X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘ভালো নির্বাচন’ এবং সিইসি’র ইতিহাস গড়ার প্রতিশ্রুতি

আমীন আল রশীদ
২১ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৩৩আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৩৪

আমীন আল রশীদ ভালো নির্বাচন বলতে কী বোঝায়, অংশগ্রহণমূলক নাকি গ্রহণযোগ্য? সাধারণত বলা হয়, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেই সেটি গ্রহণযোগ্য হয় এবং সেটিকেই ভালো নির্বাচন বলা যায়। কিন্তু এই উপসংহারে পৌঁছাও খুব যুক্তিযুক্ত নয় এ কারণে যে, ধরা যাক নির্বাচনে সব দল (অন্তত প্রধান দলগুলো) অংশ নিলো কিন্তু নির্বাচনি ব্যবস্থাটি এমন যে, সেখানে বিশেষ একটি দল ভোটের মাঠে বিশেষ সুবিধা পায় বা সবার জন্য সমান ‍সুযোগ নেই, তাহলে সেই নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে? গ্রহণযোগ্য না হলে সে নির্বাচনকে ভালো নির্বাচন বলার সুযোগ নেই।
পক্ষান্তরে দেখা গেলো, নির্বাচনে সব দল অংশ নিলো না, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ দুয়েকটি দলও ভোট বর্জন করলো, কিন্তু নির্বাচনি ব্যবস্থা স্বচ্ছ এবং সেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ রয়েছে, যে সরকাররে অধীনে নির্বাচন হচ্ছে তারা (দলীয় কিংবা নির্দলীয়) নির্বাচন কমিশনের ওপরে কোনও প্রভাব বিস্তার করছে না, অর্থাৎ নির্বাচন পরিচালনায় ইসি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে, এমনকি তারা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ব্যাপারেও শূন্য সহনশীল (জিরো টলারেন্স) নীতি অবলম্বন করছে—তাহলে সেই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা না গেলেও ভালো নির্বাচন বলা যাবে নিশ্চয়ই।

তবে অংশগ্রহণমূলক হলেই ভালো নির্বাচন হওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয় এ কারণে যে, ভোটের মাঠে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলে সব দল একটি বাড়তি চাপের মধ্যে থাকে। সেইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকেও অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়।

যদিও ১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনি ব্যবস্থা বলে ওই অর্থে কিছু ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৩ সালে প্রথম যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তখন প্রসঙ্গটি এত জরুরিও ছিল না। কারণ ধারণা করা যায় তখন দেশের অধিকাংশ মানুষই আওয়ামী লীগের সমর্থক। কিন্তু তারপরও ওই নির্বাচনটি একশো ভাগ ত্রুটিমুক্ত যে ছিল না, তা পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের লেখায় স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের একটি চমৎকার বিশ্লেষণ রয়েছে। যাই হোক, দেশের ইতিহাসে প্রথম ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ২৯৩টি আসনে। তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৭৩.২০ শতাংশ।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল এবং ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার গঠিত দল বিএনপি ২০৭ টি আসনে জয় পায়। সুষ্ঠু স্বাভাবিক এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচন হলে তখন হয়তো ফলাফল ভিন্নরকমও হতে পারতো। কিন্তু সেই নির্বাচনটি অবাধ-সুষ্ঠু এবং সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়েছে—এমন দাবি জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই তিনিও করতেন না।

জিয়াউর রহমানের হত্যা হওয়ার পরে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যায় আরেক সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের হাতে। তার অধীনে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে জয় পায়। পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এবারও জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসয়ে জয়ী হয়। জনাব এরশাদ এখনও বেঁচে আছেন। তিনি নিশ্চয়ই বুকে হাত দিয়ে এ কথা বলতে পারবেন না যে, তার আমলে অনুষ্ঠিত ওই দুটি নির্বাচন সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তিনি এই দাবি করতে পারবেন না যে, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচন দুটিতে জনমত ও জনরায়ের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটেছে। বস্তুত প্রথম থেকে এই চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে ক্ষমতাসীনদের অধীনে, এবং সঙ্গত কারণেই সেই নির্বাচনগুলোয় তাদের প্রভাব ছিল।

বাংলাদেশে নির্বাচনি ব্যবস্থা একটা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য চরিত্র পায় ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচন কোনও দলীয় সরকারের অধীনে হয়নি। হয়েছিল একধরনের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং যেহেতু সরকারের প্রত্যক্ষ প্রভাব বা মদদ ছিল না, ফলে সেই নির্বাচনটি নিয়ে ওই অর্থে কোনও বিতর্ক ওঠেনি। ওই নির্বাচনে দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আসন প্রাপ্তির মধ্যেও (বিএনপি ১৪০, আওয়ামী লীগ একটা ৮৮) ভারসাম্য ছিল। প্রধান দুই দলের ভোটপ্রাপ্তির হারের (বিএনপি ৩০.৮১ এবং আওয়ামী লীগ ৩০.০৮) ব্যবধান ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ, অর্থাৎ এক শতাংশেরও কম।

কিন্তু নির্বাচনি ব্যবস্থাটি আবারও বিতর্কিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার জন্য অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। ফলে একতরফা নির্বাচনে সরকারের প্রত্যক্ষ প্রভাব ও মদদ ছিল এবং ৩০০ আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন বিএনপি জয়ী হয় ২৭৮টি আসনে।

ওই বছরের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এবং এই নির্বাচনেও সরকারের কোনও প্রভাব ছিল না। স্বাভাবিকভাবে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে জয়ী হয়। অর্থাৎ পাঁচ বছরে সরকার নানারকম উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করলেও জনবিরোধী প্রচুর কাজও তারা করে। যে কারণে বিরুদ্ধভোটে সরকারি দল হেরে যায়। ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন তারই প্রমাণ।

২০১৪ সালে এসে নির্বাচনের চরিত্র পাল্টে যায়। ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করার ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনটি হয় দলীয় সরকারের অধীনে এবং ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করায় আওয়ামী লীগ ‘ওয়াকওভার’ পায়। ফলে এবারও দলীয় সরকারের অধীনে যে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে, সেখানে নির্বাচন কমিশন কতটা প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে, ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কতটা নিশ্চিত হবে, তা নিয়ে নানা মহলেই সংশয় রয়েছে।

যদিও সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে থেকে যে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব, এবারের নির্বাচন সেই ইতিহাস সৃষ্টি করবে।’ রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা দেশি-বিদেশি সকল স্তরের সংস্থার পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। এ বছর নির্বাচনের পরিবেশ হবে ভিন্ন। আমাদের দেশে কখনো নির্বাচন হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসিত নির্বাচন, কখনো সেনাবাহিনী, কখনো কেয়ারটেকারের অধীনে। কিন্তু অন্যান্য নির্বাচন থেকে এই নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ সংসদ ও সরকার বহাল রেখে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৪ সালে এমন একটি নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়নি। আমরা এবার আনন্দিত যে, এই নির্বাচনে সব দল অংশ নিতে যাচ্ছে। সে কারণে আপনাদের দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে এবং ভেজালমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।’

এরপর ১৫ নভেম্বর আলোচিত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও বলেছেন, এবার যদি তারা ভালো নির্বাচন করতে না পারেন তাহলে বিশ্বে তারা (ইসি) মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন না। এরপরদিন ১৬ নভেম্বর একমাত্র নারী নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমও বলেছেন, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় এমন কোনও কাজ তারা করবেন না।

 

যদিও ১৭ সেপ্টেম্বর টিআইবির একটি অনুষ্ঠানে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানও মত দেন, সহায়ক মাঠ, সুষ্ঠু প্রশাসন ও জবাবদিহিতা থাকলে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের মনে আস্থার সংকট রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন।

এর ঠিক আগের জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন ও সুষ্ঠু নির্বাচন’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা দাবি করেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের দাবিতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। সুজনের নির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অবশ্য আরেকটু এগিয়ে বলেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কোনও সরকারের আমলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সেটা হোক রাজনৈতিক সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক, হোক স্বৈরাচারী সরকার বা সামরিক সরকার অথবা সেনা সমর্থিত সরকার।’

তবে এতকিছুর পরেও সিইসি যে ইতিহাস সৃষ্টির কথা বলেছেন এবং তার দুই সহকর্মী সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে যে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, তা যদি সত্যিই হয়, তাহলে শুধু একাদশ জাতীয় নির্বাচনই নয়, বরং জনাব হুদার এই কমিশনের নামও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দেশের ইতিহাসে এর আগে এটিএম শামসুল হুদা কমিশন যেমন এখনও মানুষের মনে একটা আস্থার নাম, এবারের কে এম নূরুল হুদার কমিশন যদি সত্যিই দলীয় সরকারের অধীনে থেকেও একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও  গ্রহণযোগ্য এবং একইসঙ্গে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারেন, তাহলে সেটি শুধু দেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক সংকট নিরসনেই ভূমিকা রাখবে না, বরং ভবিষ্যতেও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকার পরিবর্তনের একটা স্থায়ী ব্যবস্থায় রূপ লাভ করবে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে রক্তক্ষয় কিংবা টেলিভিশনের স্ক্রিন ফাটানোর প্রয়োজন হবে না। অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরেও একটি ভালো নির্বাচনি ব্যবস্থা এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা চালু করতে না পারার যে আক্ষেপ দেশবাসীর মনে রয়েছে, সেটি দূর হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সাংবাদিক।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপির ‘ইন্ডিয়া-আউট’ ক্যাম্পেইন: বাস্তবতা ও সম্ভাব্য ফলাফল
বিএনপির ‘ইন্ডিয়া-আউট’ ক্যাম্পেইন: বাস্তবতা ও সম্ভাব্য ফলাফল
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আধুনিকায়নে কাজ করবে জাইকা ও বিএফডিসি
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আধুনিকায়নে কাজ করবে জাইকা ও বিএফডিসি
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ