X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

আগামী নির্বাচনে মোদির ফেরা সহজ নয়

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:২১আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:২৬

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের লোকসভা নির্বাচন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি যত প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন তার কিছুই আশানুরূপ বাস্তবায়ন করতে পারেননি। সে কারণে এবারের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। দীর্ঘ ৪০ বছর কংগ্রেসের একক ও একটানা শাসনের পর ভারতেও কোনও দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এখন আর কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে পারছে না। সরকার ব্যবস্থা জোটনির্ভর হয়ে পড়েছে। আঞ্চলিক দলগুলোর সমর্থন ছাড়া সরকার গঠন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। যে কারণে মন্ত্রিত্ব বণ্টনে রাজ্যগুলোর মধ্যে সমতা রক্ষা করাও সম্ভব হচ্ছে না। সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বকে আঞ্চলিক দলগুলো যথাযথভাবে মানছে না। যে কারণে মন্ত্রীদের দুর্নীতি প্রতিরোধ করাও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
মনমোহন সিংয়ের মতো সৎ মানুষের অসহায়ত্ব দেখেই সম্ভবত ভারতের জনগণ নরেন্দ্র মোদির জোটকে ভোট দিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির দল জনতা পার্টিকেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতিয়ে দিয়েছেন ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে। নরেন্দ্র মোদিকে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখার জন্য জোট সঙ্গীদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়নি। কারণ, বিজেপিরই লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। অথচ দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মনমোহন সিংকে অকার্যকর করে ফেলেছিল জোট সঙ্গীরা। শুধু বিহার আর তামিলনাড়ুর রাষ্ট্রীয় জনতা দল আর ডিএমকে থেকে ১৩ জনকে মন্ত্রী করতে হয়েছিল। আর মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, আর এই মন্ত্রীরা ছিল জোটসঙ্গী আঞ্চলিক দলগুলোর। বিশেষ করে ডিএমকে দলীয় মন্ত্রীরাই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করেছিলেন।

স্বাধীন প্রজাতন্ত্রটি যাত্রা শুরু করার সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেহরু। তিনি একঝাঁক স্বাধীনতা সংগ্রামের ত্যাগী নেতৃবৃন্দ পেয়েছিলেন, যাদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এবং তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী পর্যায়ক্রমে মন্ত্রী করেছিলেন, যাদের সততা সম্পর্কে জনশ্রুতি ছিল। এখন তারা কেউ আর জীবিত নেই। এখন ভুঁইফোড় রাজনীতিবিদেরাও লোকসভার সদস্য হচ্ছেন, মন্ত্রী হচ্ছেন। যেমন, নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভার মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি নিজেই বলেছেন, ‘ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর এয়ারলাইন্সে এয়ারহোস্টেজ হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম, ফেল করে জনতা পার্টির কর্মী হিসেবে যোগদান করি। তারপরের ইতিহাস তো আপনারা জানেন’।

এখন সেই স্মৃতি ইরানি নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী। সোশালিস্ট পার্টির সভাপতি মোলায়েম সিং যাদব একবার তার দলের টিকিটে দস্যুরানী ফুলন দেবীকে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত করে এনেছিলেন। নিজের জনপ্রিয়তার বাহাদুরি দেখানোর জন্য মোলায়েম সিং যাদবের এ কাজটা করা ঠিক হয়নি। নরসীমা রাও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার মন্ত্রিসভায় সুখরামকে টেলিকমিউনিকেশন দফতরের মন্ত্রী করেছিলেন। অথচ সুখরাম ছিলেন একজন সাধারণ টেলিফোন অপারেটর। তার বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তখন সিবিআই তার ঘর তল্লাশি করার সময় বালিশ আর তোশকের ভেতর দুই কোটি টাকা নগদ পেয়েছিল।

ভুঁইফোড়েরা এরকমই হয়। অবশ্য ভুঁইফোড় অভুঁইফোড় সবারই এখন একই অবস্থা। মনমোহন সিংহের মতো সৎ মানুষ এখন ভারতীয় রাজনীতিতে বিরল হয়ে যাচ্ছেন। নেহরু, ইন্দিরা, রাজিব তিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেহরু পরিবারের লোক। তারাও সৎ মানুষ ছিলেন। রাজিবের বিরুদ্ধে বোফর্স কেলেঙ্কারি ছিল বানোয়াট কাহিনি। নেহরু পরিবারকে কলঙ্কিত করার জন্য এ কাহিনি রাজিবের অর্থমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং তৈরি করেছিলেন। এ কাহিনির জোরে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং রাজিবকে হটিয়ে প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন।

বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সততার জনশ্রুতি ছিল সত্য, তবে তিনি রাজিবকে হটানোর জন্য কল্পিত বোফর্স কেলেঙ্কারির কথা প্রচার করে অমার্জনীয় অপরাধ করেছিলেন। কারণ, শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছিল সম্পূর্ণ বোফর্স কেলেঙ্কারিটাই ছিল মিথ্যা। নেহরু পরিবারকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্যই এ মিথ্যা কাহিনি সৃষ্টি করা হয়েছিল। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং শুধু একটা সৎ মানুষের সততা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেননি, ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির মতো সম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানকেও সাহায্য করেছিলেন। সিট অ্যারেজমেন্টের কারণে লোকসভায় যে বিজেপির সদস্য ছিল দুইজন, তা একটানে ৮৬-তে পৌঁছেছিল।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফ্রান্স থেকে রাফেল যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন। আসলে রাফেল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করেছিলেন যখন মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন। দামও স্থির হয়েছিল। আর তখন শর্ত ছিল বিমানগুলোর সংযোজনের কাজ হবে ভারতের অ্যারোনটিক কারখানায়। ফ্রান্সের টেকনিশিয়ানদের তত্ত্বাবধানে ভারতের টেকনিশিয়ানরা কাজটা সম্পন্ন করবে। তাতে করে ভারতের টেকনিশিয়ানদের শিক্ষানবিশের কাজটাও সম্পন্ন হবে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে নতুনভাবে যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তিটি করলেন। পুরনো চুক্তিটি তিনি বাতিল করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদির চুক্তিতে বিমানের মূল্য স্থির হলো আগের চুক্তির তুলনায় বহু বেশি। আবার বিমানগুলো ভারতে অ্যাসেম্বলিং করবে আম্বানি অ্যারোনটিকসের কারখানায়।

আম্বানির সঙ্গে ফ্রান্সের চুক্তিও হয়েছে। আম্বানির কোনও অ্যারোনটিক কারখানা নেই। এখন তারা এ কাজ পাওয়ার পর কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিজেই বলেছেন, এ ব্যাপারে সবকিছু ভারত সরকারের ইচ্ছানুসারে হয়েছে। আগামী লোকসভা নির্বাচনের সময় রাফায়েল বিমান ক্রয়ের বিষয়টা মোদি সরকারের কেলেঙ্কারি হিসেবে সমালোচিত হবে।

নেহরুর একটা বেকার শ্যালক ছিল। নেহরুর বাসায় থাকতো। শত অনুরোধের পরও তাকে নেহরু একটা সরকারি চাকরি দেননি। নেহরুর প্রাইভেট সেক্রেটারি এম.ও. মেথাই দুঃখ করে তার বইয়ে লিখেছেন, বহু দিন ছেলেটা রোলিং স্টোনের মতো নেহরুর পিছে পিছে ঘুরেছে। সেকাল আর একালের মধ্যে কত তফাৎ। ইন্দিরার চরিত্রেও তার পিতার আর রাজিবের চরিত্রেও তার মাতামহের গুণাবলি বিদ্যামন ছিল। অকারণে ভারতের মানুষ নেহরু পরিবারকে ভালোবাসেন না। রাহুল গান্ধীর চরিত্রেও সে গুণাবলি রয়েছে। মনমোহন সিং ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখন রাহুলকে তার মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী করার জন্য তিনি এবং তার মা সোনিয়া গান্ধী বহু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু রাহুল মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেননি।

২০১৪ সালে আম্বানিরা মোদিকে নির্বাচিত করে প্রধানমন্ত্রী করতে টাইমস পত্রিকার মতে ৭/৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছিলেন। এখন ক্ষমতার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে নরেন্দ্র মোদিকে তো তা চক্রবৃদ্ধি হারে পরিশোধ করতে হবে। সম্ভবত রাষ্ট্রীয় তহবিল তছরুপ করে সে কারণে মোদি আম্বানিকে রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করলেন। নির্বাচনের সময় মনে হয় নরেন্দ্র মোদিকে এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে।

ভারতের বর্তমান লোক সংখ্যা ১২৫ কোটি। তার মধ্যে ৮০% হচ্ছে কৃষক। কৃষককুল তাদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্য হারাচ্ছে। সে কারণে কৃষকেরা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ক’মাস আগে মহারাষ্ট্রের এক লক্ষ কৃষক তিন দিনের পথ পায়ে হেঁটে গ্রাম থেকে বোম্বে এসেছিলেন তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে। মহারাষ্ট্রের রাজ্য সরকার দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের বিদায় করেছে। আবার তিন সপ্তাহ আগে উত্তর প্রদেশের ত্রিশ হাজার কৃষক দিল্লি অভিমুখে পদযাত্রা করেছিলেন।

কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাদের পথরোধ করে রাজধানীতে প্রবেশ করতে দেয়নি। দুদিন চিড়ামুড়ি খেয়ে রাজধানীর বাইরে অবস্থান করে তারা চলে গেছেন সত্য, কিন্তু আগামী নির্বাচনে তার প্রতিক্রিয়া হবে তো প্রচণ্ডভাবে। উত্তর প্রদেশে লোকসভার আসন সংখ্যা ৮০টি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি ৭১টি আসন পেয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে যত উপনির্বাচন হয়েছে তাতে বিজেপি একটি আসনেও জিততে পারেনি। বিজেপি গত পাঁচ বছর সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়েছে খুবই কঠিনভাবে। কিন্তু করণার উপনির্বাচনে ক্রান্তি দলের প্রার্থী ছিল মুসলমান। করণায় মুসলমান প্রার্থীকে পরাজিত করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তার মন্ত্রিসভার কয়েকজন মন্ত্রী নিয়ে করণায় অবস্থান নিয়েছিলেন। আর নরেন্দ্র মোদি এসে তিনটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মিটিংও করেছেন, মিছিলও করেছেন। করণার লোকসভা আসনটি ১০টি বিধানসভার আসনের সমন্বয়ে গঠিত, যার ৯টির বিধায়ক ছিলেন বিজেপির। সাম্প্রদায়িকতার প্রচার তুঙ্গে তুলেছিল। কিন্তু ক্রান্তি দলের মুসলমান প্রার্থী তমদ্দুন হাসান ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজেপি প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন। সুতরাং মনে হচ্ছে বিজেপির ক্ষমতা ফিরে পাওয়া কঠিন হবে।

আগামী মাসে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশরাজস্থান,তেলেঙ্গানা ও মিজোরাম রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হবে। মিজোরাম এবং তেলেঙ্গানা রাজ্য ছাড়া অন্য তিন রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায়। রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন দিয়ে লোকসভার নির্বাচনের বিষয় আন্দাজ করা মোটামুটি কঠিন। গত পাঁচ বছরে অনেক রাজ্যে বিজেপি বিধানসভায় জিতেছে কিন্তু সেসব রাজ্যে যেসব লোকসভার উপনির্বাচন হয়েছে তাতে বিরোধীরা জিতেছে। এ পর্যন্ত ২৭টি লোকসভার উপনির্বাচন হয়েছে, যেখানে বিজেপি দলীয় এমপি ছিল। কিন্তু বিজেপি মাত্র ৫টি লোকসভা আসনে জিতেছে। মোদি ২০১৪ সালের নির্বাচনী ওয়াদা পালনে ব্যর্থ হয়েছে, আবার বিরোধীরাও জোট গঠনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কংগ্রেস বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়াই কংগ্রেস জোটভুক্ত হতে সম্মত আছে। সুতরাং অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিজেপির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া ও পরবর্তী সরকার গঠন কঠিন হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বাজেটে শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
বাজেটে শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
ডিএনসিসির কাওরান বাজার আঞ্চলিক অফিস যাচ্ছে মোহাম্মদপুরে
ডিএনসিসির কাওরান বাজার আঞ্চলিক অফিস যাচ্ছে মোহাম্মদপুরে
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ