০১৭ সালে তিনি সৌদি আরব ত্যাগ করে ওয়াশিংটনে চলে যান এবং তখন থেকে তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে কলামিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

খাশোগির হাতে সর্বাধুনিক ‘অ্যাপেল ওয়াচ’ ছিল। আর এ ওয়াচের মাধ্যমে সৌদি কনস্যুলেটে তাকে নির্যাতন এবং হত্যার মুহূর্তের অডিও রেকর্ড তার ফোন এবং আইক্লাউডে পৌঁছে গিয়েছিল। এখন এসব রেকর্ড চেঙ্গিসের হাত থেকে তুরস্ক সরকারের হাতে গিয়ে পৌঁছেছে। সম্ভবত এ কারণে তুরস্ক সরকার আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দাবি করেছেন, তাদের হাতে এমন কয়েকটি অডিও ভিডিও রেকর্ড আছে, যা দিয়ে প্রমাণ করা যায়  সৌদি কনস্যুলেটে জামান খাশোগিকে হত্যা করা হয়েছে।

২ অক্টোবর ১৫ জন লোক এসেছিল, তারা বিমানবন্দরে সৌদি কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয় এবং তারা সরাসরি বিমানবন্দর থেকে কনস্যুলেট অফিসে গিয়েছিল। এই ১৫ জনের মধ্যে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার মাহের মুত্রের নামে একজন গোয়েন্দা অফিসার ও মোহাম্মদ আলমাদানি নামে সৌদি আরবের একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ওই দিনেই এই ১৫ জন লোক দুটি সৌদি জেট বিমানে করে সৌদিতে চলে যায়। তুরস্ক সরকার বলেছে এই ১৫ জনের টিমটাই জামাল খাশোগিকে কনস্যুলেট অফিসে হত্যার পর টুকরা টুকরা করেছে এবং কৌশলে জেট বিমানে করে খাশোগির টুকরো টুকরো করা দেহ তারা রিয়াদে নিয়ে গেছে।

বিরোধীদের অপহরণ ও জোরপূর্বক অন্তর্ধানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে সৌদি রাজপরিবারের। ১৯৭৯ সালে বৈরুতে ভিন্নমতের সৌদি নাগরিক নাছির আল সাইস গুম হয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৩ সালে জেনভায় প্রিন্স সুলতান বিন তুর্কিকে অপহরণ করা হয়েছিল। এরপর সৌদ ইবনে সাইফ আল নাসারের সন্দেহজনক অপহরণ ও অন্তর্ধান ঘটে। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হারিরিকে আটক করা এবং জোরপূর্বক পদত্যাগের ঘটনা বেশি দিনের পুরনো নয়। ফ্রান্স চাপ সৃষ্টি করেছিল বলে হারিরিকে গুম করা সম্ভব হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত হারিরিকে সৌদি সরকার প্যারিসে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল।

জামাল খাশোগির ঘটনা নিয়ে সৌদি আরব আর তুরস্কের মাঝে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাট সিনেটররা জামাল খাশোগির অন্তর্ধান রহস্য উদঘাটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যথাযথ ভূমিকা রাখার কথা বলেছেন। ট্রাম্প বলেছিলেন, যদি প্রমাণ হয়  জামাল খাশোগিকে সৌদিরা হত্যা করেছে তবে সৌদিকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। ব্রিটেনও একই কথা বলছে। তুরস্ক আর সৌদি আরব যৌথ তদন্ত কমিটি করেছে এবং তারা কাজও শুরু করেছে। সৌদি আরবের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোমালিন্য চলছে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নির্যাতনের বিষয় নিয়ে।

ট্রাম্প মিসিসিপিতে বলেছেন, তিনি ফোন আলাপে বাদশা সালমানকে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া তিনি দুদিনের বেশি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন না। ট্রাম্পের কথাটা যে একেবারে মিথ্যা তাও নয়। সৌদি রাজপরিবারের মাঝে বিরোধ চলছে সালমান বিন আব্দুল আজিজ ক্রাউন প্রিন্স পরিবর্তনের পর থেকেই। বর্তমান বাদশা সালমান ও ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ সৌদির কিছু ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও প্রিন্সকে গ্রেফতার করে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করেছিল। এদের মাঝে লাদেন পরিবারও ছিল। লাদেনরা সৌদির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধনাঢ্য পরিবার। বর্তমানে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ সফর করছেন। বাদশা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন একটা কার্যকর তদন্ত হবে।

আবার আমেরিকার গণমাধ্যম বলছে, সৌদি কর্তৃপক্ষ কোনও অজুহাত সৃষ্টি করে তার মৃত্যুর কথা স্বীকার করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সৌদি আরবে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। নিহত হওয়া ব্যক্তির পরিবার অর্থের বিনিময়ে হত্যার দায় ক্ষমা করে দিতে পারে। শরিয়তে এটাকে ‘দিয়াত’ বলে। সম্ভবত সৌদি রাজপরিবার সেই প্রচেষ্টাও চলাচ্ছেন। খাশোগির সন্তানদের সর্বশেষ কথাবার্তায় তাই বুঝা যায়।

 

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘রানা প্লাজার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ করতে হবে’
‘রানা প্লাজার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ করতে হবে’
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাকি দুই টি-টোয়েন্টিতে অনিশ্চিত রিজওয়ান
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাকি দুই টি-টোয়েন্টিতে অনিশ্চিত রিজওয়ান
প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে বিএনপি নেতা বললেন ‘রিজভী ভাই আমাকে ফোন করেছিলেন’
প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে বিএনপি নেতা বললেন ‘রিজভী ভাই আমাকে ফোন করেছিলেন’
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ