X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রেক্সিটের মতো ভয়ঙ্কর ভুল বাঙালি করবে কি?

মাসুদা ভাট্টি
২৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:১৮আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:২২

মাসুদা ভাট্টি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রিটেনে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা এই মুহূর্তে ব্রিটিশদের সবচেয়ে বড় ও ক্ষমাহীন ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এরই মধ্যে এই ভোটের কারণে একজন প্রধানমন্ত্রীসহ প্রায় ডজনখানেক মন্ত্রীকে পদ ছাড়তে হয়েছে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক দুরবস্থা সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ব্রিটিশ জনজীবনের স্থবিরতা ব্যক্তি সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে। আগামী কয়েক দশকেও ব্রিটেন এই ব্রেক্সিট-প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ব্রিটেনের এই হঠকারী সিদ্ধান্ত গোটা ইউরোপ তথা বিশ্বব্যবস্থাকে একটি বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ব্রিটেনে কনজারভেটিভ  দলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুনের সরকার যখন দুর্বল হয়ে পড়েছিল তখন তিনিই ঘোষণা দেন যে, একটি গণভোটের মাধ্যমে ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকা বা না থাকা নির্ধারিত হবে। নেতৃত্বের দুর্বলতা কাটাতে এই গণভোট-বটিকা প্রয়োগ করা হলেও অতি দ্রুত এই প্রচারণা চরম মিথ্যাচার ও অপপ্রচারে রূপ নেয়। রাতারাতি রক্ষণশীল দলের চেয়েও অতি মাত্রায় রক্ষণশীল এবং অভিবাসনবিরোধী, উগ্রবাদী একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। গোটা ব্রিটেনে তারা প্রচারণায় নামে ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আলাদা করার পক্ষে জনমত তৈরিতে। হেন মিথ্যা নেই যে তারা ভোটারদের জানায়নি। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কারণেই ব্রিটেনে প্রতিদিন হাজারে হাজারে ‘ইমিগ্র্যান্ট’ এসে ভরে যাচ্ছে এবং তার ফলে ব্রিটিশরা না খেয়ে মরতে বসেছে বলে যে প্রচারণা তারা শুরু করে তা শেষ হয় প্রতি সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কয়েক মিলিয়ন পাউন্ড দেওয়ার ফলেই নাকি ব্রিটেনবাসীর স্বাস্থ্যসেবা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ধরনের মিথ্যাচারও জাতীয় টেলিভিশন তথা সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, পূর্ব ইউরোপের কর্মঠ নাগরিকদের ব্রিটেন থেকে বের করে দেওয়ার এই অপপ্রচারে বাংলাদেশিসহ ভারত-উপমহাদেশীয় অভিবাসীদেরও শামিল হতে দেখা গেছে এবং তারা ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। তারা এটা ভাবেননি, শ্বেতাঙ্গ পূর্ব ইউরোপীয় অভিবাসীদের ব্রিটেনে আসা বন্ধ হলে যে অ-শ্বেতাঙ্গ বাংলাদেশি, ভারতীয় বা পাকিস্তানিদেরও ব্রিটেনে আসার পথ খুলে দেবে উগ্র বর্ণবাদী ইউকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। হয়েছেও তা-ই। ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আলাদা করতে গিয়ে যে বর্ণবাদী প্রচারণার আশ্রয় তারা নিয়েছিল এখন সেটিই ধাবিত হচ্ছে বাদামি ত্বকের নাগরিকদের ওপর। ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর যে ভয়ঙ্কর মন্দা ব্রিটেনকে গ্রাস করবে তার সবচেয়ে বড় শিকার হবে এদেশের অভিবাসী কমিউনিটি। আর ব্রিটিশ রাজনীতি এই ব্রেক্সিটের কারণে যে হাস্যকর অবস্থায় এসে পড়েছে তাতে আর ওয়েস্টমিনস্টার ডেমোক্র্যাসির সুনাম শেষ পর্যন্ত অক্ষুন্ন রাখা যাবে কিনা তা নিয়েই রাজনীতির পণ্ডিতরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

আসুন তাকানো যাক বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশকে হরহামেশাই বিদেশিরা নানাবিধ জ্ঞান ‘খয়রাত’ করে থাকে। বাংলাদেশে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। একটি স্বাভাবিক, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নির্বাচন। যেখানে একটি দলীয় সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা পালন করবে এবং নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দেবে। দেশের সব রাজনৈতিক দল এতে অংশগ্রহণ করেছে। যদিও এই অংশগ্রহণ প্রক্রিয়াটি খুব একটা সহজ ছিল না। কথায় কথায় নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিহত করার হুমকি থাকা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল, যাতে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এবং সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রাথমিক বিজয় অর্জন করেছে সবক’টি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের মাঠে ধরে রাখার মাধ্যমে। এই প্রশংসাটুকু আমাদের শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগকে দিতেই হবে যে, সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা কাঙ্ক্ষিত ভূমিকাটি রাখতে সক্ষম হয়েছেন। একই প্রশংসা বিএনপি-নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টকেও দিতে হবে যে, তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন এবং সমানে লড়ে চলেছেন।

বাংলাদেশ একটি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে। গণতন্ত্রকে বিপন্ন করার সকল আয়োজন সত্ত্বেও দেশটিকে সুস্থ রাজনীতির ধারায় টিকিয়ে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। এখানেও আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার প্রাপ্য প্রশংসা আমাদের দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশকে যে অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড় করানো গেছে তা পৃথিবীময় একটি বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। ‘বাংলাদেশ প্যারাডক্স’ নিয়ে এখন দেশে দেশে গবেষকরা তথ্য-উপাত্ত খুঁজছেন। দেশের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় বিরোধিতাকারী ও গণহত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় কার্যকর করার মাধ্যমে দেশটির ‘আদি পাপ’ মোচন করা হয়েছে। উগ্রবাদ ও ভয়ঙ্কর জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্য পশ্চিমা বিশ্বকে অবাক করেছে এবং সে প্রশংসায় কার্পণ্য থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা উদারভাবেই করা হচ্ছে। বাকি ছিল নির্বাচন ব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন আনা, যা এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করতে যাচ্ছে।

এমতাবস্থায় আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বাংলাদেশে আবারও একটি চিহ্নিত ও ভয়ঙ্কর অপশক্তি নিজেদের চেহারাকে আড়াল করে নানাবিধ কায়দায় ভোটে অংশ নিচ্ছে এবং মিথ্যাচার দ্বারা ভোটারদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্রেক্সিট-প্রচারণায় যেমন মিথ্যাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল এবং জাতীয় গণমাধ্যমও সেসব মিথ্যাকে ‘চ্যালেঞ্জ’ দেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করেনি তেমনই বাংলাদেশেও মিথ্যা প্রচারণায় গণমাধ্যমকে যুক্ত করা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ব্যক্তি আক্রমণ ও ব্যক্তিকে মিথ্যাচারের মাধ্যমে চরমভাবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তোলা থেকে গুজব ছড়িয়ে ভোটের মাঠকে উদ্বেগপূর্ণ করে তোলার যে চর্চা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে এই দেশবিরোধী অপশক্তিটি বিজয়ী হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে; গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হবে এবং সর্বোপরি ব্যক্তির সামাজিক জীবনকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দেবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে, ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অন্ধকারের যুগ। আসন্ন ভোটে কোনও অঘটন ঘটলে আমরা সে যুগে নতুন করে প্রবেশ করবো, যখন পলাতক আসামির ক্ষমতায়ন হবে, রাতারাতি মুক্ত করে আনা হবে দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকেও। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিতরা ইতোমধ্যেই মনোনয়ন লাভ করেছে এবং তারা বিজয়ী হলে এদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হবে–এসব সন্দেহ প্রকাশ করা যেতে পারে কিন্তু তাতে সত্য বদলাবে না।

ব্রিটেনের প্রতিটি নাগরিক জানেন যে, ব্রেক্সিট ভোট তাদের জীবন থেকে কী কেড়ে নিয়েছে। কত বড় ভুল তারা করেছে উগ্রবাদী শক্তির মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে একদিন একটি মূল্যবান ভোটকে মিথ্যাচারে ডুবিয়ে দিয়ে। এখন তারা কাঁদছে। একের পর এক প্রধানমন্ত্রীকে হাস্যকরভাবে অপমানিত হতে হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছেদের দরকষাকষি করতে গিয়ে। নিজেদের সংসদেও দিনের পর দিন ধরে চলছে অচলাবস্থা। কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা আসছে, ভোট পাওয়া যাবে না বলে বিল আটকে  থাকছে দিনের পর দিন। এরকম দুরবস্থা ব্রিটিশ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও গণতন্ত্রের গর্বকে লাঞ্ছনায় বদলে দিচ্ছে। দেশে দেশে ব্রিটিশ গণতন্ত্র এখন এক হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবলমাত্র ভোটদানে ভুলের কারণেই ব্রিটেনকে এই অপমান হজম করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে আর মাত্র এক সপ্তাহ পরে নির্বাচন। বাঙালি যতবার ভোটদানে ভুল করেছে ততবার তার মূল্য দিতে হয়েছে দেশের অর্থনীতিকে, রাজনীতিকে এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রকে। নির্বাচিত হয়েও যে সরকার ‘হাওয়া ভবন’-এর হাতে দেশকে ছেড়ে দেয়, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটায়, সারা দেশে ৫০০’রও বেশি বোমা হামলা চালায়, বাংলাভাইর মতো জঙ্গির উত্থান ঘটায়–তারা ক্ষমতায় ফিরে এলে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কিছু আর আস্ত রাখবে কিনা সেটা নিশ্চয়ই ভোটের আগে ভাবতে হবে। কারণ, ভোটের পরে এই ভাবনা কোনও কাজে আসবে না। ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেনের কাছ থেকে তাই বাঙালি-ভোটারদের শেখার আছে অনেক কিছুই।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি

 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশের সাবেক কোচকে নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের সাবেক কোচকে নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
বিএনপির চিন্তাধারা ছিল অন্যের কাছে হাত পেতে চলবো: প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির চিন্তাধারা ছিল অন্যের কাছে হাত পেতে চলবো: প্রধানমন্ত্রী
রেকর্ড স্টোর ডে: এবারও বিশেষ আয়োজন
রেকর্ড স্টোর ডে: এবারও বিশেষ আয়োজন
পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ