X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

এই গ্রহের সবচেয়ে দুঃখী মানুষটির নাম সম্ভবত খালেদা জিয়া!

চিররঞ্জন সরকার
১০ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:৩৯আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:৪০

চিররঞ্জন সরকার বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সত্যিই খুব দুঃখ হয়। বর্তমানে তিনি সম্ভবত এই গ্রহের সবচেয়ে দুঃখী মানুষ। তিন তিনবার যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, দীর্ঘ তিন যুগ ধরে যিনি অত্যন্ত চাকচিক্যময় বিলাসী জীবন কাটিয়েছেন, রাজনীতির পাশাখেলায় পরাস্ত হয়ে এখন তার স্থান হয়েছে নির্জন জেলে। দেশজুড়ে নির্বাচনের ডামাডোল চলছে। এই ডামাডোল থেকে তিনি আজ অনেক দূরে। দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হওয়ার কারণে তিনি আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারছেন না। তিনটি আসনে তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন বটে, কিন্তু তার সবক’টি মনোনয়নপত্রই বাতিল করা হয়েছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে জিয়া পরিবারের কেউ নেই। তার বড় ছেলে তারেক রহমান যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে লন্ডনে ফেরার জীবনযাপন করছেন। তার দুই পুত্রবধূও নির্বাচনের মাঠে নেই। অথচ জিয়া পরিবারই এই দলটির প্রাণ।
প্রশ্ন হলো, জিয়া পরিবারের এমন পরিণতির জন্য দায়ী কে? কেন তার জীবনে এমন গভীর অমানিশা নেমে এলো? বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করে দেখলে দেখা যায়, ভুল নীতি আর পুত্রস্নেহে অন্ধ হয়ে যাওয়াই বেগম জিয়ার বর্তমান পরিণতির কারণ।

বেগম জিয়ার সবচেয়ে ভুল পদক্ষেপ ছিল স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াতের সঙ্গে তার দলের অতিরিক্ত সখ্য। অতিমাত্রায় জামায়াত নির্ভরতা, জামায়াত প্রীতি এবং কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘জামায়াতি ধরন’ অবলম্বন করার কারণে মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছে বিএনপি। আন্দোলনের ক্ষেত্রে জামায়াতি স্টাইল ফলো করায় অনিবার্য পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে তাকে এবং তার দলকে। 

তত্ত্বাবধয়াক সরকার ইস্যুতে ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর সিলেট অভিমুখে লংমার্চ থেকে শুরু করে ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চ এবং ওই বছর ১২ মার্চ ‘চলে চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচি পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলন সঠিক পথে ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি জামায়াতের সাবেক রোকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাত্রা শুরু করলে জামায়াতের ‘ভুল’ দিকনির্দেশনায় পথ হারায় বিএনপির আন্দোলন।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির আন্দোলন জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর আন্দোলনে রূপ নেয়। বিএনপির তথাকথিত ‘অহিংস’ আন্দোলন জামায়াতের ছোঁয়ায় ‘সহিংস’ হয়ে ওঠে। সেই সময় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, পেট্রোলবোমা, ককটেল বিস্ফোরণ, ফিসপ্লেট খুলে রেললাইন উপড়ে ফেলা, বিদ্যুৎ স্টেশন জ্বালিয়ে দেওয়া, গাছ ও রাস্তা কেটে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা, ভাঙা কাঁচের বোতল বিছিয়ে সড়কে যান চলাচল বাধা দেওয়া, হাইওয়েতে ধাতব কাঁটা পুঁতে রেখে গাড়ির চাকা ফুটো করাসহ আন্দোলন কর্মসূচিতে নানা ধরনের বীভৎস পন্থা অবলম্বলের ফল পুরোপুরিই বুমেরাং হয়েছে।

ক্ষমতাসীনরা জামায়াতের পাশাপাশি বিএনপির বিরুদ্ধেও কঠোর হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান এবং জনরোষের ভয়ে জামায়াতের মতো বিএনপিকেও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হয়েছে। নৈতিক মনোবল হারানো বিএনপি আর রাজপথে উজ্জীবিত হতে পারেনি।

বেগম খালেদা জিয়ার নির্মম পরিণতির জন্য তার অন্ধ পুত্রস্নেহও কম দায়ী নয়। তার বড় ছেলে তারেক রহমান অন্যায় আর অপকর্মের মাধ্যমে এক ‘মহাদৈত্য’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তারেক তার কিছু সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হাওয়া-ভবন নামে সরকারের সমান্তরাল এক বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। সবকিছু জেনেশুনেও বেগম জিয়া তার ছেলেকে শাসন করেনি। ছেলের অপকর্মের রাশ টেনে ধরার ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নেননি। মা হিসেবে সন্তানকে শাসন করার ব্যর্থতাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। লোভ, ক্ষমতায় মদমত্ত বিপথগামী সাবালক সন্তানকে তিনি শাসন করতে পারেননি। আর পারেননি বলে তিনি নিজে আজ করুণ পরিণতির সম্মুখীন। তারেক রহমান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা করে শেষ করে দিতে চেয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে। এই ঘটনা ক্ষমার অযোগ্য জেনেও তিনি ছেলেকে বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন বেআইনি পন্থার। নিজের জমানায় বিচার করেননি এই অপরাধের। বরং দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন আওয়ামী লীগের ওপর। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার নোংরা খেলায় ছেলের অন্যায়ের কাছে মাথানত করেছেন। ফলে দলকে বিপদে ফেলেছেন। নিজে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।

ক্ষমতার বাইরে গত ১২ বছরে খালেদা জিয়া আরও কিছু মারাত্মক ভুল করেছেন, যার খেসারত এখন তিনি নিজে যেমন দিচ্ছেন, দলকেও দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়া। তখন নির্বাচনে অংশ নিলে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও দলটির জয়ের সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। এছাড়া নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেলিফোনের ডাকে সাড়া না দিয়েও বেগম জিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নেননি। বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বেগম জিয়ার সাক্ষাৎ না করাও ছিল চরম শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ। যার কারণে ভারতও দলটির প্রতি বিরূপ হয়েছে।

১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং পরবর্তী সময়ে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি লক্ষ করলে দেখা যাবে যে দলটির রাজনীতির মূল উপজীব্য বিষয় ছিল ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা। শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা হিসেবে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তাঁর রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের ‘ভোট ও ভাতের অধিকার’ সুনিশ্চিত করা। অন্যদিকে গত প্রায় এক যুগ ধরে বিরোধী দলে থাকা বিএনপি শুরুতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করলেও এটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে তারা আসলে জনগণের ভোটের অধিকারের জন্য আন্দোলন করছে। গত পাঁচ বছরে দলটির রাজনীতি পুরোপুরি পরিবারকেন্দ্রিক এবং দলটির দাবিদাওয়া পরিবার ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। কেবল পরিবারের সদস্যদের মুক্তি অথবা দণ্ডপ্রাপ্ত নেতার নেতৃত্ব ধরে রাখার দাবি উচ্চারণের কারণে দলটির নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিগত পাঁচ বছর জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অথবা ভোটারদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে দলটির কোনও কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি।

বেগম জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে ট্র্যাজেডি হলো, তার কারাবাস নিয়ে বিএনপির কারও মধ্যে ন্যূনতম কোনও বেদনা-উদ্বেগ-আকুলতা দেখা যায়নি। তার পক্ষে তেমন কোনও মিছিল, সভা-হরতাল কোনও কিছুই হয়নি। বিএনপি নেতারা বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতিতে তার মুক্তির কথা বললেও আজ পর্যন্ত একটা বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়নি।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির জন্ম সেনানিবাসে হলেও আরেক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের ক্ষমতারোহণ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটা সর্বজনীন গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বেগম জিয়া এই দলকে যে পুনর্গঠিত করেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এবং রাজনীতি সম্পর্কে তার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার পরেও কেবল এরশাদ বিরোধিতা, আওয়ামী বিরোধিতা, ভারত বিদ্বেষ প্রচার আর দেশের মানুষের ধর্মানুভূতিকে পুঁজি করে বেগম জিয়া ক্ষমতার বাইরে থেকেও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং নিজেকে ‘আপসহীন নেত্রীর’ পরিচয়ে পরিচিত করতে সক্ষম হন। এক সময় তার নেতৃত্বগুণ ও কৌশলের কারণেই বিএনপি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং পরবর্তী সময়ে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। বেগম জিয়া এখনও সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

কিন্তু অন্ধ পুত্রস্নেহ আর কিছু ভুল নীতির কারণে আজ ‍তিনি জেলের নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে দুঃসহ দিন কাটাচ্ছেন। তিনি দলের মধ্যে যৌথ নেতৃত্বের ধারা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। ‘আপসহীন নেত্রী’ পদে পদে আপস করেছিলেন তার পুত্রের সঙ্গে। সর্বশেষ দলের নীতি আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াত-রাজাকারদের সমর্থনের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে সব কূল হারান।

নজরুলের গান আছে: চিরদিনকাহারওসমান নাহি যায়। মানুষের এই জীবনে সব সময় এক রকম যায় না। সবাইকেই সুসময় ও দুঃসময়ের মুখোমুখি হতে হয়। আর এটাই সম্ভবত জীবনের অমোঘ নিয়তি। সুসময়-দুঃসময় হাত ধরাধরি করে চলে। আর কে যে কখন আসে তা আগেভাগে বলা যায় না। বেগম জিয়ার এই দুঃসময়ও যেন অমোঘ নিয়তি!

লেখক: কলামিস্ট

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ